৪% সুদে কৃষি ঋণ পাল্টে দিয়েছে কৃষকের জীবন: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন
আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনতে ডাল ও মশলা জাতীয় শস্য উৎপাদনে ৪ শতাংশ সুদে যে বিশেষ কৃষি ঋণ স্কিম চালু আছে, তা থেকে ঋণ নিয়ে লাভবান হচ্ছেন কৃষক, পরিবর্তন এসেছে জীবনযাত্রার মানে।
ঋণ নিয়ে ফসল উৎপাদন এবং উৎপাদিত ফসলের ভালো দাম পাওয়ায় ঋণ পরিশোধের পর যে মুনাফা পেয়েছেন তা দিয়ে কৃষক ও তার পরিবারের সদস্যরা আগের চেয়ে ভালো খাবার ও পোশাকের নিশ্চয়তা পাচ্ছেন।
শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে পেরেছেন। মুনাফার টাকায় নিজস্ব ঘরবাড়ি তৈরি ও জমির মালিকও হয়েছেন তারা। গেল ১০ বছরে তাদের জীবনযাত্রায় এই পরিবর্তন এসেছে।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত বিশেষ কৃষি ঋণ সংক্রান্ত একটি জরিপ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
৬টি বিভাগের ২৩টি জেলার ৫৩৫ জন গ্রাহকের (কৃষক) মতামত এবং অর্থবছর ২০১১ থেকে ২০২০ পর্যন্ত সময়ের তথ্য নিয়ে এই জরিপ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
ডাল, তেলবীজ, মশলা ও ভুট্টাসহ ২০টি শস্যের ক্ষেত্রে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে প্রথম ২% সুদে এই বিশেষ কৃষি ঋণ সুবিধা (স্কিম) চালু করা হয়।
২০১১-১২ অর্থবছরে এই ঋণের সুদহার বাড়িয়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছিল। গেল অর্থবছরে স্কিমের অধীনে ১০৭ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, জামানত বিহীন এই ঋণের খেলাপির হার বেশি নয়, মাত্র ৭ শতাংশ। তবে খেলাপিরা যৌক্তিক কারণেই খেলাপি হয়েছেন।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসল নষ্ট হওয়া কিংবা ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি অনেকে। তবে ঋণের সুদহারকে কোন কৃষকই উচ্চ সুদ বলেননি।
কৃষক যাতে ফসলের ন্যায্য মূল পায় সেজন্য একটি নীতিমালা থাকার সুপারিশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি ঋণ পরিশোধে তাড়া না দেয়া এবং ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে কৃষক যাতে মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই স্বল্পমূল্যে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য না হয় তা নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দেশনা দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
খেলাপি কম হওয়ার পাশাপাশি ঋণের টাকা অন্যখাতে ব্যবহারের প্রবণতাও কম কৃষকদের। এক্ষেত্রে মাত্র ৯% গ্রাহক তাদের ঋণের টাকা ভিন্নখাতে ব্যবহার করেছেন।
জরিপে অংশ নেয়া কৃষকদের বেশিরভাগই মনে করেন চাহিদার তুলনায় এই ঋণের পরিমাণ অনেক কম এবং ঋণ পরিশোধের সময়সীমাও কম।
ঋণের পরিমাণ ও পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোর পাশাপাশি অন্যান্য ফসলে যেমন- কলা, লিচু, মালটা, পেপে, আনারস, পেয়ারা, তাল, ড্রাগন ফ্রুট, কমলা চাষের ক্ষেত্রেও এই স্কিমের অধীনের ৪% সুদে ঋণ দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
ঋণ বিতরণ সহজ করতে শুধু ব্যাংকের শাখা নয় বরং উপ-শাখা কিংবা এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেটের মাধ্যমেও ঋণ বিতরণ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
এছাড়া করোনায় প্রধান প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদনে কৃষি ঋণের সুদহার কমিয়ে ৪% করা হয়েছে। এর ফলে অনেক কৃষক আমদানি নির্ভর শস্য উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারে। তাই এই স্কিমের অধীনে ঋণের সুদহার কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, যদি ঋণের সুদহার ২ থেকে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হয় তাহলে সরকারকে চলতি অর্থবছরের জন্য মাত্র ২.৮৩ কোটি থেকে ১.৪২ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে।
বিশেষ সুবিধার এই ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে কৃষকদের ঝক্কি ঝামেলাও কম বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। আবেদন পাওয়ার পর ৬ দিনেরও কম সময়ের মধ্যে ঋণ অনুমোদন হয়ে যায়। কৃষকরা জানিয়েছে, কোন ব্যাংকই ৪ শতাংশের বেশি সুদ নিচ্ছে না।
জানতে চাইলে, প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী দলের প্রধান ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (রিসার্চ) ড. মোঃ হাবিবুর রহমান দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কৃষি পণ্যের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে এই ঋণ বিশেষ ভূমিকা রাখছে'।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, 'যেমন-পেঁয়াজের ক্ষেত্রে আমরা প্রায়ই সমস্যা পড়ে যাই। আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে দাম বেড়ে যায়। যদি পেঁয়াজ উৎপাদনে আমরা স্বয়সম্পূর্ণ হতে পারি তাহলে এই সমস্যা কেটে যাবে'।
তবে শুধু উৎপাদন বাড়ালেই হবে না, সেই সাথে কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আর উৎপাদন বাড়াতে এই স্কিমের অধীনে ঋণের পরিমাণ বাড়ানো প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।