লকডাউনে কারখানা চলছে, তবে কমেছে উৎপাদন
গত বছরের লকডাউনে সব কল-কারখানা বন্ধ থাকলেও এবার কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দিয়েছে সরকার। স্থানীয় বাজারের উৎপাদনকারক বা রপ্তানিকারক- সবক্ষেত্রেই কারখানা খোলা রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
১৪ এপ্রিল থেকে রিটেইল আউটলেটগুলো বন্ধ থাকায় কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে স্থানীয় বাজারের জন্য পণ্য উৎপাদনকারী কারখানাগুলো। লকডাউন জারি হওয়ার পরই চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে।
নির্মাণকাজের উপকরণ থেকে শুরু করে ফার্নিচার, ইলেকট্রনিকস পণ্য থেকে অটোমোবাইল এবং পোশাক শিল্প, সব খাতেই উৎপাদন ও পণ্য সরবরাহ কমে এসেছে।
প্রাণ-আরএফএলের কারখানা থেকে এমনকি ভোগ্যপণ্যের সরবরাহও আগের তুলনায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল জানান, মুদি দোকানগুলো কম সময় খোলা থাকাতেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
লকডাউনের মধ্যে প্রাণ-আরএফএলের মতো ভোগ্যপণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে দৈনিক চালানও প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। সিটি গ্রুপের পরিচালক (ব্র্যান্ড) বিশ্বজিৎ সাহা জানান, এর ফলে প্রতিষ্ঠানটির কারখানার উৎপাদনও কমিয়ে আনা হয়েছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকান বেলা ৩টা পর্যন্ত খোলা থাকে, অন্যদিকে অন্যান্য পণ্যের খুচরা বিক্রেতাদের ব্যবসা বন্ধ গত এক সপ্তাহ ধরেই।
অনলাইনে বিক্রি চলছে, কিন্তু লকডাউনের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের খুচরা বিক্রির খাতে ই-কমার্সের ব্যবহার যথেষ্ট নয়, উল্লেখযোগ্য হারে এর বৃদ্ধি প্রয়োজন।
বেশ কিছু সংখ্যক উদ্যোক্তা ও করপোরেট নেতা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, ভোগ্যপণ্যের বিক্রি কমে আসায় অবিক্রীত মজুদ এড়াতে বেশিরভাগ উৎপাদনকারীই উৎপাদন কমিয়ে এনেছেন।
পাশাপাশি, কর্মঘণ্টা কমে আসায় খুচরা বিক্রেতাদের সব অর্ডারের চালান পাঠানোও কঠিন হয়ে উঠছে।
রপ্তানিমুখী শিল্পখাত ছাড়া, কোনো কারখানাই আগের মতো উৎপাদন করতে পারছে না। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, কম সক্ষমতা নিয়ে সুষ্ঠুভাবে কাজ চালানো সবার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
"হঠাৎ করে লকডাউন জারি হয়েছে, চাহিদা কমে আসা সত্ত্বেও সরবরাহ চালু রাখার দরজা খোলা আছে। লকডাউন জারি করতে হলে কারখানা ও দোকান সবক্ষেত্রেই একই নিয়ম প্রযোজ্য হওয়া উচিৎ। অন্যথায় উভয়ই চালু রাখতে দেওয়া উচিৎ," বলেন রিজওয়ান।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন কারখানাগুলো আংশিক উৎপাদন চালাতে পারছে, কারণ তাদের অর্থায়ন, সাপ্লাই চেইন অধিক শক্তিশালী, তাদের ওয়্যারহাউজও বড়। অন্যদিকে, ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলোর ওপরই বেশি প্রভাব পড়েছে। বেশিরভাগই কাজ বন্ধ রেখে শপিং মল ও দোকান খোলার অপেক্ষায় দিন গুনছেন।
তিন হাজারের বেশি বড় ও মাঝারি আকারের টেক্সটাইল কারখানা ও স্থানীয় বাজারের হাজার হাজার ছোট ও মাঝারি আকারের এন্টারপ্রাইজে লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, মহামারির সেকেন্ড ওয়েভের কারণে ব্যবসার বড় মৌসুম ইদুল ফিতর ও বাংলা নববর্ষের সময় স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে না পারায় আবারও বড়সড় বিপর্যয়ের মুখে পড়তে চলেছে কল-কারখানাগুলো।
"ইদের আগে কারখানাগুলো ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে। কিন্তু টানা দ্বিতীয় বছরের মতো মহামারির আঘাত পড়েছে এ খাতে। পাইকারি বা খুচরা- কোনো মার্কেটই খোলা নেই," বলেন খোকন।
"বড় কারখানাগুলো মূলত শ্রমিকদের কাজে রাখতেই কার্যক্রম চালু রেখেছে, অন্যদিকে ছোট কারখানাগুলোর এ সামর্থ্য নেই এবং ইতোমধ্যেই অনেকে উৎপাদন বন্ধ রেখেছে," যোগ করেন তিনি।
"অবিলম্বে শপিং মল ও দোকান খোলা না হলে বড় কারখানাগুলোও বন্ধ হয়ে আসবে।"
দেশের পাদুকা খাতেও একই ধরনের পরিস্থিতি বিরাজমান। কয়েক ডজন বড় ব্র্যান্ড ছাড়া প্রায় ৫০০ উৎপাদনকারক কোম্পানির বেশিরভাগই উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। বড় কোম্পানিগুলো অনলাইনে বিক্রি চালু রেখেছে। অন্যদিকে দেশজুড়ে এ খাতের প্রধান প্রধান কেন্দ্রগুলোর ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাতের (এসএমই) হাজার হাজার উৎপাদনকারী কোনো চালান ছাড়া দিন পার করছেন।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, বেশিরভাগ কারখানার আগের মজুদ পণ্যের সরবরাহ শুরু হয়নি এখনো। এই মৌসুমে তারা আগের বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আশা করছেন।
ইতোমধ্যেই অনলাইন পরিসরে চলে এসেছে দেশের অন্যতম বৃহৎ জুতার ব্র্যান্ড বাটা। কোম্পানিটির বৃহদাকার ওয়্যারহাউজও রয়েছে। তারপরও, এর বিক্রিতে লকডাউনের প্রভাব পড়েছে বলে জানান বাটার একজন কর্মকর্তা। অনলাইনে ১০-১২ শতাংশ বিক্রি হওয়ায়, কোম্পানির উৎপাদনও কমিয়ে আনা হয়েছে বলে জানান বাটা শু কোম্পানির কোম্পানি সচিব হাশিম রেজা।
রিটেইল আউটলেট বন্ধ থাকায় প্রায় সম্পূর্ণ স্থানীয় চাহিদা মেটানো ফার্নিচার ও হোম এপ্লায়েন্স খাতও একই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েছে। বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি সেলিম এইচ রহমান বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানার কাঠমিস্ত্রীদের কাজ বন্ধ আছে। সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসার আশায় কম ধারণক্ষমতা নিয়ে কাজ চালাচ্ছে বড় ব্র্যান্ডের কারখানাগুলো।
দেশের বৃহত্তম ফার্নিচার ব্র্যান্ড হাতিলের প্রতিষ্ঠাতা সেলিম আরও জানান, ইতোমধ্যে ৮০ হাজার ক্ষুদ্র ফার্নিচার প্রস্তুতকারক উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে।
বাংলাদেশ স্টিল ফার্নিচার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান এসকে মাসুদুল হক বলেন, লকডাউনের মাঝে ইস্পাতের উপকরণের সংকটে পড়েছেন তারা, বিক্রিও বন্ধ আছে।
ফলস্বরূপ, তাদের ৫০ হাজারের বেশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ফার্নিচার প্রস্তুতকারক কাজ বন্ধ রেখেছে, কর্মবিমুখ হয়ে পড়েছে কয়েক লাখ শ্রমিক।
লকডাউনের মধ্যেও মেগা নির্মাণ প্রকল্পগুলো চালু আছে, ফলে সিমেন্ট ও ইস্পাতের মতো নির্মাণকাজের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সংশ্লিষ্ট খাত তাদের উৎপাদন চালু রাখতে পারছে। তবে ডিলারদের খুচরা বিক্রি স্বাভাবিক সময়ে মোট বার্ষিক বিক্রির এক-তৃতীয়াংশ হলেও তা গত এক সপ্তাহে প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম, জানান বাংলাদেশ সিমেন্ট প্রস্তুতকারক সমিতির সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ।
তিনি আরও জানান, বিক্রি কমে যাওয়ায় অনেক কোম্পানি নির্দিষ্ট মাত্রায় উৎপাদন কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছে।
প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বলেন, তাদের কোম্পানির বিরাট অংশের গ্রাহক অবকাঠামো ও হাউজিং প্রকল্পের ক্রেতারা হওয়ায় তারা যথেষ্ট মাত্রায় উৎপাদন চালু রাখতে পেরেছেন। তবে, তার কোম্পানিও খুচরা বিক্রিতে লোকসানের মুখে পড়েছে বলে জানান তিনি।