আগামী বছর শেষ হওয়ার আগে মূল্যস্ফীতি কমছে না: অর্থ মন্ত্রণালয়
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার ফলে মূল্যস্ফীতি ক্রমেই যেভাবে বাড়ছে, সেই চাপ থেকে রেহাই পেতে বাংলাদেশকে আরও দেড় বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
চলতি বছরের জুনে প্রস্তুত করা 'ইনফ্লেশন আউটলুক ফর বাংলাদেশ' শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্ববাজারে জ্বালানি, খাদ্যশস্যসহ বিভিন্ন পণ্যের দামে ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। এতে চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে মূল্যস্ফীতি চূড়ায় পৌঁছবে এবং ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য কমে এলে ধীরে ধীরে মূল্যস্ফীতি কমবে। ওই সময় মূল্যস্ফীতির হার স্থিতিশীল থাকবে বলে ধারণা করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আরেক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ৫.৬ শতাংশে ধরে রাখার লক্ষ্য থাকলেও বৈশ্বিক পর্যায়ে জ্বালানি ও খাদ্যসহ সব পণ্যের মূল্য ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি টাকার অবমূল্যায়নের কারণে চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি কোন পর্যায়ে থাকবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সার, জ্বালানি ও বিদ্যুতে ভর্তুকি না বাড়ালে চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ এবং এসব পণ্যে ভর্তুকি বাড়িয়ে আগের দামে বিক্রি করলে মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ৭ শতাংশ হতে পারে বলে ওই প্রতিবেদনে প্রাক্কলন করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
অর্থ বিভাগের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস ও তেলের মূল্য যে হারে বেড়েছে, তার পুরোটা ভোক্তাদের উপর চাপিয়ে দিলে চলতি জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়াবে ৯.৪ শতাংশে। আর গ্যাস, বিদ্যুৎ ও তেলের দাম না বাড়ালে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়াবে ৬.৭ শতাংশে।
তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত জুনেই অর্থ বিভাগের প্রাক্কলনের তুলনায় মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৭.৫৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা গত ৯ বছরে সর্বোচ্চ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পণ্যমূল্যের ব্যাপক স্ফীতিসহ বৈশ্বিক অর্থনীতির পরিস্থিতির ভিত্তিতে এসব প্রক্ষেপণগুলি অনুমান করছে যে, এতে করে স্থানীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিজস্ব মডেল এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদহার নির্ধারণ প্রভাবিত হবে।
তবে ইউক্রেন যুদ্ধ, বাংলাদেশের কৃষির উৎপাদন এবং মূল্যস্ফীতির যে ধারণা করা হয়েছে—তার ভিত্তিতে এসব প্রক্ষেপণ (নির্ভুল হওয়া) অনেকটাই অনিশ্চিত।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু এবং তার জেরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে খাদ্যপণ্য, জ্বালানি, সারসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যায়। যার নেতিবাভক প্রভাবে বাংলাদেশেও মারাত্মকভাবে ভুগছে।
মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার খাদ্য, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারের ভর্তুকিতে বরাদ্দ ৫২ শতাংশ বাড়িয়েছে। এক কোটি দরিদ্র পরিবারকে 'ফ্যামিলি কার্ড' কর্মসূচির আওতায় কম মূল্যে তেল, চিনি, ডালও সরবরাহ করছে সরকার।
২০২২-২৩ অর্থবছরের নতুন মুদ্রানীতিতে, অর্থপ্রবাহ ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুদ হার—যা রেপো রেট নামেও পরিচিত—৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৫ শতাংশ থেকে ৫.৫০ শতাংশ করা হয়েছে—যা সাম্প্রতিক ইতিহাসে রেকর্ড।
কিন্তু এত সব পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতি না কমে উল্টো বেড়েছে।
ডলার সাশ্রয়ের পাশাপাশি ভর্তুকির চাপ বাড়ায় সরকার সোমবার ইউরিয়ার দাম কৃষক পর্যায়ে কেজিতে ৬ টাকা বাড়িয়ে প্রতি কেজির দাম করেছে ২২ টাকা।
এছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত ব্যয়বহুল জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য পালা করে সারাদেশে লোডশেডিংও করা হচ্ছে কিছুদিন ধরে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে সারা বিশ্বেই উদ্বেগ বিরাজমান। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য দুদেশেই ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির রেকর্ড হয়েছে। মূল্যস্ফীতি কি চূড়ায় পৌঁছেছে? উচ্চ মূল্যস্ফীতি কতদিন চলবে? এসব নিয়েই এখন অর্থনীতিবিদদের যত চিন্তাভাবনা।
সম্প্রতি 'ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক' শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এ প্রতিবেদনে আগামী দিনগুলোয় বিশ্ব অর্থনীতির স্বরূপ কেমন হবে, তার একটি পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার হবে ৩.২ শতাংশ। ওই প্রতিবেদনে আইএমএফ সতর্ক করে দিয়েছে যে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তবে তা বিশ্বকে মন্দার দিকে ঠেলে দিতে পারে। তবে এই অবস্থা কতদিন চলবে সে বিষয়ে কোনো পূর্বাভাস দেওয়া হয়নি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বিশ্বে জ্বালানি ও খাদ্যসহ বিশ্বে সব পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, বাড়তি আমাদনি ব্যয়ের কারণে রিজার্ভের পরিমাণ কমে আসার পাশাপাশি টাকার অবমূল্যায়নের ঝুঁকির মধ্যে বাজেটে ৫.৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ঘোষণা করাই ছিল অস্বাভাবিক।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি খুব একটা কমে আসার সম্ভাবনা নেই বলে তিনি মনে করেন।
ড. ফাহমিদা আরও বলেন, 'আমাদের মূল্যস্ফীতির মূল কারণ আমদানিজনিত। আইএমএফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে বিশ্বব্যাপী সংকট ২০২৩ সালেও কাটবে না। এখানে আমাদের আশা করার কোনো সুযোগ নেই যে দেশের অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে।'
উন্নত দেশগুরোতে মন্দাভাবের কারণে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে আসায় কিছু পণ্যের দাম বিশ্ববাজারে কমে আসার বিষয়টিকে ইতিবাচক লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করলেও এর সুফল দেশের বাজারে কতটা আসবে, তা নিয়েও সন্দিহান ড. ফাহমিদা।
তিনি বলেন, 'সুদের হার বৃদ্ধি, মূদ্রা সরবরাহ কমানো ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেশগুলোতে পণ্যের দাম কিছুটা কমেছে।
'আমাদের দেশে রেপো হার কমানো হেলও সুদের হার স্থির আছে। লম্বা সময় ধরে রেখে হঠাৎ ছেড়ে দেয়ায় টাকার মান দ্রুত পড়ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'বিশ্ববাজারে দাম কমার সুফলও দেশে পাওয়া যায় না অব্যবস্থাপনার কারণে।'
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতিতে লাগাম টানা ও অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে সহায়তার মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য যথাযথ রাজস্ব ও মুদ্রা নীতির মিশ্রণ প্রয়োজন।
কিন্তু দরিদ্রদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত নীতি না থাকায় 'ব্লাঙ্কেট ভর্তুকি' ভর্তুকি অব্যাহত রাখাকে দ্বৈত পণ্যমূল্যের ধাক্কার তাৎক্ষণিক প্রথম ঢেউ মোকাবিলা করার অস্থায়ী উপায় হিসাবে বিবেচনা করা উচিত বলে মন্তব্য করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, স্বল্প মেয়াদে দরিদ্রদের রক্ষা করতে এবং ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার মানের ব্যাপক পরিবর্তন এড়াতে অভ্যন্তরীণ মূল্য সমন্বয়ের গতি ধীর হওয়া উচিত।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মধ্য-মেয়াদে, ভর্তুকির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত রাজস্ব ব্যয় হ্রাস করা বাঞ্ছনীয় হবে।
অর্থ বিভাগের প্রতিবেদনে মত দেওয়া হয়েছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত মূল্যস্ফীতির চাপকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং দ্বিতীয়-ধাপের প্রভাব (যেমন মজুরি বৃদ্ধি) মোকাবিলা করতে মুদ্রানীতির অবস্থানকে স্বাভাবিক করার জন্য প্রস্তুত থাকা। এতে আরও বলা হয়েছে, মুদ্রা বিনিময় হারকে ধীরে ধীরে আরও নমনীয় করা হলে তা অর্থনীতিকে বাহ্যিক ধাক্কা থেকে রক্ষা পেতে এবং 'মানিটারি ট্রান্সমিশন'-এর অবস্থার উন্নতিতে সহায়তা করবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মজুরি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা তাত্ত্বিকভাবে মূল্যস্ফীতিজনিত চাপ কমাতে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু ১৯৭০ সালের পর সরকার আর এই কাজটি করেনি।
চলতি অর্থবছর মূল্যস্ফীতি কত হবে, সে সম্পর্কে সামষ্টিক অর্থনীতি এবং ঋণ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে অর্থ বিভাগ বলেছে, 'মূল্যস্ফীতির বৈশ্বিক কারণগুলো—যেমন বাণিজ্যের অংশীদার দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, টাকার অবমূল্যায়ন, বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার প্রতিবন্ধকতা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ—আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।'
তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং বেসরকারি খাতে প্রয়োজনীয় ঋণ প্রবাহ অব্যাহত রাখতে মুদ্রা সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি মুদ্রাবাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়ানো হচ্ছে বলে উঠে এসেছে এ প্রতিবেদনে।
চলমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ভর্তুকির চাপের মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদের মতামতও নিয়েছে অর্থ বিভাগ।
অর্থ বিভাগকে জ্বালানির দাম না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মহীউদ্দীন আলমগীর বলেন, 'জ্বালানির দাম ২০ শতাংশের মতো বাড়লে ধানের উৎপাদন খরচ বাড়বেই। কিন্তু সেগুলো ন্যায্যমূল্যে বিক্রি হওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। এটাই নতুন ভারসাম্য।'
মূল্যের উপর আর কোনো প্রভাব না ফেলে সামগ্রিক চাহিদা এবং নতুন সামগ্রিক সরবরাহ ধরে রাখার সুপারিশও করেন তিনি।
সরকার হয়তো সাধারণভাবে মূল্য কমাতে চাইবে বলে মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ।