শ্রম সচিবের সঙ্গে পাটকল শ্রমিক নেতাদের বৈঠক ব্যর্থ, কর্মসূচি চলবে

অর্থনীতি

খুলনা প্রতিনিধি
29 June, 2020, 08:05 pm
Last modified: 29 June, 2020, 08:15 pm
‘আমরা তাকে বলেছি, আমাদের এক বছর সময় দেওয়া হোক, আমরা পাটকলগুলোকে লাভজনক করে দেখাব। কিন্তু তিনি আমাদের কথা শোনেননি।'

রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মঙ্গলবার দুপুর ২টা থেকে বুধবার দুপুর ২টা পর্যন্ত খুলনাঞ্চলের ৯টি জুট মিলের শ্রমিকরা পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি পালন করবেন। সোমবার রাজধানীর শ্রম ভবনে শ্রম সচিবের সঙ্গে পাটকল শ্রমিক নেতাদের বৈঠকে ফলপ্রসূ কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় তারা রাজপথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

খুলনার প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলের সিবিএ সভাপতি শাহানা শারমিন জানান, সোমবার দুপুরে ঢাকার শ্রমভবনে শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিবের বৈঠক ব্যর্থ হয়েছে।

তিনি বলেন, 'শ্রম সচিব আমাদের বলেছেন, শ্রমিকদের সম্পূর্ণ পাওনা পরিশোধ করে মিল বন্ধ করে দেওয়া হবে। তবে আমরা তাকে বলেছি, শ্রমিকদের জন্য মিলে লোকসান হয় না; যাদের কারণে লোকসান হয়, তাদের শাস্তি দেওয়া হোক। তাদের দায় শ্রমিকরা নেবে কেন?'

'আমরা তাকে বলেছি, আমাদের এক বছর সময় দেওয়া হোক, আমরা পাটকলগুলোকে লাভজনক করে দেখাব। কিন্তু তিনি আমাদের কথা শোনেননি। এ সময় শ্রম অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা পাটকল শ্রমিক নেতারা উপস্থিত ছিলেন', যোগ করেন শাহানা শারমিন।

তিনি বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মঙ্গলবার দুপুর ২টা থেকে বুধবার দুপুর ২টা পর্যন্ত পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। শ্রমিকরা নিজ নিজ মিলের সামনে পরিবার-পরিজন নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।

এদিকে, সোমবার দুপুরে খুলনা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারীত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলগুলো চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ ছাড়া মিলগুলোতে চলমান পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধান এবং পাটখাতকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে কর্মরত শ্রমিকদের গোল্ডেল হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে শতভাগ পাওনা পরিশোধ করা হবে।

এতে প্রধান অতিথি ছিলেন খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালকদার আব্দুল খালেক। সভাপতিত্ব করেন খুলনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন।

সংবাদ সম্মেলনে সিটি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রমিকদের ব্যাপারে অত্যন্ত আন্তরিক। শ্রমিকদের কথা চিন্তা করেই সরকার এ পর্যন্ত পাটকলগুলোতে ১০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'সরকারি-বেসরকারি অংশীদারীত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে মিলগুলোর আধুনিকায়ন করেই চালু করা হবে। সরকারের এ সিদ্ধান্তের ফলে মিলগুলো বন্ধ হবে না; আবার শ্রমিকও বেকার হবে না। কারণ পরবর্তীকালে এসব মিলে এ অঞ্চলের শ্রমিকদেরই কর্মসংস্থান অব্যাহত থাকবে।'

সংবাদ সম্মেলনে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন জানান, শ্রম আইন অনুযায়ী দুই মাস আগে, অর্থাৎ ৩০ জুন (মঙ্গলবার) সরকারের পক্ষ থেকে নোটিশ দিয়ে বিস্তারিত জানানো হবে। ইতোমধ্যে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সভায় এ ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, শ্রমিকদের সকল বকেয়া পাওনা ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ৪০ শতাংশ এবং বাকি ৬০ শতাংশ পাওনা টাকা পরবর্তী দুটি অর্থবছরে ৩০ শতাংশ করে পরিশোধ করা হবে। এছাড়া ২০১৪ সাল থেকে অবসরে যাওয়া শ্রমিকদের পাওনা এককালীন পরিশোধ করা হবে।

তিনি আরও বলেন, সরকারের এ সিদ্ধান্তের ফলে প্রতিটি শ্রমিক প্রায় সাড়ে ১২ লাখ থেকে ৫৪ লাখ পর্যন্ত টাকা পাবেন। মিলগুলো পরবর্তীকালে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারীত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে চালু হলে এসব মিলে কর্মরত দক্ষ শ্রমিকরাই নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন।

এর আগে রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে খুলনাঞ্চলের ৯টি পাটকলের শ্রমিকরা তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে নিজ নিজ মিলের সামনে দুই ঘণ্টা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল সিবিএ নন-সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের ডাকে সোমবার সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টা পযর্ন্ত এ কর্মসূচি পালন করা হয়। কর্মসূচিতে ১০ হাজারেরও বেশি শ্রমিক তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে নিজ-নিজ মিলের সামনে অবস্থান নেন।

এ ছাড়া আগামী ১ জুলাই (বুধবার) থেকে আমরণ অনশন পালনের ঘোষণা রয়েছে শ্রমিকদের।

অবস্থান কর্মসূচি পালনকালে শ্রমিকদের সন্তানদের হাতে ধরে রাখা প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, 'সোনালী আঁশের সোনার দেশ, আমলাদের কথায় করবেন না শেষ', "মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, পিতার চাকরির নিরাপত্তা ও দু'মুঠো ভাত চাই", 'সংগ্রাম বিনে হয় না মুক্তি, পাওয়া যায় না অধিকার', 'রাজনীতি যার যার, শ্রমিক শ্রেণি এক কাতার', 'প্রয়োজনে রক্ত দেব, তাও পাটকল বন্ধ হতে দেব না'সহ বিভিন্ন স্লোগান।

ক্রিসেন্ট জুট মিলের শ্রমিক আবু হানিফ হতাশ হয়ে বলেন, '২০১৩ সাল থেকে আমরা ঠিকমতো টাকা পাই না। টাকা পাওয়ার জন্য আন্দোলন করতে হয়। এখন নাকি বলছে, একবারে টাকা পরিশোধ করা হবে, কিন্তু এইটা আমরা বিশ্বাস করব কীভাবে? কারণ, এর আগের দেওয়া প্রতিশ্রুতিমতোও আমরা ঠিকভাবে টাকা পাইনি।'

প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলের শ্রমিক শামসুল আলম বলেন, 'আমরা শুনেছি, মিল বন্ধের এক বছরের মধ্যে ৪০ ভাগ, পরের বছর ৩০ ভাগ আর তার পরের বছর বাকি ৩০ ভাগ টাকা পরিশোধ করা হবে।'

'২০১৩ সাল থেকে আট হাজার ৯০০ শ্রমিক অবসরে গেছেন; তারাই টাকা পাননি। তাহলে আমরা চাকরিচ্যূতির পরে কীভাবে টাকা পাব? আমাদের একবার মিল থেকে বের করে দিতে পারলে আর মিলে ঢুকতে দেবে না। এরপর মিলের যে নতুন মালিক আসবেন, তিনি আমাদের নেবেন- তার কী নিশ্চয়তা আছে', প্রশ্ন রাখেন তিনি।

শামসুল আলম ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, এর আগে দু-তিনটি মিল সরকারি-বেসরকারি অংশীদারীত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে, তার একটাও চলেনি। সেখানে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার। তারা আজ পর্যন্ত টাকা পাননি।

এদিকে শ্রমিকদের অবস্থান কর্মসূচি চলাকালে পাটকল সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক সরদার আবদুল হামিদ বলেন, 'আমলাতন্ত্রের চক্রান্তে গত ২৫ জুন আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ব ২৫টি পাটকল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই ভ্রান্ত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতে তারা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন। ৩০ জুনের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না হলে ১ জুলাই থেকে শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করবেন।'

বিজেএমসির লিয়াজোঁ কর্মকর্তা বনিজ উদ্দিন মিঞা বলেন, 'মিল বন্ধের ব্যাপার আমরা এখনো সরকারি কোনো নির্দেশনা পাইনি। তবে, পিপিপি বাস্তবায়িত হলে খুলনা অঞ্চলের ৯টি জুট মিলের ৮ হাজার ১০০ জন স্থায়ী শ্রমিক চাকরি হারাবেন। তবে তারা সরকারি আর্থিক সুবিধা পাবেন। অবশ্য অস্থায়ী শ্রমিকেরা কোনো আর্থিক সুবিধা পাবেন না।'

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.