লকডাউনে ভাগ্য খুলল অনলাইন ফুড ডেলিভারি সেবার
লকডাউন চলাকালে রেস্তোরাঁয় শুধুমাত্র ট্যাকঅ্যাওয়ে (খাবার নিয়ে যাওয়া) এবং হোম ডেলিভারি বা খাদ্য সরবরাহ সেবা চালু রাখার বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। ফলস্বরূপ, দিন দিন বাড়ছে খাদ্য পরিবহন বা অনলাইন ফুড ডেলিভারি পরিষেবার চাহিদা।
ফুডপান্ডা এবং পাঠাওয়ের মতো অনলাইন ফুড ডেলিভারি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যস্ত সময় পার করছে। সংশ্লিষ্টরা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়িক উল্লম্ফন প্রত্যক্ষ করছে।
তবে, একাধিক রেস্তোরাঁ মালিক জানান, তাদের পুরো ব্যবসার মাত্র ৫ শতাংশ অংশ জুড়ে আছে অনলাইন ফুড ডেলিভারি ব্যবস্থা। এছাড়া, ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন প্রদানের কারণে তারা বিশেষ লাভও করতে পারছেন না।
বেশ কিছু রেস্তোরাঁ ফুড ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরতা কমাতে নিজস্ব ডেলিভারি সেবা চালু করেছে। সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, রেস্তোরাঁগুলো এখন সরাসরি তাদের কাছে ডেলিভারি অর্ডার দিতে গ্রাহকদের উৎসাহিত করছে।
ফুড ডেলিভারির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রসঙ্গে গুলশানের ১৩৮ ইস্টের নির্বাহী পরিচালক আশফাক রহমান আসিফ জানান, "লকডাউনে গত এক সপ্তাহে অনলাইন ডেলিভারির সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।"
ফুডপান্ডা, পাঠাও, সহজ, হাংরি-নাকি, ই-ফুডের মতো সকল জনপ্রিয় ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানের সাথেই আসিফের রেস্তোরাঁর চুক্তি আছে। তবে তিনি জানান, "সশরীরে রেস্তোরাঁয় খাবার সুবিধা (ডাইন ইন-পার্সন) বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মহামারিতে টিকে থাকতে এই ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়।"
ধানমন্ডির ফ্যাটি বান বার্গার রেস্তোরাঁর প্রতিষ্ঠাতা তাহসিন রব বলেন, "অনলাইনে বিক্রি আমার পুরো ব্যবসার ৫ শতাংশের বেশি নয়। তবে, ৫ এপ্রিল থেকে নতুন লকডাউন ঘোষণার পর, ফুড ডেলিভারির চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে।"
"আমরা আমাদের নিজস্ব ডেলিভারি সেবা চালু করেছি, সেইসাথে উচ্চ কমিশন হারের জন্য কয়েকটি ডেলিভারি সেবা প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি বাতিল করেছি। এখন আমাদের কেবল হাংরিনাকি এবং সহজ ফুডের সাথে চুক্তি আছে," বলেন তিনি।
তাহসিন আরও জানান, স্থানীয় প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার কারণে গত সপ্তাহে তার রেস্তোরাঁ রাত ১০টার পর কোনো ফুড ডেলিভারি সেবা দিতে পারেনি।
সাধারণত, রাত ১০টার পর ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে।
সোমবার সরকারের জারি করা নতুন একটি নির্দেশনায় জানানো হয়, রেস্তোরাঁগুলো ১৪ এপ্রিল থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা এবং রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শুধুমাত্র টেকঅ্যাওয়ে এবং ফুড ডেলিভারি সেবা প্রদান করতে পারবে।
রোজার মাসে বাংলাদেশ রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতি (বিআরওএ) ইফতার ও সেহরীর সময় ডেলিভারি সেবা প্রদানের অনুমতি লাভের জন্য সরকারকে অনুরোধ জানানোর পর নতুন এই নির্দেশনা জারি করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সমিতির একজন নেতা জানান, "কমিশনের উচ্চ হার শেষ পর্যন্ত গ্রাহকদের উপর চাপ সৃষ্টি করে। কেননা, টিকে থাকতে রেস্তোরাঁ মালিকরা খাবারের মান নিয়ে আপস করেন।"
অন্যদিকে, রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ মোহাম্মদ আন্দালিব জানান, "বর্তমানে মানুষ অনলাইন ফুড অর্ডার এবং ডেলিভারি সেবার সাথে পরিচিত হওয়ায় বিষয়টি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।"
"খাতটি যেন দ্রুত বেড়ে উঠতে পারে সেজন্য ডেলিভারি প্রতিষ্ঠান এবং রেস্তোরাঁ সমিতির একত্রে কাজ করা উচিত," বলেন তিনি।
বিআরওএ'র সূত্র অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে রেস্টুরেন্টের সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। এর মধ্যে ঢাকায় রেস্টুরেন্টের সংখ্যা প্রায় আট হাজার। তবে, ডেলিভারি সুবিধা আছে এমন রেস্টুরেন্টের সংখ্যা ১০ শতাংশের বেশি না বলেও জানায় এই সূত্র।
ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় উল্লম্ফন
কোভিড-১৯ সংকটকালীন দেশব্যাপী লকডাউনে দিন দিন মানুষ খাদ্য ও মুদি পণ্যের জন্য হোম ডেলিভারি সেবার দিকে ঝুঁকছেন। ডেলিভারি সেবাপ্রদানকারীরা জানান, তাদের ব্যবসা প্রসার লাভ করছে।
ফুডপান্ডা বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা আমবারিন রেজা জানান, লকডাউনে অনলাইন ফুড ডেলিভারির চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, মাত্র এক সপ্তাহ অতিবাহিত হওয়ায় এখনই বৃদ্ধির হার হিসাব করার উপযুক্ত সময় আসেনি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ডেলিভারি সেবা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট বাজারের শীর্ষে আছে ফুডপান্ডা বাংলাদেশ। বর্তমানে দেশের ৬৪ জেলায় ফুডপান্ডা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রতিষ্ঠানটির ডেলিভারি কর্মীর সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার।
রেস্টুরেন্টের উপর উচ্চহারে কমিশনের বিষয়ে আমবারিন জানান, "বৈশ্বিকভাবে, অনলাইন ফুড ডেলিভারির উপর কমিশনের হার গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। বৈশ্বিক গড় মানের তুলনায় বাংলাদেশে এই হার কম। অথচ, আমরা একই মানের সেবা প্রদান করে থাকি।"
"আমরা ফুড টেকনোলজি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান। আমাদের মূল ব্যয় প্রযুক্তি, লজিস্টিকস এবং বিপণন ভিত্তিক। অ্যাপসহ ফুডপান্ডার প্রযুক্তি বিশ্বমানের। পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এখানে বিশাল বিনিয়োগের প্রয়োজন," বলেন তিনি।
আমবারিন রেজা আরও জানান, ফুডপান্ডা গত সাত বছর ধরে এই বাজারে টানা বিনিয়োগ করে আসছে, যা গ্রাহক, রাইডার এবং রেস্টুরেন্ট সহযোগীসহ সকল অংশীদারকে উপকৃত করেছে।
পাঠাও সভাপতি ফাহিম আহমেদ বলেন, "খাদ্য পরিবহন ব্যবসায় আমরা বিপুল সংখ্যক অর্ডার পরিলক্ষিত করেছি।"
"মহামারির সময় কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাদের রেস্টুরেন্ট এবং ফুড ডেলিভারি এজেন্টরা যেন কোনো বাধার সম্মুখীন না হন তা নিশ্চিত করতে পাঠাও ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে কাজ করছে," বলেন তিনি।
ডেলিভারি প্রতিষ্ঠান সহজ জানায়, কোভিড পূর্ব সময়ের তুলনায় বর্তমানে পুরো খাতেই অর্ডারের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে।
কমিশনের বিষয়ে প্রশ্ন রাখা হলে সহজ জানায়, "এই খাতে উচ্চহারে কমিশন নেওয়ার উদাহরণ থাকলেও, সহজ ফুড সবসময় তাদের অংশীদার, সরবরাহকারী ও ভোক্তাদের সাথে ন্যায্যতা নিশ্চিত করেছে।"
"রেস্টুরেন্ট মালিকদের সাথে খোলাখুলি আলোচনা এবং যথাযথ কেস স্টাডির মাধ্যমে আমরা সবসময় যৌথভাবে যুক্তিসংগত কমিশন রাখার চেষ্টা করেছি। ভবিষ্যতেও এর ব্যতিক্রম হবে না।"
ই-ফুডের বাণিজ্য উন্নয়ন প্রধান শাহনেওয়াজ জানান, "আমাদের অনলাইন ডেলিভারি সেবা এসময় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।"
সীমিত সময়ের প্রতিবন্ধকতা
লকডাউন চলাকালে কার্যক্রমের সময়সীমা বেঁধে দেওয়ায় এবং সংক্রমণ নিয়ে ক্রেতাদের মাঝে উদ্বেগের কারণে প্রত্যাশিত সংখ্যক অনলাইন অর্ডার পাচ্ছেন না বলে দাবী করেন কয়েকজন রেস্টুরেন্ট মালিক।
বনানীর কেএফডি রেস্তোরাঁর মালিক তৌফিক রহমান জানান, লকডাউন পূর্ব সময়ের তুলনায় বর্তমানে তাদের অনলাইন ডেলিভারি সেবা এবং বিক্রি এক-চতুর্থাংশ পর্যন্ত কমে গেছে।
চট্টগ্রামের ক্যাফে মিলানোর স্বত্বাধিকারী ইফাজ খান জানান, "নগরে আমার পাঁচটি রেস্তোরাঁর বিক্রিই কমে গেছে। মানুষ অনলাইনে অর্ডার করার বিষয়ে উদ্বিগ্ন। পাশাপাশি মানুষের ক্রয় ক্ষমত হ্রাস পেয়েছে।"
"দ্বিতীয় ঢেউ আসার আগ অবধি ডাইনিং ব্যবস্থা চালু থাকার সময় একটি রেস্টুরেন্টে দৈনিক দুই থেকে তিন লাখ টাকার বিক্রি হত। লকডাউনের ঠিক আগে বিক্রি ৭০ হাজারে নেমে আসে। বর্তমানে, অনলাইন ডেলিভারি ও টেক অ্যওয়ে মিলিয়ে দৈনিক ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকার বেশি বিক্রি হয় না," বলেন তিনি।
ইফাজ খান আরও জানান, চট্টগ্রামে প্রায় এক হাজার রেস্তোরাঁ আছে। এদের মধ্যে অন্তত ৫০ শতাংশ রেস্তোরাঁ অনলাইন ডেলিভারি সুবিধা প্রদান করে থাকে।