মুখ থুবড়ে পড়েছে কোটি কোটি টাকার সরকারি আগর প্রকল্প

অর্থনীতি

01 November, 2020, 12:30 pm
Last modified: 01 November, 2020, 12:37 pm
মৌলভীবাজারের আগর আতর, বর্তমানে দুবাই, কুয়েত, বাহরাইন, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কাতার, ওমান, ইয়েমেনসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।  বছরে প্রায় ৪শ কোটি টাকার আগর আতর বিদেশে রপ্তানি হয়। যদিও এই বছর করোনার জন্য তা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের আগর আতরের প্রচুর চাহিদা আছে মধ্যপ্রাচ্যে কিন্তু চাহিদার বিপরীতে জোগান দেয়া যাচ্ছে না।

চায়ের দেশ মৌলভীবাজারের অন্যতম শিল্প আগর আতর, জেলার বড়লেখার সুজানগরসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে আরও ৫০ থেকে ৬০টি আগর আতর কারখানা।  তবে ৩শ এর মত কারখানা থাকলেও বন বিভাগ বলছে ১৭৬টি কারখানা এখন পর্যন্ত নিবন্ধন নিয়েছে। শত শত কোটি টাকার আগর আতর বিক্রি হয় বিভিন্ন দেশে। 

৩শ বছর পূর্বেও আগর আতরের অস্তিত্ব পাওয়া যায় বিভিন্ন ইতিহাসবিদের বইয়ের সূত্রমতে। তবে বাণিজ্যিক ভাবে আগর আতর উৎপাদন বা এর বিস্তার ঘটে ১৯৪০ সালের দিকে।  মধ্যে অনেকবার মুখ থুবড়ে পড়ে এই শিল্প, বিশেষ করে  ৯০'র দশকে কাঁচামালের সংকটে এই শিল্প বন্ধ হবার উপক্রম হয়। 

সম্ভাবনাময় এই রপ্তানি খাতকে রক্ষা করতে বন বিভাগ এগিয়ে আসে। পতিত, অনাবাদী জমিতে নতুন আগর বন সৃষ্টি ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১৯৯৮ এবং ২০০৬ সালে সরকার দুটি প্রকল্প গ্রহণ করে। এর আওতায় সিলেট ও চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে আগর বাগান তৈরি করা হয়। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বর্তমানে মাত্র ৫০ভাগ বাগান টিকে আছে। আর এজন্য বনবিভাগ ও সামাজিক বনায়নের উপকারভোগীরা একে অন্যকে দায়ি করছেন।

বন বিভাগসূত্র জানায়, ১৯৯৮ সালে 'পাইলট প্রজেক্ট ফর আগর প্লান্টেশন' নামে পরীক্ষামূলক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সারাদেশে পাঁচ হাজার হেক্টর নতুন বন সৃজন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১৫ কোটি ১৩ লক্ষ টাকা। সিলেট চট্টগ্রাম ও পার্বত্য জেলার বনভূমিতে ১৯৯৮-২০০৪ অর্থ বছরে ২ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ৭৮৫ দশমিক ৬৭ হেক্টর জমিতে আগর বাগান সৃজন করা হয়। এরমধ্যে সিলেটে ১০ হেক্টর, হবিগঞ্জে ১০২ হেক্টর, মৌলভীবাজারে ২১২ দশমিক ১৬ হেক্টর, চট্টগ্রামে ২৮১ দশমিক ৯২ হেক্টর, কক্সবাজারে ১৮৮ দশমিক ৯২ হেক্টর আর রাঙামাটিতে ৫ হেক্টর। জুন ২০০৬ সালে এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। মেয়াদ শেষে কী পরিমাণ জমিতে গাছ লাগানো হয়েছিলো এবং কতো টাকা ব্যয় হয়েছিলো বিস্তারিত তথ্য দিতে পারেনি বনবিভাগ।

এই প্রকল্পের আগে মৌলভীবাজারে ২১২ দশমিক ১৬ হেক্টর দেখানো হলেও বর্তমানে বাগানের পরিমাণ ১৫৫ দশমিক ১৬ হেক্টর। যা আগের চেয়ে প্রায় ৫৭ হেক্টর কম। এরমধ্যে মৌলভীবাজারের জুড়ি রেঞ্জে ১৯৯৯-২০০৩ অর্থবছরে ২৭ হেক্টর, বড়লেখা রেঞ্জে ২০০১-২০০৫ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ৩৩ হেক্টর, কমলগঞ্জের রাজকান্দি রেঞ্জে ১৯৯৯-২০০৩ বছরে ৩৫ হেক্টর, কুলাউড়া রেঞ্জে ২০০৩-২০০৪ বছরে ৫ হেক্টর, শ্রীমঙ্গল রেঞ্জে ১৯৯৯-২০০৫ সাল বছরে ৬৩ দশমিক ৮৩ হেক্টর। অর্থাৎ ১৯৯৯- ২০০৫ সাল পর্যন্ত মোট ১৫৫ দশমিক ১৬ হেক্টর দেখানো হয়েছে যা পূর্বের তথ্যের সাথে মারাত্মক গড়মিল।

দ্বিতীয় প্রকল্প

২০০৬ সালের জুলাই মাসে আগরের দ্বিতীয় প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। পাঁচ বছর মেয়াদী এই প্রকল্প শেষ হওয়ার সময়সীমা ঠিক করা হয় ২০১১ সালে। এই প্রকল্পের আওতায় সিলেট বন বিভাগের অধীনে মৌলভীবাজারে মোট ৬৬৫ হেক্টর জমিতে আগর লাগানো হয়। এরমধ্যে জুড়ি রেঞ্জে ২০০৮-২০০১১ অর্থ বছরে ১৮৯ হেক্টর, বড়লেখা রেঞ্জে ২০০৭-২০১১ অর্থ বছরে ১৭৯ হেক্টর, কমলগঞ্জের রাজকান্দি রেঞ্জে ২০০৮-২০১১ অর্থ বছরে ২০৭ হেক্টর, মৌলভীবাজার রেঞ্জে ২০০৮-২০১১ অর্থ বছরে ৮০ হেক্টর, কুলাউড়া রেঞ্জে ২০০৮-২০০৯ অর্থ বছরে ১০ হেক্টর।

এই আগর প্রকল্পও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধুকতে শুরু করে। ফলে দেদারছে গাছ চুরি হতে থাকে, অনেক জায়গায় স্বল্পসময়ে আয়ের লক্ষ্যে আগর বাগান উজার করে লেবু চাষ শুরু হয়। এ ফলে এখন অর্ধেকেরও কম বাগান টিকে আছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক সিলেট বন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ১৯৯৮ সালের প্রকল্পটি ছিলো পরীক্ষামূলক। আর ২০০৬ সালের প্রকল্পের বেশিরভাগ ছিলো সামাজিক বনায়নের আওতায়। তাঁর দাবি বর্তমানে ৭০ভাগ বাগান টিকে আছে। বাগান তৈরিতে কতো টাকা ব্যয় হয়েছিলো জানতে চাইলে তিনি বলেন বর্তমানে ১ হেক্টর জমিতে বনায়নের জন্য প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। আগরের ক্ষেত্রেও হিসেবটা প্রায় কাছাকাছি। তবে আগে খরচ কম ছিলো।

সম্প্রতি মৌলভীবাজারের কয়েকটি আগর বাগান ঘুরে দেখা গেছে, আগর বাগানে ইচ্ছে মতো অন্য গাছ লাগানো হয়েছে। অনেক বাগানে এখন আগর গাছের অস্তিত্বও নেই। বাগানে জুড়ে লেবু গাছের ঝাড়। বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের আওতায় বানানো আগর বাগানের বেশিরভাগই ধ্বংস হয়ে গেছে।

বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষ বিভাগের তথ্যমতে, তাদের অধীনে ২০০৬ সালের প্রকল্পের আওতায় মৌলভীবাজার সদর রেঞ্জ, শ্রীমঙ্গল এবং হবিগঞ্জের সাতছড়ি রেঞ্জ মিলে মোট ৪২৫ হেক্টর জমিতে আগর বনায়ন করা হয়। মৌলভীবাজারের দুটি রেঞ্জে ৩১০ হেক্টরের বাগান করা হয়। এরমধ্যে কালাছড়া বিটে ১৩০ হেক্টর, চাউতলী বিটে ৬০ হেক্টর এবং বর্ষিজোড়ায় ১২০ হেক্টর। এরমধ্যে ১৩ লাখ ২০ হাজা টাকা ব্যয়ে বর্ষিজোড়া ক্যাম্পে লাগানো আগর বাগানটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হিসেবে উল্লেখ করছেন তারা। তাদের দেওয়া তথ্য মতেই এই বাগানে আর কোন আগর গাছ অবশিষ্ট নেই। আর বাকি বাগানের  মধ্যে মাত্র ৩০ ভাগ টিকে আছে। 

আগর বাগান উজারের বিষয়ে বন কর্মকর্তারা জানান, সামাজিক বনায়নের ক্ষেত্রে বাগান পরিচর্যা করেন উপকারভোগীরা। স্বল্পসময়ে বেশি লাভের জন্য এখন তারা লেবুর চাষ করছে। সেক্ষেত্রে বন বিভাগের কোন দায় ছিলো কিনা জানতে চাইলে তারা জানান চারা রোপণের দু'বছর পর্যন্ত পরিচর্যার জন্য বন বিভাগের বাজেট থাকে। পরবর্তীতে তাদের তদারকির অভাবে উপকারভোগীরা নিজেদের মতো বাগান ধ্বংস করে লেবু চাষ করেছেন।

তবে উপকারভোগীরা দায়ি করছে বনবিভাগকে। শ্রীমঙ্গলের কালাপুর এলাকার বাসিন্দা বাগানের উপকারভোগী হারিস মিয়া ও ফারুক হোসেন বলেন, বন বিভাগের যে পরিমাণ চারা রোপণের কথা ছিলো সে পরিমাণ তারা রোপণ করেনি। তাছাড়া চারা রোপণের পরেই অনেক চারা মারা যায়। সেখানে পূণরায় চারা রোপণ না করায় জায়গা খালি পড়ে ছিলো। সেইসব খালি জায়গায় তারা সাথী ফসল হিসেবে লেবুসহ ফলের গাছ লাগিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, চারা লাগানোর পর বন বিভাগ তাদের কোন ধরনের সহায়তাই করেনি। আগর গাছের যা কিছু টিকে আছে তা তাদের কারনে। 

বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের শ্রীমঙ্গল রেঞ্জের কর্মকর্তা মোনায়েম হোসেন বলেন, লেবু সাথী ফসল নয়। বন বিভাগ আগর বা অন্যান্য বনায়নে সাথী ফসল হিসেবে আদা, হলুদ মরিছের মতো ছোট ফসলকে সাথী বা সহায়ক ফসল হিসেবে অনুমতি দেয় যা মুল গাছ বা বাগানের কোন ক্ষতি করে না। কিন্তু আগর বাগানের উপকারভোগীরা সেটা মানেনি।

বনবিভাগের জানায়, প্রতি হেক্টর আগর বাগান সৃজনের জন্য তখন ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ হাজার টাকা। সে হিসেবে দুটি প্রকল্পের আওতায় মৌলভীবাজারে মোট ১১৮৭ হেক্টর জমিতে চারা লাগাতে (রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বাদে) খরচ হয় প্রায় ১ কোটি ৩১ লক্ষ টাকা। প্রাকৃতিকভাবে ১২-১৫ বছরে আগর গাছ উৎপাদন উপযোগী হয়। পূর্ণ বয়স্ক ১টি গাছ থেকে ৯ ঘন ফুট কাঠ পাওয়া যাবে যা থেকে ২৫ গ্রাম আতর উৎপাদন হয়। এক তোলা (১১.৬২ গ্রামে তোলা) আগর বিক্রি হয় ছয় থেকে সাত হাজার টাকায়। তেল আহরণের পরে কাঠও বিক্রি হয়। প্রতি কেজি সাধারণ কাঠ ১০০ থেকে ৫০০ টাকায়। পূর্ণবয়স্ক একটি গাছের ন্যূনতমমূল্য ২০ হাজার টাকা। প্রতি হেক্টর জমিতে আড়াই থেকে তিন হাজার চারা লাগানো হয়। সেই হিসেবে পনেরো বছর পর প্রতি হেক্টর জমির গাছের মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৫ কোটি টাকা।

সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকরতা এসএম সাজ্জাদ হোসেন জানান, সামাজকি বনায়নের শর্তটাই হচ্ছে উপকারভোগীরা বন রক্ষায় কাজ করবে বন বিভাগের সাথে। তারা আগর বাগানরে জায়গায় অন্য কিছু করতে পারেন না। আমরা কাগজপত্র পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।  

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ থেকে বিশেষ করে মৌলভীবাজারের আগর আতর, বর্তমানে দুবাই, কুয়েত, বাহরাইন, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কাতার, ওমান, ইয়েমেনসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।  বছরে প্রায় ৪শ কোটি টাকার আগর আতর বিদেশে রপ্তানি হয়। যদিও এই বছর করোনার জন্য তা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের আগর আতরের প্রচুর চাহিদা আছে মধ্যপ্রাচ্যে কিন্তু চাহিদার বিপরীতে জোগান দেয়া যাচ্ছে না। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.