সুতার দাম কমছে  

অর্থনীতি

28 September, 2021, 02:45 pm
Last modified: 28 September, 2021, 03:20 pm
গত দুই মাসে ৩০ কাউন্ট মানের ইয়ার্নের দাম ৪.২০ ডলার থেকে ৪.৩০ ডলার পর্যন্ত উঠে যায়। তবে বর্তমানে তা ৪.১০ থেকে ৪.১৫ ডলারে নেমে এসেছে।

দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের মূল কাঁচামাল ইয়ার্নের দর অস্বাভাবিকহারে বেড়ে যাওয়ার পর তা কমতে শুরু করেছে। প্রতিবেশী ভারতের বাজারেও সুতার দাম কমতির দিকে। স্থানীয় বাজারের তুলনায় আমদানিতে কিছুটা মূল্য সুবিধা পাওয়ায় সম্প্রতি আমদানি বাড়তে থাকে ইয়ার্নের। এর প্রভাবে স্থানীয় বাজারেও ইয়ার্নের দাম কমতে থাকে। এছাড়া চলতি মাস থেকে এর মূল কাঁচামাল কটনের হারভেস্টিং শুরু হয়েছে বিশ্বের উৎপাদনকারী বিভিন্ন দেশে, যা চলবে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত। যদিও কটনের দাম এখনো কমতে শুরু করেনি।

পোশাক শিল্প মালিক ও টেক্সটাইল মিল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে গত দুই মাস ধরে পোশাক খাতে বহুল ব্যবহার হওয়া ৩০ কাউন্ট মানের ইয়ার্নের দাম ৪.২০ ডলার থেকে ৪.৩০ ডলার পর্যন্ত উঠে যায়। তবে বর্তমানে তা ৪.১০ থেকে ৪.১৫ ডলারে নেমে এসেছে। পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা এ দর আরো কমবে বলে আশা করছেন। কেননা ভারতেও একই ইয়ার্নের দাম ৩.৮০ ডলারে উঠে গেলেও বর্তমানে তা ৩.৬০ ডলারে আমদানি হচ্ছে।

দেশে তৈরি পোশাকের মধ্যে নিটওয়্যারের ৮০ শতাংশ ইয়ার্নের যোগান দেয় স্থানীয় স্পিনিং মিলগুলো। আর ওভেন পোশাকের ক্ষেত্রে তা ৪০ শতাংশের মতো। তবে গত জানুয়ারি থেকে এর মূল কাঁচামাল কটনের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারে ইয়ার্নের দামও ব্যাপকহারে বাড়তে থাকে।

এছাড়া বাংলাদেশের পোশাকের প্রধান রপ্তানি বাজার ইউরোপ ও আমেরিকায় পোশাক পণ্যের বিক্রি বাড়তে থাকায় প্রচুর ক্রয়াদেশ আসতে শুরু করে বাংলাদেশে।

পোশাক শিল্প মালিকদের দাবি, চাহিদা বাড়তে থাকায় স্থানীয় স্পিনিং মিল মালিকরা অস্বাভাবিক দর বাড়িয়ে প্রচুর মুনাফা করছেন। যদিও এমন অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছিলেন টেক্সটাইল খাতের উদ্যোক্তারা।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন টিবিএসকে বলেন, গত আট মাসে কটনের দাম ৪৭ শতাংশ বাড়লেও ইয়ার্নের দাম আমরা সে হারে বাড়াইনি।

ইস্যুটি নিয়ে গত দুই মাস ধরে উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য দেখা দেয় এবং পোশাক শিল্প মালিকদের উভয় সংগঠন ইয়ার্ন আমদানির বিদ্যমান বাধা অপসারণে সরকারের কাছে দাবি জানায়। যদিও সম্প্রতি উভয় পক্ষের সমঝোতায় কটনের দাম প্রতি পাউন্ড ১ ডলারের মধ্যে থাকলে প্রতি কেজি ইয়ার্ন ৪.২৫ ডলারের বেশি দরে (৩০ কাউন্ট) বিক্রি হবে না বলে টেক্সটাইল মিল মালিকরা আশ্বস্ত করেছেন।

তবে এর মধ্যেই অপেক্ষাকৃত বড় আকারের পোশাক কারখানার মালিকরা প্রতিবেশী ভারতসহ একাধিক দেশ থেকে ইয়ার্ন আমদানি শুরু করেছেন।

নারায়ণগঞ্জভিত্তিক এমবি নিট ফ্যাশন লিমিটেড গত দুই মাসে ভারত থেকে ৩৫০ টন ইয়ার্ন আমদানি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি আরো কিছু ব্লেন্ডেড ইয়ার্ন (ম্যান মেড ফাইবার ও কটনের মিশ্রণে তৈরি, যা পিসি ইয়ার্ন নামে পরিচিত) ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানির জন্য শিগগিরই এলসি খুলতে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ভারত থেকে ইয়ার্ন আমদানির ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর বা বেনাপোল স্থলবন্দর পর্যন্ত আসতে সব খরচ মিলিয়ে কেজিতে বাংলাদেশের তুলনায় ৬০ থেকে ৭০ সেন্টস কম দামে পাওয়া যাচ্ছে। এজন্য বড় ব্যবসায়ীরা বেশিরভাগই এখন স্থানীয় উৎসের বদলে আমদানিতে মনযোগী হয়েছেন। 

"এ কারণে স্থানীয় বাজারে ইয়ার্নের দাম কমতির দিকে। এই দাম আরো কমবে, কেননা ইতিমেধ্যে বিশ্বব্যাপী কটনের হারভেস্টিং শুরু হয়েছে এবং এবার ভালো হারভেস্টিংয়ের আশা করা হচ্ছে", বলেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যও ইয়ার্ন আমদানি বেড়ে যাওয়ার প্রমাণ দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য বলছে, গত জুলাইয়ে ইয়ার্ন আমদানি বেড়েছে ৮২ শতাংশ।

অবশ্য স্থানীয় স্পিনিং মিলগুলোর কাছ থেকে ইয়ার্ন ক্রয়ের জন্য এলসি খোলার এক দিনের ব্যবধানেও ইয়ার্ন পাওয়া সম্ভব, যা আমদানির ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে দুই সপ্তাহ থেকে দুই মাস পর্যন্ত সময় লাগে। অন্যদিকে স্থানীয় ইয়ার্ন ব্যবহার করে পোশাক রপ্তানি করলে ৪ শতাংশ ক্যাশ ইনসেনটিভ পাওয়া যায়, যা আমদানিকৃত সুতায় পোশাক রপ্তানি করলে পাওয়া যাবে না।

তা সত্ত্বেও ইয়ার্ন আমদানি লাভজনক বলে মনে করছেন ফতুল্লা অ্যাপারেলসের সিইও ফজলে শামীম এহসান।

তিনি বলেন,  ইন্ডিয়া থেকে আমদানিতে ৩০ কাউন্টের প্রতি কেজি ইয়ার্ন এখন ৩.৬০ ডলার আর বাংলাদেশে ৪.১৫ ডলার। এতে দরের যে পার্থক্য তাতে ক্যাশ ইনসেনটিভ না পেলেও পোষায়।

স্থানীয় বাজারে ইয়ার্নের দাম কমছে বলে জানিয়েছেন ইসরাক টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল হক।

তিনি বলেন, সম্প্রতি পোশাক শিল্প মালিকদের সঙ্গে আমাদের সভার সমঝোতা হয়েছে, কটনের দাম প্রতি পাউন্ড ১  ডলারের উপরে না গেলে ইয়ার্নের দাম (৩০ কাউন্ট) ৪.২৫ ডলারের বেশি হবে না। সেই দরেই বিক্রি হচ্ছিল। তবে কয়েকদিন ধরে ইয়ার্নের দাম কমতির দিকে।

মূলত আমদানি বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয়ভাবে চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্য আসায় দাম কিছুটা কমছে বলে জানান তিনি।

তিনি ছাড়াও আরো অন্তত চারজন টেক্সটাইল খাতের উদ্যোক্তা স্থানীয় বাজারে ইয়ার্নের দর কমছে বলে জানিয়েছেন। তারাও জানান, মূলত আমদানি বাড়তে থাকায় স্থানীয় পর্যায়ে দাম কমতির দিকে।

কটন হারভেস্টিংয়ের পূর্বাভাস কী বলছে

বাংলাদেশের কটন আমদানি এক সময় ভারতনির্ভর থাকলেও বর্তমানে তাতে পরিবর্তন এসেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৭.৫ মিলিয়ন বেল কটন আমদানি করেছে, যার ৩৭ শতাংশ এসেছে আফ্রিকার দেশগুলো থেকে। এছাড়া ভারত, সিআইএসভুক্ত (কমনওয়েলথ অফ ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেটস) দেশ, অস্ট্রেলিয়া ও ‍যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে এসেছে মোট আমদানির অর্ধেক।

কটনের হারভেস্টিংয়ের সময় সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। চলতি মৌসুমে কটনের হারভেস্টিং কেমন হবে, তা নিয়ে খাত সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য রয়েছে। মোহাম্মদ হাতেম বলেন, অতীতে দেখা গেছে, এক বছর কটনের সংকট হলে পরবর্তী বছর উৎপাদন বেশি হয়। সে হিসেবে এবার দাম কমবে। এছাড়া পাকিস্তান ও ব্রাজিলে ইতিমধ্যে ভালো হারভেস্টিংয়ের আভাস পাওয়া গেছে। তবে সরাসরি কটন আমদানিকারকরা বলছেন, কটনের হারভেস্টিং নিয়ে এখনো মন্তব্য করার সময় আসেনি।

এনভয় টেক্সটাইলে প্রতি মাসে ১৬০০ টন কটন ব্যবহার হয়।

এনভয় টেক্সটাইলের হেড অফ সাপ্লাই চেইন (কটন এন্ড ইয়ার্ন) মো. আতাউর রহমান বলেন, কটনের দাম কী হয়, তা নিয়ে এখনই মন্তব্য করা যাবে না। এজন্য আরো দুই থেকে আড়াই মাস অপেক্ষা করতে হবে।

মো. ফজলুল হক মনে করেন, এবারো কটনের দাম বাড়তি থাকবে। ইতিমধ্যে ভারতের মধ্যপ্রদেশ এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কটনের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

চীন বিশ্বে শীর্ষ কটন উৎপাদনকারী দেশ হলেও ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশটি আমদানিতেও শীর্ষে ছিলো। এরপরে রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। আলোচ্য সময়ে শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ ছিলো যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও বেনিন।   

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.