সরকারি সংস্থাগুলোর ব্যর্থতায় সীমাবদ্ধ প্রকল্পের সুফল

অর্থনীতি

23 March, 2021, 09:35 pm
Last modified: 23 March, 2021, 09:38 pm
বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে চলতে থাকা কয়েকটি প্রকল্প শুরু হওয়ার পর পাঁচ-সাত বছর কেটে গেলেও বাস্তবায়নের হার মাত্র এক থেকে দুই শতাংশ।

রংপুর এবং ময়মনসিংহ বিভাগের দারিদ্র্য-পীড়িত এলাকায় ছয় বছর আগের একটি প্রকল্পে ৩০ কোটি ডলার অর্থ বরাদ্দ করেছিল বিশ্ব ব্যাংক। ছয় লাখ চরম দারিদ্র্যের শিকার মানুষকে সহায়তার প্রদানের জন্য প্রকল্পটি ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে এই প্রকল্পের আওতায় যারা সহায়তা পেয়েছেন তাদের সংখ্যা এক লাখেরও নিচে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকৃত সুবিধাভোগীদের তালিকা প্রণয়নে ব্যর্থ হওয়ায় প্রকল্পটি লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়।

বর্তমানে, প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২২ সালে জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে।

বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে চলতে থাকা ১৫ টি প্রকল্প কীভাবে শামুকের মতো ধীর গতিতে এগিয়ে চলছে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই প্রকল্প। কয়েকটি প্রকল্প শুরু হওয়ার পর পাঁচ-সাত বছর কেটে গেলেও বাস্তবায়নের হার মাত্র এক থেকে দুই শতাংশ। আজ মঙ্গলবার থেকে বিশ্ব ব্যাংক অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সাথে দুই দিন ব্যাপী ভার্চুয়াল রিভিউ বা পুনর্মূল্যায়ন সভার আয়োজন করেছে। ইআরডি ছাড়াও প্রকল্পগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের প্রতিনিধিত্বকারী কর্মকর্তারা আলোচনায় অংশ নিবেন।

পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব মোহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, ন্যাশনাল হাউজহোল্ড ডাটাবেইজ (এনএইচডি) নির্মাণ প্রায় শেষ। কিন্তু এমআইএস সফটওয়্যারের অনুপস্থিতিতে ডেটাবেজ ব্যবহার করা সম্ভব না। সফটওয়্যার ডেভলপের মূল দায়িত্ব দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বলেও জানান তিনি।

"ইনকাম সাপোর্ট প্রোগ্রাম ফর দ্য পুরেস্ট" প্রকল্পের আওতাধীন ৩০ কোটি ডলারের মাত্র নয় কোটি চল্লিশ লাখ ডলার কাজে লাগানো হয়েছে। পাঁচ বছরে মাত্র ৩৬ শতাংশ কাজ সমাধার এই ধীর গতি দেখে বিশ্ব ব্যাংক পূর্ব প্রতিশ্রুত অর্থ থেকে পাঁচ কোটি ডলার কেটে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যদিকে, সুবিধাভোগীদের সংখ্যাও চার লাখে নামিয়ে আনা হয়।

দুই বিভাগের ৪৩টি উপজেলার গর্ভবতী মায়েদের নিয়মিত স্বাস্থ্য চেকাপের জন্য চার হাজার করে টাকা পাওয়ার কথা ছিল। সাত জেলার প্রতিটি পরিবার প্রত্যেক সন্তানের বয়স দুই বছর হওয়া পর্যন্ত শিশুদের বিকাশ ও পুষ্টির জন্য মাসিক ৭০০ টাকা বরাদ্দের উদ্যোগ নেওইয়া হয়েছিল।

ধীর গতির প্রকল্পের আরেকটি উদাহরণ হিসেবে নগরের বস্তিবাসীদের উন্নত আবাসন সহায়তার জন্য ২০১৬ সালে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিশ্রুত পাঁচ কোটি ডলারের প্রকল্পের উল্লেখ করা যেতে পারে।

দেশব্যাপী বৃহৎ এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পূর্বে সরকার প্রকল্পটির সাফল্য মূল্যায়নে পাইলট প্রকল্প পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়।

গত পাঁচ বছরে প্রকল্পটির মাত্র ৩১ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়। অন্যদিকে, এ বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ার মাত্র আট মাস বাকি থাকলেও বরাদ্দকৃত অর্থের মাত্র ১০.৪৯ শতাংশ বিতরণ করা হয়েছে। ফলস্বরূপ প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। 

প্রকল্পটির আওতায় বাংলাদেশ গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের তিনটি শহরে এবং সিটি করপোরেশনে তিন কোটি ২০ লাখ ডলারে ৫ হাজার ৭০০ ঘর নির্মাণের কথা রয়েছে।

পুনর্মূল্যায়ন সভা প্রতিটি প্রকল্প নিয়ে পৃথকভাবে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা চিহ্নিত করবে। সভায় সমস্যাগুলোর সম্ভাব্য সমাধান নিয়েও আলোচনা করা হবে।

সরকারের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তা, অর্থনীতিবিদ এবং বিশেষজ্ঞরা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা, ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত সমস্যা এবং বহু প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দক্ষতার অভাবকে দোষারূপ করছেন।

দীর্ঘ সময় ধরে আটকে থাকায় বহু প্রকল্পের খরচ বাড়ছে।

ফলে, এই প্রকল্পগুলো থেকে সুবিধা পেতেও বাড়তি সময়ের প্রয়োজন হবে।

উন্নয়ন সহযোগীরা প্রায়ই ঝুলে থাকা প্রকল্পগুলো থেকে অর্থ বরাদ্দ ফিরিয়ে নেন। পরবর্তীতে, এ সকল প্রকল্প অভ্যন্তরীণ অর্থায়ন কিংবা কঠিন শর্তে চড়া সুদে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে বাস্তবায়িত করতে হয়। ফলে, অর্থনীতিতে চাপের সৃষ্টি হয়।  

সভার রিভিউ সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ধীর গতিতে চলতে থাকা ১৫ টি প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংক ৩৬৫ কোটি ডলার অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ২৪ দশমিক ১৫ শতাংশ অর্থাৎ, ৮৮ কোটি ৪ লাখ ৬০ হাজার অর্থ বরাদ্দ হয়েছে।

অধিকাংশ প্রকল্পের চুক্তিই ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে সম্পাদিত হয়। ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, বিশ্ব ব্যাংক ১৫ টি প্রকল্পের মধ্যে আটটি প্রকল্পকেই সম্পূর্ণ নিশ্চল হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে শক্তি উৎপাদনকারী খাতের তিনটি প্রকল্প আছে। দুই দিন ব্যাপী রিভিউ সভায় বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে।

২০১৬ সালে বিশ্ব ব্যাংক চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জের মধ্য দিয়ে আশুগঞ্জ পর্যন্ত জলপথ উন্নয়নে ৩৬ কোটি ডলার বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিশ্ব ব্যাংক মাত্র ১ দশমিক ৭৩ শতাংশ বা ৬২ লাখ ৩০ হাজার ডলার বরাদ্দ দিয়েছে।

উপকূলীয় অঞ্চলে দুর্যোগ প্রতিরোধমূলক অবকাঠামো নির্মাণে ২০১৩ সালে ৪০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ পর্যন্ত বিতরণকৃত অর্থের পরিমাণ ২৩ কোটি ৭৮ লাখ ডলার।

সংশ্লিষ্টরা কী বলছেন?

বস্তিবাসীদের আবাসন প্রকল্পে ধীর গতি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব শহীদুল্লাহ খন্দকার বলেন, নারায়ণগঞ্জে ভূমি অধিগ্রহণে বিলম্ব হওয়ায় কাজের গতি স্থিতিশীল হয়ে পড়েছে।

এছাড়াও প্রকিউরমেন্ট প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে বিশ্ব ব্যাংকের অনুমোদনের প্রয়োজন হয় বলেও কাজ আটকে আছে বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ রিজিওনাল ওয়াটারওয়ে ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট ১'- এর নির্বাহী পরিচালক মাহমুদ হাসান সেলিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, বিভিন্ন ধাপে অনুমোদন প্রক্রিয়া শেষ হতেই দেড় বছর সময় লেগেছে।

এছাড়া, প্রথম টেন্ডার আহ্বানে কোনও নিলামকারিই সাড়া দেননি।

"বিশ্ব ব্যাংকের কাছ থেকে টেন্ডার সম্পর্কিত অনুমোদন পেতেই বহু সময় নষ্ট হয়েছে। এসকল কারণেই প্রকল্পটি শুরু হতে বহু সময় লেগে যায়। ঋণ বিতরণেও বিষয়টি প্রভাব ফেলেছে।"

বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হুসাইনকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বাংলাদেশে সকল ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পেই বাড়তি সময়ের প্রয়োজন পড়ে বলে জানান। এর ফলে উন্নয়নে যেমন বিলম্বের সৃষ্টি হয় তেমনি প্রকল্পের খরচও বেড়ে যায় বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ এখনও বিশ্ব ব্যাংকের কাছ থেকে উন্নয়ন কাজের জন্য সহজ শর্তে ঋণ লাভ করে থাকে। এই অর্থ গুলো এভাবে বরাদ্দ নিয়ে ফেলে রাখা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।

ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর হয়ে গেলেই দাতা সংস্থাগুলো বরাদ্দকৃত অর্থ সরিয়ে রাখে। এ অবস্থায় কর্তৃপক্ককে প্রকল্প বাস্তবায়নের বাস্তবতা বিবেচনা করে বিচক্ষণপূর্ণ ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে জানান তিনি।

আইএমইডি প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোভিড-১৯ এর কারণে মাঠ পর্যায়ে উন্নয়ন সহযোগী প্রতিনিধিদের উপস্থিতি কম থাকায় সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি সাহায্যগুলো অব্যবহৃতই থেকে গেছে।

তারা আরও জানায়, প্রকল্প হাতে নেওয়ার সময় সুবিধাভোগীদের প্রয়োজনের বিষয়টি মূল্যায়ন করা হয় না। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনাও অনুসরণ করা হয় না।

এছাড়া, বিদেশি দাতা সংস্থাগুলোর আরোপিত বিভিন্ন শর্ত, প্রতি ধাপে সংস্থার প্রধান অধিদপ্তর থেকে অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন স্তিমিত হয়ে পড়ে।

আইএমইডির সাবেক সচিব হাবিব উল্লাহ মজুমদার বলেন, বিদেশি অর্থ সহায়তার প্রকল্পগুলো বেশ উৎসাহের সাথেই হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু, বাস্তবায়নের সময় সেই উদ্দীপনা আর থাকে না।

বিভিন্ন ধরনেরর প্রকল্পে বিভিন্ন রকম সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। তবে হাবিব উল্লাহ মজুমদারের মতে, সবথেকে সাধারণ সমস্যাটি হল প্রকল্প স্থাপনা গুলো পরিদর্শনে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনীহা। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.