মাছ চাষে শীর্ষে থেকেও রপ্তানিতে পিছিয়ে বাংলাদেশ

অর্থনীতি

হোসাইন শাহীদ, ময়মনসিংহ
27 July, 2020, 05:25 pm
Last modified: 27 July, 2020, 05:31 pm
মাছ চাষে গুণগত মান ঠিক রাখতে পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা মাছ নিয়ে তাদের বৈশ্বিক প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশ করেছে। 'দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ এন্ড অ্যাকুয়াকালচার ২০২০' শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বাদু পানির উন্মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ আহরণে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়। ২০১৮ সালে আহরিত মাছের পরিমাণ ছিল ১.২২ মিলিয়ন টন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চাষকৃত মাছ উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এই উৎস থেকে ২০১৮ সালে উৎপাদিত মাছের পরিমাণ ২৪ লাখ পাঁচ হাজার ৪০০ টন। ২০১৭ সাল থেকে এ অবস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।

প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, উৎপাদনে শীর্ষদের ঘরে থাকলেও সেরা দশ রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় নেই বাংলাদেশের নাম। আহরণে ১৮ নম্বরে ও চাষকৃত মাছ উৎপাদনের তালিকায় চার নম্বরে থাকা ভিয়েতনাম বিশ্বে মোট রপ্তানির পাঁচ শতাংশ একাই করে থাকে।

অন্যদিকে আহরণ ও উৎপাদন, দুই ক্ষেত্রেই মাছ উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থানে থেকে বিশ্বের মোট রপ্তানির চার শতাংশ করে থাকে ভারত।

এ ছাড়া স্বাদু পানি থেকে আহরণ ও চাষ করে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে থাকা দেশও রয়েছে শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশের তালিকায়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে গত ৮ জুন। দুই বছর পর পর সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে।

রপ্তানিতে পিছিয়ে থাকলেও গত পাঁচ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে বেড়েছে মাছের উৎপাদন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে মাছ উৎপাদন হয়েছে ৩৬ লাখ ৮৪ হাজার টন, ২০১৫-১৬ তে ৩৮ লাখ ৭৮ হাজার টন, ২০১৬-১৭ তে ৪১ লাখ ৩৪ হাজার টন, ২০১৭-১৮ তে ৪২ লাখ ৭৭ হাজার টন এবং ২০১৮-১৯ সালে ৪৩ লাখ ৮১ হাজার টন।

মাছের গুণাগুণ, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার নিয়ে গবেষণা করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. মাহফুজুল হক।

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে পাঙ্গাসের উৎপাদন ছিল চার লাখ ৫৩ হাজার ৩৮৩ টন। যার বাজার মূল্য সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। আর তেলাপিয়ার উৎপাদন ছিল তিন লাখ ৮১ হাজার ২১৫ টন, যার বাজার মূল্য প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা।

তিনি বলেন, মাছ চাষে আমরা ভিয়েতনামের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করি। কারণ এই দুই দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি জলবায়ু কাছাকাছি। পাঙ্গাস মাছ ভিয়েতনাম ব্যাপক হারে চাষ করে। তাদের উৎপাদিত মাছ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। ২০১৯ সালেই  ভিয়েতনাম শুধু পাঙ্গাস রপ্তানি করে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে। তাদের রপ্তানিকৃত মাছের পরিমাণ ছিল আড়াই লাখ টন। 

''তারা তাদের পণ্যের মান ঠিক রাখছে। তাই দিন দিন তাদের রপ্তানি আয় বাড়ছে। অপরদিকে তেলাপিয়ার আর্ন্তজাতিক বাজার রয়েছে। ২০১৮ সালে ৪৪৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে চীন। অথচ আমরা বিশ্বে তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ স্থানে থেকেও রপ্তানিতে যেতে পারছিনা'', যোগ করেন তিনি। 

মাছ নিয়ে কাজ করা এই শিক্ষক আরও জানান, বাংলাদেশে শুধু চিংড়ি মানসম্মত উপায়ে উৎপাদন হয় তাই আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের চিংড়ির চাহিদা ও সুনাম দুটিই আছে। যদি চিংড়ির ক্ষেত্রে আমরা সফল হই তাহলে অন্যান্য মাছের ক্ষেত্রে না পারার কোনো কারণ নেই। 

''এখন আমাদের চাষি আছে, সঙ্গে মাছ চাষের পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা রয়েছে। শুধু মাছ চাষের পদ্ধতি নিয়ে জাতীয় গাইড লাইন প্রয়োজন। যে গাইড চাষীদের মেনে চলতে হবে। সরকার তা কঠোরভাবে মনিটর করবে। তাহলে মাছ হতে পারে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত'', বললেন প্রফেসর ড. মাহফুজুল হক।

ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত ভারগো ফিস এন্ড এগ্রো প্রসেস লিমিটেড এর এজিএম, সৈয়দ সাইদুজ্জামান বলেন, দিন দিন বাড়ছে মাছের উৎপাদন। এমন বাস্তবতায় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস খাত নিয়ে দেখা দিচ্ছে অপার সম্ভাবনা। আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে দেশেই এখন গড়ে উঠছে ফিস প্রসেসিং প্লান্ট। তবে সেই সম্ভাবনা বাস্তবে রুপ নেয়াটাই এখন বড় চেলেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে এসব প্রসেসিং প্লান্টের জন্য। মাছের মানের প্রশ্নে শুরুতেই হোচট খাচ্ছেন উদ্দোক্তারা। 

তিনি জানান, গত দুই বছরে আমরা ইংল্যান্ড, নেদারলেন্ড, বেলজিয়ামসহ কয়েকটি দেশে প্রায় ৬০ কোটি টাকার মাছ রপ্তানি করেছি। এর মধ্যে চিংড়ি ৫০ কোটি টাকা এবং বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির চাষের মাছ ১০ কোটি টাকা। 

''আমাদের সমস্যায় পড়তে হয় মাছের মান নিয়ে। আমরা এখন মাছ সংগ্রহের সময় ফার্মের ব্যাবস্থাপনার দিকে নজর দেই। মানসম্মত মাছ উৎপাদন বাড়ানো গেলে গার্মেন্ট সেক্টরের পর এই খাত থেকেই আসবে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা'', যোগ করেন তিনি। 

একই এলাকার সেভেন ওয়েশেন ফিস প্রসেসিং লিমিটেডের এজিএম সেলিম উল্লাহ জানান, পাঙ্গাস মাছের রংয়ের জন্য আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। দেখা গেছে, আমরা যে পাঙ্গাস আন্তর্জাতিক বাজারে নিয়ে যাচ্ছি তা একটু হলদেটে বা লালচে। অপরদিকে ভিয়েতনাম আনছে সাদা পাঙ্গাস। গ্রাহক ভিয়েতনামেরটাই পছন্দ করছে। তাই দেশে প্রচুর পাঙ্গাস উৎপাদন হলেও মানের জন্য রপ্তানি করতে পারছি না।

মৎস অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস খাতের অবদান জিডিপিতে ৩.৫০ শতাংশ ও কৃষিখাতে অবদান ২৫.৭১ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬৮ হাজার ৯৩৫ টন মাছ ও মৎস্যজাত দ্রব্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে চার হাজার ৩০৯.৯৪ কোটি টাকা। এই রপ্তানি আয়ের বড় অংশই এসেছে চিংড়ি থেকে। 

আন্তর্জাতিক বাজারে পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া মাছের রয়েছ ব্যাপক চাহিদা। দেশের পুকুরে চাষকৃত মাছের অন্যতম দুটি জাত পাঙ্গাস, তেলাপিয়া। অন্যান্য মাছ উৎপাদনকারী দেশ এই মাছ রপ্তানি করে আয় করছে কোটি কোটি ডলার। আর আমাদের দেশের ভেতরেই চাষকৃত এই মাছ দুটির প্রতি ক্রমেই আগ্রহ হারাচ্ছে ভোক্তারা। 

দেখতে হলদেটে ও দুর্ঘন্ধ যুক্ত হওয়ায় বদনাম রয়েছে পাঙ্গাস মাছের। রপ্তানি দূরে থাক, দেশের বাজারেই হুমকির মুখে মাছটি। আর তেলাপিয়া উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থস্থানে বাংলাদেশ, বলছে মৎস অধিদপ্তর। 

প্রতি বছর উৎপাদন বাড়লেও এই দুই মাছে কেন আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে পারছেনা বাংলাদেশ, তা জানতে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মোট চার বছর ডেনমার্কের আর্থিক সহায়তায়, আপগ্রেডিং পাঙ্গাস এন্ড তেলাপিয়া ভ্যালু চেইনস ইন বাংলাদেশ' (ব্যাংফিস) নামে গবেষণা চালিয়ে এর কারণ বের করেছেন গবেষকরা। 

কথা হয় ওই গবেষক দলের সঙ্গে। তাদের একজন ডেনমার্ক কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব প্লান্ট এন্ড এনভাইরনমেন্ট সায়েন্স বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড. নাইলস্ ও জি জরগেনসেন।

তিনি বলেন, আমরা গবেষণায় পেয়েছি মাছের জন্য যে খাবার তৈরি করা হচ্ছে সেই খাদ্য উপাদানে ভুট্টার ব্যবহার বেশি রয়েছে। এই ভুট্টার কারণে পাঙ্গাস মাছের গায়ে রং হলদেটে হচ্ছে। যদি খাবারে ভুট্টার বদলে সয়াবিনের ব্যবহার বাড়ানো যায় তাহলে এই সমস্যা আর থাকবে না।

''আমরা দেখেছি পুকুরের পানি ব্যবস্থাপনায়ও সমস্যা রয়েছে। যেসব বড় ফার্ম রয়েছে তাদের পানির সমস্যা কম। তবে মাঝারি ও ছোট ছোট ফার্মগুলোতে পুকুরের পানিতে অক্সিজেনের সমস্যা রয়েছে। অ্যামোনিয়ার পরিমাণও বেশি। মানসম্মত মাছ উৎপাদন করতে হলে পুকুরের পানির গুনাগুণ বজায় রাখতে হবে। গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে চাষে'', যোগ করেন তিনি।

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার স্বর্ণালি ফিস ফার্মের মালিক আবদুল হাই বলেন, আমরা মাছের খাদ্যের জন্য খাদ্য উৎপাদনকারী কোম্পানির উপর নির্ভরশীল। তারা খাদ্যে কোন উপাদান কতটুকু ব্যবহার করে সাধারণ চাষিরা তা কমই জানে। যা দেয় আমরা তা-ই খাওয়াই। তবে বড় চাষীরা অনেকে নিজেদের মাছের খাবার নিজেরাই তৈরি করে থাকে।

গবেষক দলের আরেকজন কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড এন্ড রিসোর্স ইকোনমিক্স বিভাগের প্রফেসর ম্যাক্স নিলসেন। 

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া রপ্তানির সুযোগ আছে বাংলাদেশের। এটি নির্ভর করছে চাষী ও সরকারের ইচ্ছার উপর। কারণ যেসব দেশ এসব মাছ আমদানি করে তারা চায় তাদের ভোক্তাদের জন্য মানসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে। তাই তারা জানতে চায় কীভাবে মাছ চাষ করা হচ্ছে। 

''সেখানকার পরিবেশ কেমন, কী কী উপাদান মিশ্রিত খাবার মাছকে খাওয়ানো হচ্ছে। তারা যা আমদানি করবে তা যেন তাদের ঠিক করে দেওয়া মানের হয়। মান যাচাইকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে'', জানালেন ম্যাক্স নিলসেন।

মাছের গুনাগুণ কীভাবে নষ্ট হচ্ছে তা আরও জানতে কথা হয় বাংলাদেশ মৎস গবেষণা ইনস্টিটিউটের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. খলিলুর রহমানের সঙ্গে। 

তিনি জানান, বেশিরভাগ চাষী অধিক লাভের আশায় অল্প পানিতে বেশি মাছ চাষ করেন। আর এই বেশি মাছকে খাওয়াতে গিয়ে অতিরিক্ত খাদ্য ফেলা হয় পুকুরে। এই অতিরিক্ত খাদ্যের অবশিষ্ঠাংশ পুকুরের মাটি ও পানিতে মিশে একধরনের প্লাংটন তৈরি করে। যা মাছের শরীরের মিশে বাজে গন্ধ হয়। 

তিনি বলেন, মাছের সঠিক চাষ পদ্ধতি চাষীদের জানতে হবে। আর চাষীকেও সচেতন হতে হবে। 

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রিকালচার ফিন্যান্স বিভাগের প্রফেসর ড. আখতারুজ্জামান খান বলেন, দেশের সর্বত্রই মাছ চাষ বিস্তার লাভ করছে। তবে রপ্তানির দিক চিন্তা করে পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া চাষের ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যাবস্থা নিতে হবে। 

''যদি সরকার এই চাষের ক্ষেত্রে দেশের অঞ্চল ভেদে বিশেষ বিশেষ জোন তৈরি করে তাহলে মানসম্মত মাছ উৎপাদন ও রপ্তানি সহজ হবে'', যোগ করেন তিনি।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহা পরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলছেন পাঙ্গাস, তেলাপিয়া বিদেশে রপ্তানি করতে পারলে নতুন দিগন্তের উন্মচন হবে। এই লক্ষ্যে সরকার এখন গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। চাষিদের আমরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, মাঠ পর্যায়ে মৎস অধিদপ্তর কাজ করছে। রপ্তানির বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেখে। তবে মান ও গুণে চিংড়ির আন্তর্জাতিক বাজারে সুনাম অর্জন করেছে। আমাদের রপ্তানির বড় অংশই চিংড়ি। অন্যান্য মাছের ক্ষেত্রেও আমাদের সুনাম রয়েছে। এখন প্রয়োজন মৎস সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে যে পদ্ধতিতে মাছ চাষের পরামর্শ দিচ্ছে, নিজেদের প্রয়োজনেই চাষীদের তা মানতে হবে। আর বাকি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবশ্যই সরকার করছে। 

তিনি জানান, বর্তমানে বছরে দেশে ৪১ লাখ টন মাছের চাহিদা রয়েছে। সে চাহিদা পূরণের পর প্রতিবছর প্রায় দুই লাখ টন মাছ উদ্বৃত্ত থাকে।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.