ভিত শক্ত হচ্ছে গ্রিন ব্যাংকিংয়ের

অর্থনীতি

13 July, 2022, 06:25 pm
Last modified: 13 July, 2022, 06:26 pm
গ্রিন ব্যাংকিং নীতিমালা প্রণয়নের পর যত গ্রিন লোন বিতরণ করা হয়েছে, তার ৬৮ শতাংশই বিতরণ করা হয়েছে গত দুই বছরে। ঋণ বিতরণের এই ঊর্ধ্বমুখী হার ইঙ্গিত দিচ্ছে, সবুজ অর্থায়নের জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে।

সবুজ উদ্যোগ বাড়াতে পরিবেশবান্ধব অর্থায়নের জন্য তৈরি ব্যাংকিং মডেলের দিকে ঝুঁকছেন উদ্যোক্তারা। এ কারণে দেশের ব্যাংকিং খাতে ক্রমেই শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াচ্ছে গ্রিন ব্যাংকিং—যা টেকসই অর্থায়ন নামেও পরিচিত।

গ্রিন ব্যাংকিং নীতিমালা প্রণয়নের পর যত গ্রিন লোন বিতরণ করা হয়েছে, তার ৬৮ শতাংশই বিতরণ করা হয়েছে গত দুই বছরে। ঋণ বিতরণের এই ঊর্ধ্বমুখী হার ইঙ্গিত দিচ্ছে, সবুজ অর্থায়নের জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে।

টেকসই অর্থায়ন কর্মসূচির আওতায় গ্রিন লোনের এই নন-পারফর্মিং লোনের (এনপিএল) হার মাত্র ০.২ শতাংশ, যেখানে অন্যান্য ঋণের ক্ষেত্রে এ হার ৮-৯ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফাইন্যান্স বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার খন্দকার মোরশেদ মিল্লাত বলেন, 'ঋণ বিতরণ শেষে আমরা সেগুলোকে কঠোর নজরদারি করি। সে কারণে গ্রিন লোনের ক্ষেত্রে এনপিএল কম রাখতে পেরেছি।'

২০২১ সালে দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলো মোট মেয়াদি ঋণের ৪ শতাংশ গ্রিন লোন দিতে পেরেছে। ওই বছর ব্যাংকগুলোর মোট ২ লাখ ৩০ হাজার ২১৪ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করে। এর মধ্যে গ্রিন লোন ছিল ৬ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। আর ২০২০ সালে ১১ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা গ্রিন লোন দেওয়া হয়েছিল।

বর্তমানে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া দেশি-বিদেশি ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে অন্তত ২০টি ব্যাংক ২০২১ সালে গ্রিন লোন বিতরণের ন্যূনতম লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ভালো পারফর্ম করেছে। গত বছর মোট বিতরণকৃত মেয়াদি ঋণের ৫ শতাংশ ছিল গ্রিন লোন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১১ সালে গ্রিন ব্যাংকিং নীতির রূপরেখা দেয় এবং পরবর্তীতে ২০২০ সালে একে সাসটেইনেবল ফিন্যান্স পলিসির অন্তর্ভুক্ত করে।

২০২১ সালে সিটিব্যাংক এনএ তাদের গ্রিন লোনের লক্ষ্যমাত্রার ১০০ শতাংশ অর্জন করেছে। বিদেশি ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অভ ইন্ডিয়া তাদের লক্ষ্যমাত্রার ৭১.৮০ শতাংশ অর্জন করেছে।

বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা পূরণের তালিকায় তৃতীয় স্থানে ছিল ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংকটি লক্ষ্যমাত্রার ১৪.৩৩ শতাংশ অর্জন করেছে। এরপর আছে যথাক্রমে কমিউনিটি ব্যাংক (৯.৭০ শতাংশ), এনআরবি ব্যাংক (৯.১০ শতাংশ), বেসিক ব্যাংক (৭.৪২ শতাংশ), সাউথ ইস্ট ব্যাংক (৭.১৮ শতাংশ), ব্যাংক এশিয়া (৬.৮১ শতাংশ), আইএফআইসি ব্যাংক (৬.৫৬ শতাংশ), স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক (৫.৭৮ শতাংশ), মধুমতী ব্যাংক (৫.২৩ শতাংশ) এবং রূপালী ব্যাংক (৫.১২ শতাংশ)।

ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) মধ্যে বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স ফান্ড লক্ষ্যমাত্রার ৩২.৯৬ শতাংশ অর্জন করে শীর্ষে রয়েছে। এরপরেই আছে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি (১৬.৩০ শতাংশ), সিভিসি ফাইন্যান্স (১৫.২২ শতাংশ), অগ্রণী এসএমই ফাইন্যান্সিং কোম্পানি (৭.৬৬ শতাংশ), আইডিএলসি ফাইন্যান্স (৬.৪৩ শতাংশ) এবং প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট (৫.৬ শতাংশ)।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এনবিএফআইগুলোর পক্ষে বার্ষিক ঋণ বিতরণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধীরে ধীরে উন্নতি করতে হবে।

ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা শীর্ষ ১০ ব্যাংকের একটি ব্যাংক এশিয়া। ব্যাংকটির প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী বলেন, 'ফিউচার ইজ গ্রিন, তাই আগে থেকেই প্রস্তুতি থাকা ভালো। সে চিন্তা থেকে যেকোনো ক্রেডিট ডিসিশন নেওয়ার সময় আমরা গ্রিন ফিন্যান্সের বিষয়টিকে মাথায় রাখি।

'এছাড়া কাস্টমারকে এই ঋণ নিতে অনেকসময় মোটিভেট করতে হয়।'

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাসটেইনেবল ফিন্যান্স পলিসি অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো সাসটেইনেবল ফিন্যান্সের ১১টি ক্যাটাগরিতে মোট ৬৮টি পণ্যের বিপরীতে ঋণ দিতে পারে। এসব পণ্যের অধিকাংশই সবুজ অর্থায়নের অন্তর্ভুক্ত। 

২০২১ সালে গ্রিন ইন্ডাস্ট্রি নির্মাণ, গ্রিন বিল্ডিং নির্মাণ এবং অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থা, দুর্যোগ প্রতিরোধ ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়তে ৩ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ব্যাংকগুলো।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১ হাজার ৩২১ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে এলইডি বাল্ব/টিউব উৎপাদন বা অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্ট, উন্নত রাইস পারবয়েলিং সিস্টেম ও এনার্জি এফিশিয়েন্ট কুক স্টোভ অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্টের মতো প্রকল্পগুলোতে।

প্লাস্টিক, কাগজ, ব্যাটারি বর্জ্য রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য ব্যাগ উৎপাদন কারখানা নির্মাণে বিতরণ করা হয়েছে ৫৪১ কোটি টাকা ঋণ।

জৈবিক, রাসায়নিক এবং কেন্দ্রীয় ইটিপি, বর্জ্য ও পয়ঃনিষ্কাশন জল শোধনাগারের মতো প্রকল্পগুলো ৪২০ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছে। সোলার হোম সিস্টেম, পিকো গ্রিড, সোলার মাইক্রো গ্রিড বা সোলার ইরিগেশন পাম্পিং সিস্টেমের উন্নয়নের মতো প্রকল্পগুলোকে দেয়া হয়েছে ৩৯১ কোটি টাকা ঋণ।

এছাড়া পরিবেশবান্ধব ইট উৎপাদন প্রকল্পে ২৬৭ কোটি টাকা; সবুজ/পরিচ্ছন্ন পরিবহন, সবুজ উপকূলীয় অঞ্চল সম্প্রসারণ, পানি পরিশোধন, পানির বিশুদ্ধকরণ, মাটি ও পানির লবণাক্ততা প্রশমন বা নদী ভাঙন প্রতিরোধের মতো প্রকল্পের জন্য ২০১ কোটি টাকা; সবুজ কুটিরশিল্প নির্মাণে ১৬৩ কোটি টাকা; কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ৩৯ কোটি টাকা এবং সবুজ কৃষি খাতে ১৯ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে।

এনবিএফআইগুলো সবুজ কুটিরশিল্প নির্মাণের জন্য ১২২ কোটি টাকা, সবুজ/পরিবেশবান্ধব প্রতিষ্ঠানের জন্য ৭৫ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো ইন-হাউস এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট ইনডেক্সেও উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নতি করেছে, যা গ্রিন ব্যাংকিং সেবা প্রদানের চাবিকাঠি।

সৌরচালিত এটিএম বুথের সংখ্যা ২০২০ সালে ছিল ৩১টি, ২০২১ সালে তা বেড়ে ১৩৮টি হয়েছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ৬১২টি ব্রাঞ্চ সোলার পাওয়ার ব্যবহার করতো, এক বছরের ব্যবধানে সোলার পাওয়ার ব্যবহার করে ৭৯২টি ব্রাঞ্চ।

কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক ২০৫০ সালের মধ্যে ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ৫০ শতাংশকে গ্রিন লোনে পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে।

তবে কিছু তফসিলি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রিন লোনে আরো ভালো করতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সুদের হার কমাতে হবে। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.