রিফান্ডের জন্য ক্রেতাদের চেক ছেঁড়ার ভিডিও পাঠাতে বলছে ইভ্যালি
অগ্রিম টাকা নেওয়ার পর দীর্ঘসময়েও যেসব গ্রাহককে পণ্য না দিয়ে রিফান্ড চেক দিয়েছিল ইভ্যালি, তাদের অনেকের মোবাইল ফোনে কল করে চেকগুলো ছিঁড়ে ফেলে ছেঁড়ার ভিডিও পাঠাতে বলছেন কোম্পানিটির কর্মকর্তারা। যারা চেক ছিঁড়ে ভিডিও পাঠাবে, তাদের ব্যাংক একাউন্টে রিফান্ডের টাকা ডিপোজিট করা হবে বলে জানাচ্ছে ইভ্যালি।
যেসব কাস্টমারকে ইভ্যালি রিফান্ড চেক দিয়েছে, তাদের চেকগুলো ক্যাশ করা যাচ্ছে না। টেলিগ্রাম, হোয়াটঅ্যাপ ও ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারসহ বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়ায় গ্রাহকদের একাধিক গ্রুপ রয়েছে। ইভ্যালির কর্মকর্তাদের চেক ছেঁড়ার প্রস্তাব দেওয়ার মোবাইল কথোপকথনের রেকর্ড অনেক ক্রেতা এসব গ্রুপে শেয়ার করছেন। ক্রেতাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেলও সংযুক্ত রয়েছেন বলে জানা গেছে।
গ্রুপগুলোতে ক্রেতারা অভিযোগ করে বলেছেন, গত জানুয়ারি থেকে সাইক্লোন অফারে বাইক অর্ডার করে এখন পর্যন্ত ডেলিভারি না পাওয়া গ্রাহকদেরকে অগ্রিম তারিখ উল্লেখ করে দ্য সিটি ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকের রিফান্ড চেক দিয়েছিল ইভ্যালি। নির্ধারিত তারিখে ক্রেতারা যেন চেকগুলো ব্যাংকে জমা না দেন; সেজন্য গতমাসে ফোন করে তাদেরকে অনুরোধ করা হয়েছিল। তারপরও যেসব কাস্টমার চেক জমা দিয়েছে, তাদের বড় অংশই বাউন্স ও স্টপ পেমেন্ট হয়েছে বলে অনেক ক্রেতা অভিযোগ করছেন ।
ব্যাংকাররা জানান, সাধারণত, অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত ব্যালেন্স না থাকলে এবং একাউন্ট হোল্ডারের স্বাক্ষরে গড়মিল হলে চেকগুলো বাউন্স বা রিজেক্ট করা হয়। আর কারও নামে একাউন্টহোল্ডার চেক ইস্যু করার পর ওই চেক নম্বর ব্যাংকে পাঠিয়ে যখন পেমেন্ট করতে নিষেধ করা হয়, তখন ওই চেক জমা দিলেও ব্যাংক টাকা দেয় না। এটাকে স্টপ পেমেন্ট বলা হয়।
ক্রেতারা জানান, গত সোমবার থেকে ইভ্যালির কর্মকর্তারা কাস্টমারদের মোবাইল ফোনে কল করে তাদের নামে ইস্যু হওয়া চেক ছিঁড়ে- তার স্পষ্ট ভিডিও পাঠাতে বলছে নির্ধারিত কিছু হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে। যারা চেক ছিঁড়ে ভিডিও পাঠাবে, তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাওনা টাকা জমা দেওয়া হবে বলে জানাচ্ছেন তারা। যারা চেক ছিঁড়ে ভিডিও পাঠাবে না, তাদের পাওনা নিয়ে জটিলতা হবে বলেও সতর্ক করছেন ইভ্যালির কর্মকর্তারা।
ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল কাস্টমারদের চেক ছিঁড়ে ভিডিও পাঠাতে বলার কথা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের কাছে স্বীকার করেছেন।
তিনি বলেন, আমাদের মিডল্যান্ড ব্যাংকের একাউন্ট অফ আছে। তাই চেক রিপ্লেস না করে আরটিজিএস (রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট) করছি। যেসব কাস্টমার চেক ছিড়ে ভিডিও পাঠিয়েছে, আমরা তাদের সবাইকে রিফান্ড দিয়েছি। ভবিষ্যতে আগে কাস্টমারদের ব্যাংক একাউন্টে টাকা ডিপোজিট করবো, পরে চেক ছেঁড়ার ভিডিও পাঠাতে বলবো।
ইভ্যালির ক্রেতাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে সদস্য সংখ্যা ৫,৭০০ এরও বেশি। সেখানে অনেক ক্রেতা অভিযোগ করে বলছেন, পণ্য ডেলিভারি না করেও ইভ্যালির সফটওয়্যারে তা ডেলিভার্ড দেখানো হচ্ছে। আবার রিফান্ড না দিয়েও রিফান্ডেড দেখাচ্ছে। এ অবস্থায় চেক ছিঁড়ে ফেলার ভিডিও পাঠানোর পর কিছু গ্রাহককে ইভ্যালি রিফান্ড দিয়ে বাকিদেরও একই কাজে উদ্বুদ্ধ করার কৌশল নিতে পারে।
চেক ছেঁড়ার পর রিফান্ড না দিলে ইভ্যালির কাছ থেকে অর্থ আদায় করার মতো আইনি কোন নথি কাস্টমারদের হাতে থাকবে না। তখন রিফান্ড পাওয়া অনিশ্চিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
ক্রেতাদের এ উদ্বেগ সম্পর্কে জানতে চাইলে রাসেল বলেন, তারা যে আমাদের অর্ডার করেছে, সেটাই তাদের পক্ষে ডকুমেন্ট। এর পরে আমরা টাকা দেওয়ার পর চেক ছিঁড়তে বলবো। তাতে আমাদের কাজ কিছুটা বাড়বে। তখন অনেক কাস্টমার হয়তো চেক ছিঁড়তে চাইবে না।
কাস্টমারদের রিফান্ড না দেওয়া সত্ত্বেও ইভ্যালির সিস্টেমে তা রিফান্ডেড এবং পণ্য ডেলিভারি না দেওয়ার পরও ডেলিভার্ড দেখানোর অভিযোগ সম্পর্কে ইভ্যালি সিইও বলেন, ব্যাংকে বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক ফান্ডস ট্রান্সফার নেটওয়ার্ক (বিইএফটিএন) অনেক সময় একাউন্ট ভুল করে থাকলে বাউন্স হয়। রিফান্ড না হওয়া সত্ত্বেও রিফান্ডেড দেখানোর কোন ঘটনা আমাদের জানালে আমরা সমাধান করে দেই। অনেক সময় অটো সমাধান হয়।
"ডেলিভারি স্টেজে কুরিয়ারগুলোর সব ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) সিস্টেম অটোমেটেড না। যার কারণে একটা নির্দিষ্ট সময় পর ডেলিভার্ড মার্ক করা থাকে। এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ করলে আমরা তার আপডেট জানাই"- জানান তিনি।
সিটি ব্যাংকেও চেক প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে:
সময়মত পণ্য ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হয়ে মো. এঞ্জামুল আহসান গালিবকে গত ৫ জুলাই তারিখের পাঁচ লাখ টাকার দ্য সিটি ব্যাংকের চেক দেয় ইভ্যালি, যার নম্বর CB/CD: 2698716. ১৮ জুলাই চেকটি তিনি ব্যাংকটির খুলনা শাখায় জমা দিলে অপর্যাপ্ত তহবিল থাকার কারণে তা রিজেক্ট হয়।
শনিবার টিবিএসকে তিনি বলেন, এখনও তার চেকটি ক্যাশ করতে পারেননি।
কাস্টমারদের অভিযোগ, পর্যাপ্ত ব্যালেন্স না থাকায় গত ৩০ জুন থেকে ইভ্যালির দেওয়া শত শত চেক প্রত্যাখ্যান করতে থাকে সিটি ব্যাংক। আর ৫ জুলাই থেকে রিজেক্ট হওয়ার পাশাপাশি অনেক চেক স্টপ পেমেন্ট হচ্ছে।
চেক রিজেক্ট হওয়ার কারণ সম্পর্কে গত ২৫ জুলাই ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল ফেসবুক লাইভে বলেন যে, ব্যাংকগুলো ইভ্যালির অ্যাকাউন্ট ব্লকড করে রাখায় এই সমস্যা হচ্ছে। ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে এ সমস্যার সমাধান করা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইভ্যালির সিটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টটি (১৪৫২৮৮১০২৬০০১) ব্লকড হয়নি। তবে ওই অ্যাকাউন্টের প্রায় ৩৫ লাখ টাকা ব্যাংকটি লিয়েন এমাউন্ট হিসেবে রেখে দিয়েছে। গত ২ আগস্ট ইভ্যালির এই অ্যাকাউন্টে ব্যালেন্স ছিল ২০ হাজার টাকারও কম।
লিয়েন এমাউন্ট হলো যে পরিমাণ অর্থ ব্যাংক হোল্ড করে রাখে। ফ্রোজেন থাকায় লিয়েন স্ট্যাটাস সরানো না পর্যন্ত এসব তহবিল থেকে অর্থ উত্তোলন করা যায় না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে ইভ্যালির ১০টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মোট ব্যালেন্স ছিল ২০ কোটি ৪৯ লাখ ৪ হাজার ৭৩৯ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে গত ২২ জুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে সংবাদ প্রকাশের পর ইভ্যালিতে ক্রেতাদের অর্ডার ও অগ্রিম মূল্য পরিশোধ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়। অন্যদিকে, ক্রেতা ও মার্চেন্টরা পাওনা টাকার জন্য ইভ্যালিকে চাপ দিতে থাকে। ফলে আয়-ব্যায়ে ভারসাম্য হারিয়ে ব্যালেন্স সংকটে পড়েছে কোম্পানিটি।
আর্থিক সেবা দাতা প্রতিষ্ঠান নগদ- এর একটি সূত্র জানিয়েছে, "ইভ্যালির কাস্টমারদের দেওয়া রিফান্ড এক মাস ধরে বন্ধ থাকার পর গেল সপ্তাহে শুরু হলেও, রিফান্ডের অংক তেমন বড় পরিমাণের নয়।"
"ইভ্যালির সাম্প্রতিক টি-১০ ক্যাম্পেইন চলাকালে নগদের মাধ্যমে খুব কম পরিমাণ অর্থই রিফান্ড করা হয়েছে," বলে উল্লেখ করে সূত্রটি।
নগদ অর্থ উত্তোলন- তদন্ত করছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদক:
ইভ্যালির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে বিভিন্ন সময় নগদ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে, যা কোথায় খরচ হয়েছে, তা নিয়ে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'ইভ্যালি ডটকম লিমিটেডের ব্যাংক বিবরণীসমূহ হতে দেখা যায়, প্রায়শই নগদ অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে। বিবরণীসমূহ হতে ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের শ্যামলী শাখার ইভ্যালির হিসাব নম্বর ১৫১৪২০৪৪২২৯৪৯০০১ এর ১ জুলাই ২০২০ হতে ৩১ জুলাই ২০২০ এর মধ্যবর্তী সংগঠিত লেনদেনসমূহ পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এ ধরণের ১৮টি লেনদেনের অর্থ উত্তোলনকারীর তথ্য ব্যাংক হতে সংগ্রহ করা হয়েছে।'
'অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইভ্যালির হিসাবরক্ষক কর্তৃক এ সকল অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে এবং তার প্রদত্ত তথ্য মতে ইভ্যালি কর্তৃক ক্যাশে ভেন্ডর/মার্চেন্ট পেমেন্ট ও রিফান্ডের জন্য অধিকাংশ নগদ অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে। গ্রাহক কর্তৃক পরিশোধিত বিপুল অর্থ এভাবে নগদ উত্তোলন এবং ব্যয় ঝূঁকিপূর্ণ'- যোগ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও কেন্দ্রীয় ডিজিটাল সেলের প্রধান মো. হাফিজুর রহমান বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ইভ্যালি গ্রাহকদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে গ্রাহক ও মার্চেন্টদের পরিশোধ করতে পারে। কিন্তু ব্যাংক থেকে নগদ উত্তোলন করা অর্থ তারা কোথায়, কিভাবে ব্যয় করেছে, তা খুঁজে বের করতে দুর্নীতি দমন কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইভ্যালির কাছে গ্রাহক ও মার্চেন্টদের পাওনা প্রায় ৪০৪ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ইভ্যালির চলতি সম্পদের মূল্য মাত্র ৬৫ কোটি টাকা, যা দিয়ে এসব পাওনার মাত্র ১৬ শতাংশ পরিশোধ করা সম্ভব।
এসব তথ্য ইভ্যালিই বাংলাদেশ ব্যাংককে সরবরাহ করেছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব তথ্যের সঠিকতা যাচাই করতে কোম্পানিটির রেপ্লিকা ডাটাবেইজে প্রবেশের সুযোগ দেয়নি ইভ্যালি।
গ্রাহকদের কাছ থেকে ইভ্যালি ১৫ জুলাই পর্যন্ত মোট কতো টাকা নিয়েছে, মার্চেন্টদের কতো টাকা পরিশোধ করেছে এবং গ্রাহক ও মার্চেন্টদের পাওনার পরিমাণ- তা পরিশোধের পরিকল্পনা জানতে চেয়ে ইভ্যালিকে চিঠি দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এসব তথ্য জানানোর জন্য ৬ মাস সময় চেয়ে ফিরতি চিঠি পাঠিয়েছে কোম্পানিটি। এ অবস্থায় করণীয় নির্ধারণ করতে খুব শিগগিরই একটি কমিটি গঠন করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।