রপ্তানির নগদ প্রণোদনা বৈধ মনে করছে না এনবিআর

অর্থনীতি

12 September, 2021, 11:10 pm
Last modified: 13 September, 2021, 12:39 pm
সংশ্লিটরা বলছেন, নগদ সহায়তা বন্ধ করা হলে, শুরুতেই ক্ষতির মুখে পড়বেন তৈরি পোশাক খাত ও হোম টেক্সটাইলের রপ্তানিকারকরা। একইভাবে বন্ড সুবিধাপ্রাপ্ত রপ্তানিকারকরাও ক্ষতির মুখে পড়তে চলেছেন। 

দীর্ঘ আড়াই দশক ধরে রপ্তানিতে পাওয়া সরকারের নগদ সহায়তার সুবিধাপ্রাপ্ত তৈরি পোশাকসহ একাধিক খাতের বিদ্যমান এ সুবিধা বৈধ নয়- বলে মনে করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন- শুল্ক মূল্যায়ন এবং অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেট। 

সম্প্রতি এনবিআরে পাঠানো এক প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, যেসব রপ্তানিকারক ডিউটি ড্রব্যক সুবিধা নিয়েছে কিংবা ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধায় শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল ক্রয় করেছে, তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদ্যমান সার্কুলার অনুযায়ী বিকল্প নগদ সহায়তা পাওয়ার কথা নয়।

কিন্তু, বছরের পর বছর ধরে এই টাকা ওইসব রপ্তানিকারক 'আত্নসাৎ' করেছে। প্রতিবেদনে এ সুবিধা বন্ধে উদ্যোগ নিতে এনবিআরকে পরামর্শ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।  

রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নগদ সহায়তা বন্ধ করা হলে, শুরুতেই ক্ষতির মুখে পড়বে তৈরি পোশাক খাত ও হোম টেক্সটাইলের রপ্তানিকারকরা। একইভাবে বন্ড সুবিধাপ্রাপ্ত রপ্তানিকারকরাও ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন বলে আভাস পাওয়া গেছে। 

তৈরি পোশাক ছাড়াও, বর্তমানে প্রায় ৩৭টি খাত রপ্তানিতে ১-২০ শতাংশ নগদ সহায়তা পাচ্ছে।

নগদ সহায়তাপ্রাপ্ত রপ্তানিকারকরা বলছেন, এনবিআরের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের এ ব্যাখ্যা সমেত প্রতিবেদনটি যৌক্তিক নয়। একে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সার্কুলারের অপব্যাখ্যা উল্লেখ করে, এমন উদ্যোগকে এনবিআরের এখতিয়ার বহির্ভূত কাজ বলে মনে করছেন তারা। 

বন্ড লাইসেন্সহীন রপ্তানিকারকদের ব্যাক টু ব্যাক এলসি বাতিলের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এনবিআরের চিঠি এবং নগদ সহায়তার ইস্যুতে শিগগিরই তারা বানিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে এর সুরাহা চাইবেন বলে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন দেশের নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ- এর সিনিয়র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।

বিকেএমইএ'র পরিচালক ফজলে শামিম এহসান বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, যদি আমরাই বিকল্প নগদ সহায়তা নাই পাই, তাহলে পাবে কে? 

সরকার রপ্তানিকারকদের জন্য স্থানীয় কাঁচামাল ক্রয়ের উপর নগদ সহায়তা দিয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারও রয়েছে। ওই নিয়ম মেনে স্থানীয় উৎস থেকে কাঁচামাল ক্রয়ের উপর রপ্তানিকারকরা নগদ সহায়তা গ্রহণ করছেন। এনবিআরের সংশ্লিষ্ট বিভাগ অযৌক্তিক ব্যাখ্যার ওপর দাঁড়িয়ে এমন প্রতিবেদন দিয়েছে বলে মনে করেন তিনি। 

আমদানির পরিবর্তে স্থানীয় কাঁচামাল ও এক্সেসরিজ ব্যবহারকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে সরকার ৯০ এর দশক থেকে স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে পন্য রপ্তানির জন্য বিকল্প নগদ সহায়তা ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। বর্তমানে স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে তৈরি পোশাক রপ্তানির উপর ৪ শতাংশ নগদ সহায়তা রয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠিত বাজারের বাইরে নতুন বাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে বাড়তি নগদ সহায়তা ছাড়াও, করোনা পরিস্থিতিতে গত বছর সব ধরনের রপ্তানিতে নতুন করে এক শতাংশ করে বিশেষ নগদ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। 

এনবিআরের আলোচ্য প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের যে সার্কুলারের ভিত্তিতে এমন কঠোর অবস্থান নিয়েছে, ওই সার্কুলারে বলা আছে, বস্ত্র এবং পোশাক বা বস্ত্রজাত সামগ্রীর মধ্যে গ্রে-কাপড় ছাড়া অন্যান্য সামগ্রী রপ্তানির জন্য এ সুবিধা (ক্যাশ ইনসেনটিভ) প্রদেয় হবে, যদি এসব সামগ্রী বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) এর সদস্য মিল হতে সংগৃহীত সুতা দিয়ে দেশে উৎপাদিত হয়ে থাকে এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কোন পর্যায়ে ব্যবহৃত উপকরণের উপর ডিউটি ড্র ব্যাক বা শুল্ক বন্ড সুবিধা ভোগ করা না হয়ে থাকে। 

এ বিষয়টি আরো খোলাসা করে প্রতিবেদন প্রস্তুতের সঙ্গে যুক্ত এনবিআরের একজন ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএস'কে বলেন, ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল ক্রয়, ডিউটি ড্র ব্যাক সুবিধাপ্রাপ্তরা তো নয়ই, এমনকি বন্ড লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানও বিকল্প নগদ সহায়তা সুবিধাপ্রাপ্ত হবে না। এর অর্থ হলো, রপ্তানির সঙ্গে জড়িত পুরো পোশাক খাত, হোম টেক্সটাইল ও এর বাইরেও অন্য কিছু খাতও সরকারের নগদ সহায়তা পাবে না। 

আমদানিকারকের কাছ থেকে প্রাপ্ত মূল বা মাস্টার এলসির বিপরীতে লিয়েন ব্যাংক একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য (সাধারনত ৫০-৭০ শতাংশ) বাকীতে ক্রয় করার জন্য স্থানীয় বা বিদেশী সরবরাহকারীকে পুনরায় যে এলসি দিয়ে থাকে ব্যাক টু ব্যাক এলসি। 

আর কাঁচামাল ও এক্সেসরিজ শুল্কমুক্ত সুবিধায় এনে কাস্টমস বিভাগ নির্ধারিত গুদামে রেখে, তা দিয়ে পণ্য তৈরি করে রপ্তানির ব্যবস্থা হলো; বন্ডেড ওয়্যারহাউজ লাইসেন্স বা বন্ড লাইসেন্স। 

অন্যদিকে রপ্তানি পণ্যে ব্যবহার হওয়া কিছু কেমিক্যাল আমদানিকালে শুল্ক পরিশোধ হওয়ার পর নিয়ম মেনে ওই শুল্ক ফেরত পাওয়ার ব্যবস্থা হলো ডিউটি ড্র ব্যাক। 

রপ্তানিকারকরা বলছেন, এ সুবিধার পাশাপাশি রপ্তানিতে বিকল্প নগদ সহায়তার ফলে তৈরি পোশাকের মূল কাঁচামাল তুলা উৎপাদনকারী দেশ না হওয়া সত্ত্বেও, বাংলাদেশ বাঘা বাঘা পোশাক রপ্তানির দেশগুলোকে অবলীলায় হঠিয়ে দ্বিতীয় স্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছে। 

পোশাক খাতের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ'র সদস্যভুক্ত প্রায় তিন হাজার কারখানা রপ্তানির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এর বাইরে আরো প্রায় ৬০টি হোমটেক্সটাইল পণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান একই সুবিধা পান। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শতভাগ স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবহার করা প্রায় ৫০০টি প্রতিষ্ঠানের বন্ড লাইসেন্স নেই। 

এনবিআরের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এ প্রক্রিয়ায় কী পরিমাণ অর্থ রপ্তানিকারকরা নগদ সহায়তা হিসেবে পেয়েছেন, তার আংশিক পরিসংখ্যান বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া গেছে। তাতে দেখা গেছে, বিগত তিন বছরে ৩৫টি ব্যাংক ১ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা বিকল্প নগদ সহায়তা হিসেবে পরিশোধ করেছে। 

অর্থনীতিবিদ ও বর্তমানে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর টিবিএস'কে বলেন, স্থানীয় উৎস থেকে কাঁচামাল ক্রয়ের ক্ষেত্রে ডিউটি ড্র ব্যাক সুবিধা ও শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া গেলে, সেক্ষেত্রে ক্যাশন প্রণোদনা সুবিধা পাওয়ার কথা নয়। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে রয়েছে। সেই সার্কুলারের বলে এটি বন্ধ করা যায়, তবে অতীতে যা হয়েছে, তা নিয়ে টানাহেঁচড়া না করাই ভালো। 

রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন, স্থানীয় উৎস থেকে কাঁচামাল ক্রয়ে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে সরকার এ সুবিধা দিয়েছিল, যাতে স্ট্রং ব্যাংকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প গড়ে উঠে। এই সুবিধা দেওয়ার পর গত প্রায় আড়াই দশকে এর সুফলও মিলতে শুরু করেছে। স্থানীয়ভাবে তৈরি পোশাকের কাঁচামাল হিসেবে সুতা ও ফেব্রিকের বেশকিছু শিল্প গড়ে উঠে। 

বিটিএমএ'র দাবি, বর্তমানে দেশের নিটওয়্যার পোশাকের ৮০ শতাংশ, আর ওভেন পোশাকের ৪০ শতাংশ স্থানীয় টেক্সটাইল মিলগুলো সরবরাহ করতে সক্ষম। 

এনবিআর ও রপ্তানি খাতের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আলোচ্য রপ্তানিকারকদের বিকল্প নগদ সহায়তা বাতিলে ২০০৫ সালে একবার উদ্যোগ নিয়েছিল এনবিআর। ওই সময় আগের তিন বছরের নগদ সহায়তার টাকা ফেরত চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছিলো এনবিআর। তখন সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর বৈঠকে সাময়িক সুরাহা হলেও স্থায়ী সমাধান আসেনি। 

যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএস'কে বলেন, অর্থ ও বানিজ্যমন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো বসে এ ইস্যুটির স্থায়ী সমাধান করা দরকার। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের করণীয় খুব কম।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.