শীতের স্থায়িত্ব কমায় শাল বিক্রিতে ভাটা, হুমকির মুখে টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্প

অর্থনীতি

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি
25 November, 2019, 01:55 pm
Last modified: 25 November, 2019, 02:35 pm
এরই মধ্যে বাথুলী সাদী এলাকার শতাধিক তাঁত লোকসানে পড়ে পুঁজি হারিয়ে বন্ধ হয়েছে। বেকার হয়েছে তিন শতাধিক শ্রমিক ও মালিক...
  • টাঙ্গাইলে বাসাইল উপজেলার বাথুলী সাদী এলাকায় চাদর তৈরির তাঁতকল রয়েছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার।  আর এতে শ্রমিক সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার।
  • সারা বছর চাদর তৈরি করে পুরো ৯ মাস মজুদ রেখে শীতের সময় বিক্রি করতে হয়। এতে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ প্রয়োজন।
  • “এরই মধ্যে বাথুলী সাদী এলাকার শতাধিক তাঁত লোকসানে পড়ে পুঁজি হারিয়ে বন্ধ হয়েছে।  বেকার হয়েছে তিন শতাধিক শ্রমিক ও মালিক।”

টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার রূপচান পৈতৃক সূত্রে তাঁত ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাঁতে শাল বোনা হয়, আর শীতের মৌসুমে সেই শালগুলো চলে যায় দেশের বিভিন্ন বাজারে। কিন্তু সম্প্রতি তার তাঁতকল বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। কারণ হিসেবে তিনি জানান, পৈতৃক সূত্রে এ পেশায় জড়িত।  কিন্তু শীতের কারণে গত তিন-চার বছর ধরে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি কমেছে। এ কারণে শ্রমিকদের বেতনও দিতে পারছিলেন না। এভাবে চলতে থাকার এক পর্যায়ে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

রূপচানের মতো টাঙ্গাইলের আরও শত শত তাঁত ব্যবসায়ী বাধ্য হচ্ছেন তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে। এর কারণ, বৈশ্বিক উষ্ণায়ণের ফলে শীতের স্থায়িত্ব কমে যাচ্ছে, ফলে দিন দিন মানুষের কাছে চাহিদা কমে যাচ্ছে শালের।  

এভাবেই টাঙ্গাইলে শীতকে সামনে রেখে তৈরি করা শাল আর চাদর বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারছেন না তাঁতমালিকরা।

তাঁত শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, শীতের স্থায়িত্ব কম হওয়ায় অবিক্রিত পড়ে থাকছে শাল।  এমন বাস্তবতায় লোকসানে পড়ে অনেককে তাঁত কল পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে হয়েছে।    

বাংলাদেশে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়কে শীতকাল ধরা হলেও নভেম্বর থেকে শীত অনুভূত হতে থাকে।  

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড বেসিক সেন্টার টাঙ্গাইলের লিয়াজোঁ অফিসার রবিউল ইসলাম জানান, দেশে শীতের তীব্রতা না থাকায় শাল চাদর প্রস্তুতকারীরা গত কয়েক বছর ধরে লোকসানে পড়েছেন।  ২০১৭ সালে টাঙ্গাইলে ৫ লাখ ৬০ হাজার পিস শাল উৎপাদিত হয়েছে, যার আনুমানিক মূল্য ২০ কোটি ৪০ লাখ টাকা। সেবার তাঁতীরা ৯০ শতাংশ চাদর বিক্রি করতে পেরেছিলেন।

তিনি জানান, ২০১৮ সালে চাদর উৎপাদন হয় ৫ লাখ পিস, যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা। এর ২৫ শতাংশ অবিক্রিত রয়ে যায়। এ বছর প্রায় ৪ লাখ পিস চাদর উৎপাদন হয়েছে, যার আনুমানিক মূল্য ১৬ কোটি টাকা।  এ পর্যন্ত ২০ শতাংশ চাদর বিক্রি হয়েছে।  

টাঙ্গাইলে শালের প্রায় পুরোটাই বাসাইল উপজেলার বাথুলী সাদী এলাকায় উৎপাদিত হয়।  ওই এলাকায় চাদর তৈরির তাঁত রয়েছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার। আর এতে শ্রমিক সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার।   

ওই শ্রমিকরা মনিপুরি, পাট্টা, হাই চয়েজ, নয়ন তারা, ফ্লক প্রিন্টসহ প্রায় ২৫ ধরনের চাদর তৈরি করেন। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তারা কাজ করেন তারা।

বাথুলী সাদী এলাকার তাঁতমালিক লাল মিয়া জানান, সারা বছর চাদর তৈরি করে পুরো ৯ মাস মজুদ রেখে শীতের সময় বিক্রি করতে হয়।  এতে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ প্রয়োজন।

তিনি জানান, গত তিন বছর ধরে দেশে খুব একটা শীত পড়ছে না, যে কারণে  লোকসানে চাদর বিক্রি করতে হচ্ছে। আবার উৎপাদিত সব চাদর বিক্রির আগেই শীত ফুরিয়ে যায়।  ফলে প্রতিটি চাদর উৎপাদন খরচের চাইতে ৫০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করলেও লাভ থাকছে না।  

এ ব্যবসায়ী জানান, এরই মধ্যে লোকসানে পড়ে শতাধিক তাঁত বন্ধ হয়েছে।  পুঁজির অভাবে তারা এই তাঁত চালু করতে পারছে না।

একই এলাকার তাঁতমালিক বাদশা মিয়া বলেন, “দিন যতই যাচ্ছে, চাদর ব্যবসার প্রতি আমাদের আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে।  গত কয়েক বছরে লোকসান গুনতে গুনতে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি। আমার ঘরে বর্তমানে প্রায় ৫০ লাখ টাকার চাদর মজুদ রয়েছে।”

তিনি বলেন, “অন্যান্য বছর এই সময় প্রচণ্ড শীত থাকলেও এ বছর এখনও শীতের তেমন কোনো ভাব নেই।  গত তিন বছর যাবত আমাদের উৎপাদিত চাদর বিক্রি করতে না করতেই শীতের তীব্রতা শেষ হয়ে যায়, যে কারণে প্রতি বছরই লোকসানে পড়তে হচ্ছে আমাদের।”

টাঙ্গাইল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাধারণ সম্পাদক খান আহম্মেদ শুভ জানান, টাঙ্গাইল তাঁত শিল্পের জন্য বিখ্যাত হলেও এ শিল্পের প্রতি কোনও নজর দিচ্ছে না সরকার।  ফলে এই শিল্প টিকিয়ে রাখা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারিভাবে তাঁত মালিকদের স্বল্প সুদে ঋণসুবিধা এবং বিদেশে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।  

তিনি বলেন, “এরই মধ্যে বাথুলী সাদী এলাকার শতাধিক তাঁত লোকসানে পড়ে পুঁজি হারিয়ে বন্ধ হয়েছে।  বেকার হয়েছে তিন শতাধিক শ্রমিক ও মালিক।”

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.