রপ্তানি খাতে নতুন সম্ভাবনা দেখাচ্ছে হাঁস  

অর্থনীতি

রফিকুল ইসলাম ও শওকত আলী
06 April, 2021, 12:40 pm
Last modified: 06 April, 2021, 03:04 pm
দেশের ভেতর একমাত্র রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেঙ্গল মিট প্রতিবছর ১০০০-১২০০ কেজি হাঁস মালদ্বীপে রপ্তানি করে থাকে।

দেশের রপ্তানি পণ্যের বহরে নতুন করে যুক্ত হয়েছে পোলট্রি শিল্পখাতের হাঁস, যার ক্রেতা মূলত বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা।  

চাহিদার প্রেক্ষিতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ মালদ্বীপে হাঁস রপ্তানি করছে বেঙ্গল মিট। দীর্ঘদিন ধরে গরুর মাংসের পাশাপাশি এখন হাঁসও রপ্তানি করছে প্রতিষ্ঠানটি।  

বেঙ্গল মিট ২০১৮ সাল থেকে হাঁস রপ্তানি করছে। প্রতিবছর ১০০০-১২০০ কেজি হাঁস রপ্তানি হয়। শীতকালে বেঙ্গল মিট ২০ টনের মতো হাঁস বিক্রি করে থাকে।  

দেশীয় মুরগীর মাংসও রপ্তানি হচ্ছে। প্রতিবছর দেশীয় মুরগী রপ্তানি হয় এক টন বা ১০০০ কেজি।

নিজেদের উৎপাদিত হাঁসের পাশাপাশি বিভিন্ন খামার থেকে হাঁস সংগ্রহ করে বেঙ্গল মিট। পালক ছাড়ানোসহ প্রক্রিয়াকরণের পর বিদেশে পাঠানো হয়। পরিমাণ বেশি না হলেও হাঁস রপ্তানিতে আশা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।   

বেঙ্গল মিটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এএফএম আসিফ বলেন, "মালদ্বীপে হাঁস রপ্তানি হয় তবে রপ্তানির পরিমাণ খুব কম।"

বেঙ্গল মিটের বাণিজ্যিক এবং রপ্তানি বিভাগের প্রধান একেএম সায়েদুল হক ভূঁইয়া দ্য  বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, "মালদ্বীপে যেসব লোকজন বসবাস করে, তাদের চাহিদার প্রেক্ষিতে ২০১৮ সাল থেকে সেখানে হাঁস পাঠানো হয়।" 

"প্রতিটা কন্টেইনারের সাথে ২০০-৩০০ কেজি হাঁস রপ্তানি করা হয়। রপ্তানির অংকটা খুব ছোট হলেও রপ্তানির যাত্রা শুরু হয়েছে, এটাই ইতিবাচক দিক", বলেন তিনি।

হাঁসের মাংস সুস্বাদু হলেও প্রক্রিয়াকরণ জটিলতায় অনেকে এড়িয়ে চলে। বিশেষ করে পালক ছাড়িয়ে খাবার উপযোগী করা সময়সাপেক্ষ ও জটিলও বটে। তবে শীতকালে গেট-টুগেদার বা বিভিন্ন পার্টিতে বাড়ে হাঁসের মাংসের চাহিদা। 

কষ্ট লাঘবে এখন বিভিন্ন সুপারশপে বিক্রি হচ্ছে 'রেডি টু কুক' হাঁস। এতে প্রক্রিয়া জটিলতা হ্রাস পাওয়ায় বেড়েছে খাদ্য হিসেবে হাঁস গ্রহণ। তবে হাঁসের বাজার ও ব্যবহারের সঠিক পরিসংখ্যান জানা সম্ভব হয়নি। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘরোয়া পরিবেশে হাঁস পালনের প্রচলন থাকলেও গত কয়েক বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাড়ছে হাঁস চাষ। স্বল্প পুঁজিতে হাঁস চাষে ঝুঁকছেন তরুণেরাও। শীতকালে দেশের নিম্নাঞ্চল বা হাওড় এলাকায় বাড়ছে হাঁস পালন।  

হাঁস পালন করা হয় মূলত মাংস ও ডিম উৎপাদনের জন্য। একটি হাঁস প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর ডিম দেয়, তারপর তা মাংস হিসাবে বিক্রি করা হয়। আবার শুধু মাংস উৎপাদনের জন্যও হাঁস পালন করা হয়। হাঁস উৎপাদনের শীর্ষ মৌসুম শীতকাল। খাল-বিল বা পুকুরে হাঁস পালন করা হয়।

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতে, দেশীয় হাঁসের ভেতরে রয়েছে নন-ডেস্ক্রিপ্ট, দেশী হোয়াইট, দেশী ব্ল্যাক, নাগেশ্বরী, সিলেট মেট প্রভৃতি জাত। একটু উন্নততর জাত হলো বিএলআরআই-১ এবং বিএলআরআই-২।  

খামারে খাকি ক্যাম্পবেল, ইন্ডিয়ান রানার, জেন্ডিং, মাসকোভি, হোয়াইট পেকিন, চেরি ভ্যালি, থাইল্যান্ড ব্ল্যাক ইত্যাদি বিদেশি জাতের হাঁস পালতেও দেখা যায়। 

রাজধানীর কাপ্তান বাজার ও অন্যান্য বাজারের পাখি বিক্রেতারা জানান, হাওর অঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলাসমূহ থেকে হাঁস আসে; বিশেষ করে কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, নওগাঁ, রংপুর এবং দিনাজপুর জেলা থেকেই হাঁস সংগ্রহ করা হয়। 

প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্য অনুসারে, দেশের পোল্ট্রি শিল্পের মধ্যে হাঁসের উৎপাদন হয়ে থাকে ১৬% অন্যদিকে মুরগির উৎপাদন হয় ৮৪%। 

তবে গত পাঁচ বছরে হাঁসের উৎপাদন প্রায় ১৫% বেড়েছে। এখন উৎপাদনের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৩%।

২০১৫-১৬ সালে ৫২২.৪০ লাখ হাঁসের উৎপাদন হয়। অথচ ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৯৭.১৭ লাখে।  

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের (ডিএলএস) তথ্যমতে, সারাদেশে নিবন্ধিত হাঁসের খামার ৮ হাজার ৮৬টি। নিবন্ধনের বাইরে আছে আরও প্রায় ৫০০-৬০০ খামার। 

ডিএলএসের হিসাবে, নিবন্ধিত খামারগুলো মূলত তিনটি শ্রেণীভুক্ত। প্রথম ক্যাটাগরিতে প্রতিটি খামারে ১০০১-৩০০০ হাজার, দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে ৩০০১-৫০০০ এবং তৃতীয় ক্যাটাগরির খামারে ৫ হাজারের বেশি হাঁস পালন করা হয়ে থাকে।

যেসব খামারে ১ হাজারের নীচে হাঁস পালন করা হয়, সেগুলো নিবন্ধনের বাইরে রয়েছে। 

ডিএলএসের উপ পরিচালক (খামার) ড. এ বি এম খালেদুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, "দেশব্যাপী হাঁসের মাংসের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খামারের সংখ্যাও ধীরে ধীরে বাড়ছে।" 

হাঁস রপ্তানির শীর্ষে বেঙ্গল মিট 

সুপারশপ বেঙ্গল মিট দেশের বিভিন্ন আউটলেটে বিক্রির পাশাপাশি মালদ্বীপ ‍ও কুয়েতে হালাল মাংস রপ্তানি করে।

প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর ১০০ টন গরুর মাংস ও ১০-১৫ টন মাটন রপ্তানি করে। আর দেশীয় জাতের মুরগীর মাংস রপ্তানি করে ১ টন। 

এছাড়াও ভ্যালু এডেড পণ্য যেমন বার্গার, বার্গার প্যাটি ও নাগেটের মত পণ্য রপ্তানি করে প্রায় ১০ টন। 

বেঙ্গল মিটের বাণিজ্যিক এবং রপ্তানি বিভাগের প্রধান একেএম সায়েদুল হক ভূঁইয়া টিবিএসকে বলেন, "হাঁস আমরা ছাড়া আর কেউ রপ্তানি করে না। শুরুতে কিছু সমস্যা ছিল, সবকিছু সমাধানের পর প্রতিটি কন্টেইনারের সঙ্গে ২০০-৩০০ কেজি হাঁসের মাংস পাঠানো হয়।"

তিনি বলেন, "বিদেশী কোনো ক্রেতার কাছ থেকে হাঁসের মাংসের অর্ডার পাইনি এখনো। চাহিদা থাকলে পণ্য দেওয়ার সক্ষমতা আছে। এখন দেশে হাঁসের খামার বাড়ছে। কাজেই চাহিদা থাকলে হাঁসের মাংস পাঠাতে সমস্যা হবে না।" 

তিনি বলেন, "হাঁসের মাংস উৎপাদনের সাথে মৌসুম জড়িত। শীতকালে হাঁসের উৎপাদন বেশি হয়। মাংসের গুণগত মানও ভালো থাকে। অন্যসময় তেমন মান থাকে না। স্থানীয় হাঁসের মাংসের চাহিদাও শীতকাল ছাড়া কমে যায়। গ্রীষ্মকালে একেবারেই কমে যায়। শীতকালে বেঙ্গল মিট ২০ টনের মতো হাঁস বিক্রি করে।" 

হাঁসের মাংস উৎপাদনের বৈশ্বিক বাজার

গ্লোবাল ট্রেড ম্যাগাজিন অনুসারে, ২০১৮ সালে বৈশ্বিক বাজারে হাঁস থেকে রাজস্ব আয় ছিল প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলার।  

এই সংখ্যাটি উৎপাদক এবং আমদানিকারকদের মোট রাজস্ব প্রতিফলিত করে শুধু (সরবরাহ ব্যয়, খুচরা বিপণনের ব্যয় ইত্যাদি চূড়ান্ত ভোক্তা মূল্যের অন্তর্ভুক্ত )। 

২০০৭ থেকে ২০১৮ সালে এ খাতে বাজার মূল্য বেড়েছে গড়ে বার্ষিক ২ দশমিক ১ শতাংশের ওপর। 

হাঁসের মাংস ভক্ষণকারী দেশ হিসেবে চীন রয়েছে সবার শীর্ষে  (৫.৫ মিলিয়ন টন), বিশ্বের ৭৬% হাঁস চীনেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। 

এরপরেই রয়েছে যথাক্রমে ফ্রান্স এবং মিয়ানমারের নাম। ২০০৭ থেকে ২০১৮ সময়সীমার ভেতর চীনে হাঁসের মাংস ভক্ষণের পরিমাণ বেড়েছে গড়ে বার্ষিক ২ দশমিক ২ শতাংশের ওপর। 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.