পোশাক রপ্তানির নতুন পথ খুলেছে মোংলা বন্দর 

অর্থনীতি

29 July, 2022, 01:50 am
Last modified: 29 July, 2022, 02:13 pm
পোশাক রপ্তানিকারক ও বায়াররা বলেছেন, মোংলা বন্দর ব্যবহার করে রপ্তানির লিড টাইম উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে, এতে সময় ও অর্থ দুইয়েরই সাশ্রয় হবে...  

পদ্মা সেতুর কল্যাণে বেড়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোংলা বন্দরের ব্যবহার। বৃহস্পতিবার (২৮ জুলাই) তৈরি পোশাক পণ্যের চালানও প্রথমবারের মতো এ বন্দর দিয়ে জাহাজীকরণ হয়েছে, যা গার্মেন্টস রপ্তানির একটি নতুন করিডর উন্মোচন করলো।

পানামার পতাকাবাহী এমভি মায়েরস্ক নেসনা জাহাজ এদিন সকাল সাড়ে ১১টায় ঢাকা ও এর আশেপাশের ২৭টি কারখানার ১৭ কনটেইনার বোঝাই পোশাক পণ্য নিয়ে বন্দরটি ছেড়ে পোল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।

এর আগে পণ্যের চালান নিতে গত ২৫ জুলাই বন্দরের জেটিতে ভেড়ে মায়েরস্ক নেসনা।

পদ্মা সেতু হয়ে মোংলা বন্দরের মাধ্যমে পণ্য রপ্তানির উদ্যোগটি নিয়েছে সুইডিশ ফ্যাশন জায়ান্ট এইচঅ্যান্ডএম। এতে রপ্তানির লিড টাইম কমে আসাসহ, বিশ্বব্যাপী পোশাক রপ্তানির নতুন শিপিং রুট চালুর মাধ্যমে একটি বড় মাইলফলক অর্জিত হলো, বলে মনে করছেন বায়ার ও শিল্প-সংশ্লিষ্টরা। সময় ও খরচ বাচানোর এই সুবিধা সৃষ্টি হওয়ায় তারা বেশ উৎসাহ বোধ করছেন। 

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ মুসা বলেন, 'মোংলা বন্দরের জন্য এটি একটি স্মরণীয় দিন। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উদ্বোধনের ১ মাস পর পদ্মা সেতু হয়ে মোংলা বন্দরে গার্মেন্টস পণ্যের চালান জাহাজীকরণ হলো। ভবিষ্যতে এ বন্দর দিয়ে পোশাক রপ্তানি আরও বাড়বে'। 

তিনি আরও বলেন, চলতি বছরের ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী পদ্মা বহুমুখী সেতু উদ্বোধন করেছিলেন। এর পরে দক্ষিণবঙ্গের যেসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নব উদ্যমে বাড়ছে- তার মধ্যে মোংলা বন্দর অন্যতম।

মোংলা বন্দরের পরিচালক (ট্রাফিক) মোস্তফা কামাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আগে ফেরির জন্য দীর্ঘ অপেক্ষাসহ নানান জটিলতার কারণে আগে ঢাকা ও এর আশেপাশের রপ্তানিকারকরা মোংলা বন্দর ব্যবহার করতেন না। কিন্তু, পদ্মা সেতুর কল্যাণে এ বন্দর দিয়ে পোশাক পণ্য রপ্তানিতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন তারা। সেতু চালু হওয়ার পর ঢাকা থেকে সড়কপথে মোংলার দূরত্ব এখন মাত্র ১৭০ কিলোমিটার। অন্যদিকে, ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব ২৬০ কিলোমিটার।

'মোংলা বন্দরে জাহাজ হ্যান্ডলিং দ্রুত ও নিরাপদ হওয়ায়- সময় ও অর্থ সাশ্রয়ে এ বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানিতে আগ্রহী হয়েছেন ব্যবসায়ীরা'- তিনি যোগ করেন।

ব্যবসায়ীরা আগ্রহী, বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির তাগিদ

বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুসা টিবিএসকে জানান, পোশাক প্রস্তুতকারক বড় কোম্পানিগুলো এই বন্দর ব্যবহারের আগ্রহ প্রকাশ করায়, বিজিএমইএ নেতারা এরমধ্যেই তার সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

এবিষয়ে টিবিএসের সাথে আলাপকালে পোশাক রপ্তানিকারক ও বায়াররা বলেছেন, মোংলা বন্দর ব্যবহার করে রপ্তানির লিড টাইম উল্লেখযোগ্য হারে কমবে, এতে সময় ও অর্থ দুইয়েরই সাশ্রয় হবে–এজন্য তারা উৎসাহই বোধ করছেন। 

এ বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও চট্টগ্রাম বন্দরের ওপরও চাপ কমবে বলে মনে করছেন তারা। 

বৃহস্পতিবার এ বন্দর দিয়ে যাওয়া চালানে টিম গ্রুপের পাঁচ লাখ পিস পোশাকও ছিল।

টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ হিল-রাকিব টিবিএসকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বর্তমানে দেশের মোট আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ৯০ শতাংশের বেশি এবং কনটেইনার-ভিত্তিক বাণিজ্যের প্রায় ৯৮ শতাংশ হয়। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন এবং তার সুবাদে মোংলা দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধি একটিমাত্র বন্দরের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে। রপ্তানির লিড টাইমও সে সুবাদে কমবে।

তবে ব্যবসায়ীদের মতে, বন্দরটির সক্ষমতা বাড়াতে হবে, বিশেষত কনটেইনার হ্যান্ডেলিং সক্ষমতা বৃদ্ধি, কনটেইনার ফ্রেইট স্টেশন নির্মাণ এবং বন্দরের চ্যানেল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্যতা বৃদ্ধি করতে হবে- যাতে আরও বড় জাহাজ ভিড়তে পারে। 

এ ছাড়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন-সহ অন্যান্য গন্তব্যে পণ্য পাঠাতে রিটেইলার ব্র্যান্ডগুলো যেন বন্দরে আরও ঘন ঘন জাহাজ পায়- তাও নিশ্চিত করতে হবে। 

বাংলাদেশের পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় ক্রেতা এইচঅ্যান্ডএম (H&M)। মোট বার্ষিক রপ্তানির ১৩ শতাংশই যায় রিটেইলার ব্র্যান্ডটির কাছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫৫০ কোটি ডলারের অ্যাপারেল পণ্য কিনেছে এইচঅ্যান্ডএম। 

এইচঅ্যান্ডএম- এর বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফ্রিকা অঞ্চলের কান্ট্রি ম্যানেজার জিয়াউর রহমান-ও বলেন যে, ঢাকার ব্যবসায়ীদের জন্য এখন সবচেয়ে কাছের ও সুবিধাজনক হয়ে উঠেছে মোংলা বন্দর।  

একইসঙ্গে, মোংলা বন্দরে কনটেইনার ফ্রেইট স্টেশন (সিএফএস)-সহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু অবকাঠামো নির্মাণ অতি-জরুরি ভিত্তিতে করা দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষকে কার্গো হ্যান্ডেলিং সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।   

'বর্তমানে আমরা ইউরোপের সাথে সরাসরি বাণিজ্যে দুই সপ্তাহে জাহাজ পাচ্ছি। কিন্তু, বন্দর দিয়ে চালান পাঠানোর জন্য আরও ঘন ঘন জাহাজ আসা-যাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে'- বলেন জিয়াউর রহমান। 

মোংলা দিয়ে এইচঅ্যান্ডএম- এর চালান পাঠানোর উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশের নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সমিতি (বিকেএমইএ)-র সাবেক সভাপতি ফজলুল হক। 

তিনি মনে করেন, পর্যায়ক্রমে অন্য ব্র্যান্ডগুলিও বন্দরটি ব্যবহার করতে পারে। এজন্য তিনি বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির আহবান জানিয়েছেন। 

পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ টিবিএসকে বলেন, মোংলা বন্দর দিয়ে আরও ব্যবসাবাণিজ্যের সম্ভাবনা থাকলেও, কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতায় ঘাটতি এবং বন্দর চ্যানেলের কম নাব্যতার মতো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েই গেছে।

এ পর্যন্ত বন্দরের উন্নয়ন কাজ 

গত কয়েক বছরে মোংলা বন্দরের সক্ষমতা তারা অনেকটাই বাড়িয়েছেন বলে জানান মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুসা।

এখন বন্দরটি একসাথে ৪২টি জাহাজ হ্যান্ডেলিং করতে পারে। 

আরও রয়েছে বছরে প্রায় এক কোটি টন কার্গো, এক লাখ টিইইউ কনটেইনার এবং ২০ হাজার মোটরকার হ্যান্ডেলিং- এর সক্ষমতা। 

'আমরা আউটার বারের ক্যাপিটাল ড্রেজিং ২০২০ সালে শেষ করেছি। এ ছাড়া ইনার বারের ২৩ কিলোমিটার ড্রেজিং ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে শেষ হবে। এতে ৭-৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ বন্দরে আসতে পারবে'।

জাহাজ থেকে দ্রুত পণ্য আনলোড করতে তারা পর্যাপ্ত পরিমাণ যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করেছেন বলেও জানান তিনি। এতে ব্যবসায়ীরা বন্দরটি ব্যবহারে উৎসাহিত হবে এবং এর রাজস্ব বাড়বে। 

মোহাম্মদ মুসা বলেন, 'আমরা আশা করছি চলতি অর্থবছরেই রেকর্ড পরিমাণ রাজস্ব করতে পারব'। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.