২২৩ কোটি টাকার সুপার ট্যাঙ্কারের যাত্রা শেষ হলো চট্টগ্রামে এসে

অর্থনীতি

16 July, 2021, 02:10 pm
Last modified: 16 July, 2021, 03:28 pm
জাহাজটি ভাঙার কাজ শুরু করেছে এইচ এম শিপইয়ার্ডের ৫০০ জন কর্মী। জাহাজটি কাটতে এসব কর্মীর ছয় মাসের বেশি সময় লাগবে।

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ইস্পাত তথা এমএস রডের দামও রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ছয় মাস আগে ৫০-৫২ হাজারে বিক্রি হওয়া এমএস রডের বর্তমান দাম ঠেকেছে ৭২ হাজার টাকায়। কাঁচামালের অভাবে মাঝারি ও ছোট মানের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যে রড উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।

তবে আশার কথা হলো- ইস্পাত শিল্পের কাঁচামাল সংকটের এই মূহুর্তে দেশে আমদানি হয়েছে বিশাল আকারের পুরনো জাহাজ। যা দিয়ে এই শিল্পের প্রায় অর্ধ লাখ টন কাঁচামালের যোগান হবে। আমদানি হওয়া জাহাজটির নাম 'ইএম ভাইটালিটি'। 

সাধারণত দেশে আমদানি হওয়া পুরানো জাহাজগুলোর মধ্যে বড় জাহাজের দৈর্ঘ্য হয় ৩৩০-৩৩৩ মিটার। কিন্তু আমদানি হওয়া জাহাজটির দৈর্ঘ্য ৩৪০ মিটার। যা তিনটি আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলার মাঠের সমান।

জাহাজটি আমদানির জন্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে দিতে হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ ৬৪ হাজার মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ২০৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। শুল্ককর দিতে হয়েছে ১৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ জাহাজটি আমদানিতে সব মিলে খরচ হয়েছে ২২৩ কোটি টাকা। এমনই দামি একটি পুরোনো জাহাজ ভাঙার জন্য আনা হয়েছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের এক জাহাজভাঙা কারখানায়। 

গত এক দশকে এত দামে কোনো জাহাজ আমদানির রেকর্ড নেই। বেশি দামে জাহাজ কেনার এই রেকর্ড গড়েছে সাবেক মেয়র এম মনজুর আলমের পারিবারিক শিল্পগ্রুপ মোস্তফা হাকিম গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এইচ এম শিপব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড। এ বছর এখন পর্যন্ত বিশ্বে এই ধরনের পুরোনো জাহাজ বিক্রি হয়েছে মাত্র ১১টি।

তেল পরিবহনকারী জাহাজটি আয়তনে ১৯ হাজার বর্গমিটার। পুরোনো জাহাজ বিক্রি হয় জাহাজে থাকা মোট লোহার ওজন ধরে। দুই বছর আগে মোস্তফা হাকিম গ্রুপ একই ধরনের জাহাজ কিনেছিল ১৮০ কোটি টাকায়। তখন লোহার দাম ছিল কম। এখন বিশ্ববাজারে লোহার দাম বেড়ে যাওয়ায় ৪৩ কোটি টাকা বেশি দামে কিনতে হয়েছে একই রকম জাহাজ।

আমদানির পর গত দুই সপ্তাহ আগে থেকে জাহাজটি ভাঙার কাজ শুরু করেছে এইচ এম শিপইয়ার্ডের ৫০০ কর্মী। জাহাজটি কাটতে এসব কর্মীর ছয় মাসের বেশি সময় লাগবে। তবে এই আয়তনের জাহাজ বানাতে সময় লাগে কমবেশি ৯ থেকে ১৫ মাস। জাহাজটি কেটে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাবে লোহা, যার পরিমাণ ৪৮ হাজার ৮৭ টন।  

এইচ এম শিপ ব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের ম্যানেজার পলাশ মজুমদার জানান, জাহাজটি বিশ্বের ১০টি বৃহৎ জাহাজের একটি। ২৩০ ফুট উচুঁ সৌদি তেলবাহী জাহাজটির উপরে রয়েছে ৩৪০ মিটার লম্বা ১০টিরও বেশি পাইপ। যেগুলো দিয়ে ট্যাংকে ভরা হত জ্বালানি তেল। আবার তেল স্থানান্তর করা হয় এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজে। ট্যাংকারটির ছাদে রয়েছে হেলিপ্যাড। মোস্তফা হাকিম গ্রুপের ১০ শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে চলবে এই কর্মযজ্ঞ।

জাহাজটি ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে জাপানের একটি কারখানায় তৈরি হয়। এ ধরনের নতুন জাহাজের দাম এখন প্রায় ৯৫ মিলিয়ন ডলার বা ৮০০ কোটি টাকা। আবার এ ধরনের জাহাজের প্রতিদিনের ভাড়া ৩৬ হাজার ডলার। এ রকম ৮১০টি জাহাজ বর্তমানে বিশ্বে পণ্য পরিবহনের সেবায় নিয়োজিত আছে।

তৈরির কয়েক বছর পর সৌদি আরবের জ্বালানি তেল পরিবহন কোম্পানি 'বাহরি'র হাতে ছিল জাহাজটি। এ ধরনের জাহাজ 'ভেরি লার্জ ক্রুড ক্যারিয়ার' বা জ্বালানি পরিবহনের খুব বড় আকারের জাহাজ হিসেবে পরিচিত। সাগর-মহাসাগরে জ্বালানি তেল নিয়ে ছুটে চলত এটি। ধারণক্ষমতার পুরোপুরি অর্থাৎ তিন লাখ টন জ্বালানি তেল ভরার পর পানির নিচের অংশে থাকত জাহাজটির সাড়ে ২২ মিটার।

মোস্তফা হাকিম গ্রুপের পরিচালক মো. সাইফুল আলম বলেন,  "বিস্ময়কর জাহাজটি ভাঙাও বিরাট কর্মযজ্ঞের। শ্রমিকরা ইতোমধ্যে শুরু করেছে খন্ড খন্ড করে কাটার কাজ। কাটা শেষে আমাদের দুটি কারখানা কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে এ বছর চালু হওয়া এইচ এম স্টিল এবং সীতাকুণ্ডের গোল্ডেন ইস্পাতে এই জাহাজের গলনশীল লোহা ব্যবহার করা হবে। বাকি পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রির পাশাপাশি তামা, পিতল, কপারের মতো বেশ কিছু মূল্যবান পণ্য রপ্তানি করা হবে। খরচের চেয়ে বাড়তি যা পাওয়া যাবে, তা উঠবে লাভের খাতায়।"  

সারাদেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ ইস্পাত তৈরি হয় এতে কাঁচামালের চাহিদা ৩০ লাখ টন। মূলত আন্তর্জাতিক বাজার থেকে নিলামের মাধ্যমে বাল্ক ক্যারিয়ার, অয়েল ট্যাংকার, কার ক্যারিয়ারসহ নানা জাহাজ এনে কাটা হয় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে। এই জাহাজ ভাঙা শিল্পকে কেন্দ্র করে সীতাকুণ্ডের ফৌজাদারহাট থেকে কুমিরা পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে এক'শর বেশি শিপব্রেকিং ইয়ার্ড। আর এ শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে জড়িত ২ লাখ মানুষ।

 
 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.