সক্ষমতা হারাচ্ছেন ভাড়াটিয়ারা, ভুগছেন বাড়িওয়ালারা

অর্থনীতি

সাদিকুর রহমান
25 June, 2020, 01:55 pm
Last modified: 25 June, 2020, 05:20 pm
মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমার কোনো লক্ষণ না থাকায় এবং প্রায়ই নতুন নতুন এলাকা লকডাউনের আওতায় যাওয়ায় নতুন করে বাসা খোঁজা বা বাসা বদল করাটাও বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে নগরের বাসিন্দাদের জন্য।

মাসের শুরুর দিকে নগরের অলিতে-গলিতে দেয়ালে দেয়ালে ছেয়ে যেত 'ভাড়া হবে' লেখা বিজ্ঞাপনে। এই শহরে প্রতিমাসেই হাজারো ভাড়াটিয়া তাদের বাসা বদলান, সেই বাসায় উঠেন নতুন ভাড়াটিয়া। কিন্তু মহামারিকালে অনেকটাই বদলে গেছে সে চিত্র।

তাহলে কি হচ্ছে এখন?

আগ্রহ নিয়ে বাড়ি ভাড়ার ওই বিজ্ঞাপনগুলো খেয়াল করলে দেখা যাবে, আগের মতোই সেখানে লেখা আছে, 'ভাড়া হবে। দুই বেড রুম, এক রুম এটাচ বাথরুমসহ। ড্রয়িং-ডাইনিং একসাথে। রান্নাঘর ও বারান্দা আলাদা, ঠিকানা, যোগাযোগ...'। 
কিন্তু যে মাস থেকে ভাড়া হবে তা একাধিকবার সংশোধন করা।

এই বাসাগুলো কি কয়েকমাস ধরেই খালি? কিন্তু কেন?

ঢাকার ফার্মগেটের মণিপুরীপাড়ার বাসিন্দা সালাহউদ্দিন আহমেদ নামে একজন বাড়িওয়ালা বলেন, "আমার বাড়ির তিনটি ফ্ল্যাট গত এপ্রিল থেকে খালি পড়ে আছে। পুরনো ভাড়াটিয়ারা সস্তায় বাসা খুঁজে সেখানে চলে গেছেন। গত তিনমাস ধরে নতুন কোনো ভাড়াটিয়াও আর আসেননি।"

তিনি জানান, তার বাড়ির প্রতিটি ফ্ল্যাট সার্ভিস চার্জ ছাড়াই ২৫ হাজার টাকায় ভাড়া দিতেন তিনি। চাহিদাও ছিলো বেশ। কিন্তু ভাড়াটিয়ার এমন আকাল এর আগে কখনো দেখেননি তিনি।

মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমার কোনো লক্ষণ না থাকায় এবং প্রায়ই নতুন নতুন এলাকা লকডাউনের আওতায় যাওয়ার ফলে নতুন করে বাসা খোঁজা বা বাসা বদল করাটাও বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে নগরের বাসিন্দাদের জন্য। এরমধ্যে অন্যতম একটি কারণ হলো, মহামারির কারণে চাকরি হারানোর ফলে শহরে টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়ায় অনেকেই এখন আর বেশি ভাড়াওয়ালা বাসায় থাকতে চাচ্ছেন না।

মিরপুরের রূপনগরের বাসিন্দা রুনিকা পারভীন জানান, তার বাড়িতে ১৩টি ফ্ল্যাট রয়েছে যার মধ্যে চারটি গত তিনমাস ধরেই খালি পড়ে আছে। এরমধ্যে আরও কয়েকজন ভাড়াটিয়া জানিয়েছেন জুলাই মাসে তারাও বাসা ছেড়ে অন্যকোথাও চলে যাবেন। অন্য ভাড়াটিয়ারাও ভাড়া পরিশোধ করতে দেরি করছেন।

"আমার বাসায় একজন ভাড়াটিয়া ছিলেন যিনি একটা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। করোনার কারণে উনার মাদ্রাসার আয়-রোজকার সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মে মাসে তিনি বাসা ছেড়ে চলে যান। গত মাস থেকে উনি পরিবারের সবাইকে নিয়ে মাদ্রাসারই একটি রুমে থাকছেন," বলছিলেন রুনিকা।

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে এই বাড়িওয়ালা বলেন, এই বাড়িটি বানানোর সময় তিনি ব্যাংক থেকে ৩০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। প্রতিমাসেই কিস্তিতে ৯০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয় তাকে। একে একে ভাড়াটিয়ারা চলে যাওয়ায় এবং নতুন ভাড়াটিয়া না আসায় দুর্ভাবনায় পড়েছেন রুনিকা পারভীন।

রাজধানীর ফার্মগেট, খিলগাঁও এবং জিগাতলা এলাকার বেশ কয়েকজন বাড়িওয়ালা করোনাকালীন এই সময়ে ভাড়াটিয়া খুঁজে না পাওয়ার সংকটের কথা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন। তারা বলছেন, অনেক বাড়িওয়ালাই ভাড়ার টাকায় নিজেদের সংসার চালান। আবার ব্যাংকের ঋণও তাদের অনেককে দুর্ভাবনায় ফেলেছে।

তারা সবাই বলেছেন, এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে সরকারের দিক থেকে সহায়তার প্রয়োজন তাদের।

মহামারিতে বাড়িওয়ালারা কতোটুকু ক্ষতিগ্রস্ত? 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশজুড়ে গত তিনমাসের স্থবিরতায় সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী যারা হয়েছেন তাদের তালিকায় নেই বাড়িওয়ালারা।

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি ও সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক তানভীর সোবহান জানান, সাধারণত ভাড়া দেওয়ার সময় বাড়িওয়ালারা ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে দুই মাসের ভাড়া অগ্রীম নিয়ে রাখেন।

তিনি বলেন, "মহামারির কারণে সৃষ্ট মানবিক সংকটে স্বচ্ছল লোকেদের তাৎক্ষণিক লাভ ক্ষতির হিসাব করা উচিত না। তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের জায়গা থেকে ভাড়াটিয়াদের কষ্টের বিষয়ে আমাদের নজর দেওয়া উচিত।"

নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে মোহাম্মদপুরের চন্দিমা-উদ্যান ভবনের একজন ভাড়াটিয়া জানান, তিন মাসের ভাড়া বকেয়া থাকায় বাড়িওয়ালা কয়েকদফায় দারোয়ানকে পাঠিয়ে তাকে এবং তার পরিবারের সদস্যদের শাসিয়ে গেছেন।

৩০ বছর বয়সী এই ব্যক্তি রাজধানীর একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। বেতন পেলেই সময়মতো বাড়িভাড়া পরিশোধ করতেন বলে তিনি জানান।

"এপ্রিলে যখন আমাদের ফার্ম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়, তখন থেকেই আমার আয় বন্ধ হয়ে যায়," বলছিলেন তিনি। 

বকেয়া পরিশোধের জন্য বাড়িওয়ালা বারবার চাপ দিলেও নতুন করে অল্প ভাড়ায় যে অন্যকোথাও বাসা নেবেন সেই সুযোগও নেই এই ব্যাক্তির।

তিনি বলেন, "বাসার আমার বয়স্ক বাবা-মা, স্ত্রী এবং ছোটভাই থাকে। হঠাৎ করেই চাকরি হারিয়ে ফেলেছি। নতুন করে বাসা নিতে যে অ্যাডাভান্স দিতে হবে সেটাও আমার কাছে নেই। অন্যদিকে কখন আবার চাকরি পাবো সেটাও জানি না। তাই অন্যকোথাও যাওয়ারও সুযোগ এখন নেই।"

তিনি বলেন, সুযোগ থাকলে পরিবারের সদস্যদের খুলনায় তাদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন।

তার অনেক প্রতিবেশীও ইতোমধ্যে বাসা বদলে অন্য এলাকায় চলে গেছেন বলে তিনি জানান।

"আমি যে বাড়িতে থাকি সেখানে এখনো পাঁচ ছয়টা পরিবার আছে যারা ভাড়া পরিশোধ করতে পারেনি। বাড়িওয়ালাও সবাইকে বলে দিয়েছে, বকেয়া ভাড়া ও অন্যান্য বিল কয়েকদিনের মধ্যেই পরিশোধ করতে হবে।"

তার মতে, এই মুহুর্তে কিস্তিতে বকেয়া ভাড়া পরিশোধের সুযোগ থাকা উচিত।

গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোও অদূর ভবিষ্যতের ভঙ্গুর অর্থনীতির দিকটি তুলে ধরেছে তাদের নানা গবেষণায়। করোনার কারণে বেশি বিপদে পড়া সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সংকটের দিকটি স্পষ্ট থাকায়, বাড়িওয়ালাদের লাভ-ক্ষতির হিসাব চূড়ান্ত করতে সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদেরা।

তানভীর সোবহান বলেন, বর্তমান সংকট মোকাবিলা করতে বাড়িওয়ালা এবং ভাড়াটিয়া দুই পক্ষকেই একটা ভালো বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.