মহামারির ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি হাইওয়ে রেস্তোরাঁগুলো

অর্থনীতি

30 August, 2021, 03:10 pm
Last modified: 30 August, 2021, 04:58 pm
একদিকে দূরপাল্লার বাসের যাত্রী অনেক কমে গেছে, অন্যদিকে চলতিপথে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার ব্যাপারে তাদের আগ্রহও কম।

লকডাউন বা সরকারি বিধি নিষেধ তুলে নিলেও করোনায় সংকটে পড়া হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোর ব্যবসার নাজুক হাল এখনো কাটেনি। লাখ লাখ টাকা ভর্তুকি দিয়ে চালাচ্ছে হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান। করোনা পরিস্থিতিতে রেস্টুরেন্টের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বেতনও অর্ধেক করা হয়েছে। প্রায় সবগুলো রেস্তোরাঁয় কর্মচারীর সংখ্যাও ছাঁটাই করে অর্ধেকে নামিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে কুমিল্লার জনপ্রিয় রেস্তোরাঁ ছন্দুর কথা ধরা যাক। প্রায় ৪০ বছর আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার পদুয়ার বাজারে এ রেস্তোরাঁ প্রতিষ্ঠা করেন আবদুর রাজ্জাক ছন্দু। একটি খুপরি ঘরে পরোটা, গরুর মাংস, সিঙাড়াসহ টুকটাক নাস্তা তৈরি করতেন তিনি। বেশি স্বাদ, খাবারের মান ভালো ও মহাসড়কের পাশে তেমন কোনো রেস্তোরাঁ  না থাকায় এটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ভালো লাভ হওয়ায় খুপরি ঘর একসময় টিনশেড ঘর ও পরে পাকা ঘরে রূপ নেয়।

ছন্দু মিয়া মারা যাওয়ার পর ২৭ বছর আগে এ রেস্তোরাঁর দায়িত্ব পান তার ছেলে ইকবাল আহমেদ। ৪০ শতক জায়গার ওপর অবস্থিত এ রেস্তোরাঁর বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৩০ কোটি টাকা। কখনও কখনও ৮০-১০০ মণের বেশি গরুর মাংস বিক্রি হতো এখানে। কুমিল্লার মানুষ ছাড়াও মহাসড়ক দিয়ে দূর-দূরান্তে ভ্রমণ করা মানুষের পছন্দের রেস্তোরাঁ ছন্দু। শহরের মানুষরাও আয়েশ করে গরুর মাংস, আলুর ভর্তা খেতে ভিড় জমায় এখানে। 

কিন্তু করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর বদলাতে থাকে এখানকার দৃশ্যপট। বর্তমানে এ রেস্তোরাঁয় পাঁচ মণ গরুর মাংসও বিক্রি হয় না। বরং মালিকের শখ করে পোষা ৭০টি গরুর ৫৯টি বিক্রি করে দিয়ে টিকিয়ে রাখতে হয়েছে রেস্তোরাঁটিকে।

ছন্দু হোটেলের স্বত্বাধিকারী ইকবাল আহমেদ বলেন, 'এ রেস্তোরাঁয় স্বাভাবিক সময়ে মাসে গড়ে দুই কোটি টাকা বিক্রি হতো। সবার বেতন-খরচ বাদ দিয়ে লাভ হতো দুই লাখ টাকার বেশি। কিন্তু এখন লোকসানের মধ্য দিয়ে দিন পার করতে হচ্ছে।'

তিনি আরও বলেন,'পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ায় দিন দিন আয় কমে আসে। এদিকে ৬৫ জন কর্মচারীর বেতন-খাবার মিলিয়ে মাসে দশ লাখ টাকা বাড়তি খরচ। এ বিপুল টাকার জোগান দিতে গিয়ে একপর্যায়ে কম দামে ৫৯টি গরু বিক্রি করে দিই। কর্মচারী ছাঁটাই না করলেও টেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এখন লাভ নেই। জোড়াতালি দিয়ে কোনোরকমে চালিয়ে নিচ্ছি।'

ইকবাল আহমেদ কর্মচারী চাকরিচ্যুত না করলেও মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে অবস্থিত দুই শতাধিক রেস্তোরাঁ ও রিসোর্টে কর্মচারী ছাটাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। তেমনই একটি প্রতিষ্ঠান নূরজাহান হোটেল। ৯০-এর দশকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পদুয়ার বাজারে প্রতিষ্ঠিত এ রেস্তোরাঁয় বিয়ে, জন্মদিনের অনুষ্ঠান, কনফারেন্স, বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বা নানা প্রোগ্রামের আয়োজন হতো। করোনা পূর্ববর্তী সময়ে এখানে কর্মী ছিলেন ৩৫০ জন। বর্তমানে মাত্র ৮৪ জন কর্মরত।

নূরজাহান হোটেলের স্বত্বাধিকারী রিপন আহমেদ বলেন,'ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি ও অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি ছিল আমাদের। বর্তমানে বাসের যাত্রী অনেক কমে গেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোও চুক্তি বাতিল করেছে। এ সময়ে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে আমাদের। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি প্রশিক্ষিত কর্মী হারিয়ে। আমরা যাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি, এমন কর্মীদের মধ্যে অনেকেই ভিন্ন পেশায় চলে গেছেন।'

'টাকার অংকে আমাদের ১০ কোটি টাকার বেশি লোকসান হলেও কর্মী হারিয়ে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। মহাসড়কের পাশে টাইমস স্কয়ারসহ আরও একটি রেস্তোরাঁ ছিল আমার। ওইগুলো বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিয়েছি,' যোগ করেন তিনি।

জানা যায়, প্রায় ১২০ শতক জায়গার ওপরে স্থাপিত হোটেল নূরজাহানের বর্তমান বাজারমূল্য ৯০ কোটি টাকারও বেশি। হোটেলটি তিন তলা। এখানে বাংলা খাবার ছাড়াও প্রবাসীদের জন্য আলাদাভাবে খাবার তৈরি করা হতো। আছে থাকার ব্যবস্থাও। পাশাপাশি এখানকার মিষ্টিরও কদর ছিল। দিনে ২০-২৫ লাখ টাকার মতো বেচাবিক্রি হতো (হোটেল, কনফারেন্সসহ)।  বর্তমানে কোনোমতে টিকে আছে প্রতিষ্ঠানটি।

বারবার লকডাউনের কারণে রেস্তোরাঁ বন্ধ , দূরপাল্লার বাস ও গণপরিবহন চলাচলে সীমাবদ্ধতা, পরিবহন চললেও যাত্রী সংকট, আবার যাত্রীদের রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়ার প্রবণতা কমে আসায়, কুমিল্লার মহাসড়ক অংশে গড়ে ওঠা রেস্তোরাঁ ও রিসোর্টগুলোর প্রায় ছয় হাজার কর্মী ছাঁটাই হয়েছেন। বন্ধ রয়েছে ৩০ শতাংশ রেস্তোরাঁ। ন্যূনতম ক্ষতি হয়েছে ৫০০ কোটি টাকা। কুমিল্লা জেলা দোকান মালিক সমিতি ও কুমিল্লা হাইওয়ে রেস্তোরাঁ মালিক সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, মহাসড়কের কুমিল্লা অংশের দৈর্ঘ্য ১০৪ কিলোমিটার। দেশের অন্যতম ব্যস্ততম এ সড়ক দিয়ে যাতায়াত করা যায় চট্টগ্রাম, ঢাকা, ফেনী, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জ জেলায়। মহাসড়কের নানা অংশ হয়ে দেশের অন্যান্য প্রান্তে সড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়ক প্রবেশ করেছে। যার কারণে খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর ও নোয়াখালী যাতায়াতের ভায়া রুট হিসেবেও ব্যবহৃত হয় এই মহাসড়ক। দেশের রাজধানী, বাণিজ্যিক রাজধানীর মধ্যবর্তী স্থান এবং বিবির বাজার স্থলবন্দর ও কুমিল্লা ইপিজেডসহ অন্যান্য উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠানের পণ্য, কাঁচামাল পরিবহনের প্রধান রুট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। তাছাড়াও চট্টগ্রাম বিভাগের সর্ববৃহৎ কাঁচাবাজার কুমিল্লার নিমসারে, যা মহাসড়ক লাগোয়া। পাশপাশি মাছ ও সবজি উৎপাদনে কুমিল্লা দ্বিতীয়। যার কারণে বিপুল মানুষের যাতায়াত থাকে কুমিল্লায়। 

মহাসড়কের মাঝামাঝি অবস্থিত হওয়ার কারণে দূরপাল্লার বেশিরভাগ বাসের যাত্রাবিরতি ঘটে কুমিল্লায়। এসব কারণে দারুণ ব্যস্ত থাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও মহাসড়ক লাগোয়া রেস্তোরাঁ এবং রিসোর্টগুলো।

বড় বড় রিসোর্ট ও ফুড ভিলেজগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি সূত্র জানায়, বড় ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করা বেশিরভাগ কর্মীর বাড়ি কুমিল্লা জেলার বাইরে। তাই প্রথমেই তারা চাকরি হারিয়েছে। ছাটাইয়ের পর প্রতিষ্ঠানগুলো কুমিল্লার স্থানীয় কিছু লোকবল ধরে রেখেছে। 

দূরপাল্লার ভ্রমণে যাত্রাবিরতিতে তারা জলযোগ ও খাবার গ্রহণের জন্য থামা বাসগুলো  বিভিন্ন হোটেলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। মূলত বাসের চালক-হেলফারদের বিনামূল্যে খাওয়ানোর পাশাপাশি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেওয়া হয় বাস মালিকদের। যার বিনিময়ে তারা যাত্রাবিরতি দেন ওই হোটেল-রেস্তোরাঁয়। এসবের মধ্যে আছে হোটেল নূরজাহান, হক ইন, হোটেল হাইওয়ে ইন, গ্রিন ভিউ, ফুড প্যালেস, অফ বিট, ডলি রিসোর্ট, রয়েল হোস্ট, মায়ামী, মিয়ামী, নূর মহল, হোটেল রুফটপ, জমজম, ব্লু ডায়মন্ড, বিটা ওয়ার্ল্ড, তাজমহল, সৌদিয়া, খন্দকার, আম্মাজান, মাতৃভান্ডার হোটেল অ্যান্ড সুইটস-সহ আরও বেশ কয়েকটি। বাস মালিকদের সাথে চুক্তি নেই, কিন্তু মহাসড়কের ব্যস্ততম রেস্তোরাঁর মধ্যে আছে কফি হাউজ, জিহান ও হোটেল ময়নামতি। মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে এমন বড় হোটেল-মোটেল ও রেস্তোরাঁ আছে ৭০টির বেশি। মাঝারি ও ছোট মানের আছে আরও ১৫০টির মতো।

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় হোটেল হাইওয়ে ইন। মহাসড়কে যাত্রাবিরতিতে হোটেল হাইওয়ে ইনের কদর রয়েছে বেশ। কিন্তু করোনায় দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এখন ঋণের টাকায় চলছে।

হোটেল হাইওয়ে ইনের জেনারেল ম্যানেজার শাহ আলম জানান, তারা এ পর্যন্ত ৪০ লাখ টাকা ঋণ করেছেন। ৮৪ জন কর্মচারীর বেতন দিয়ে লাভ তো দূরের কথা, এটিকে চালিয়ে নিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।

আরেক প্রতিষ্ঠান ডলি রিসোর্ট। এটি চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেড় কোটি টাকা চুক্তিতে নেওয়া হয়। মাসে আরও দেড় লাখ টাকা ভাড়া দিতে হতো। নতুন বছরে নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও শুরুতেই ধাক্কা খায় রিসোর্টটি। তাই প্রথম দিকে ৬৫ জন কর্মী নিয়ে শুরু করলেও গত লকডাউনের শুরুতে  ২০ জনকে চাকরিচ্যুত করেন তারা। মালিকানায়ও আসে পরিবর্তন।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশের রেস্তোরাঁ-রিসোর্টগুলোর ৩০ শতাংশ বন্ধ  আছে। মায়ামী রিসোর্টের জেনারেল ম্যানেজার উজ্জ্বল রায় বলেন, 'করোনায় আমাদের দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ এক লাখের কাছাকাছি। তবে মানবিক কারণে আমরা কর্মীদের চাকরিচ্যুত করিনি।'

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মী জানান, এখানে লোকবল ছিল ১১৫ জন, বর্তমানে কর্মরত ৬৫ জন।

কুমিল্লা জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আলী জানান, 'বাসে যাত্রী ৬০ শতাংশ কমে গেছে। অনেক যাত্রী রেস্টুরেন্টে বসে খেতে চান না। তাই চুক্তি থাকলেও কখনও কখনও রেস্টুরেন্টের সামনে যাত্রাবিরতি দেওয়া হয় না।'

হাতিকুমরুল মোড় এলাকায়ও একই চিত্র

উত্তরাঞ্চলের মধ্যে হাইওয়ে রেস্তোরাঁর জন্য সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল মোড় এলাকা বিখ্যাত। কারণ, সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর উপর দিয়ে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬ জেলা এবং খুলনা বিভাগের কয়েকটি জেলার দূরপাল্লার বাসসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচলা করে। যমুনা সেতুর সংরক্ষিত তথ্য মতে, এই সেতুর উপর দিয়ে ২৪ ঘণ্টায় সাধারণ সময়ে অন্তত ২৫ হাজারের বেশি যানবাহন চলাচল করে।

উত্তরাঞ্চল কিংবা দক্ষিণের সবগুলো গাড়ি যাত্রাবিরতি দেয় সাধারণত দেয় সাধারণত হাটিকুমরুল মোড়ের কয়েকটি হোটেল বা রেস্টুরেন্টে। এখানে 'ভিআইপি' মানের একাধিক রেস্টুরেন্ট গড়ে ওঠেছে যাত্রীদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে। এসব রেস্টুরেন্টে ভাত, মাছ, মাংস, মিষ্টি থেকে দই শুরু করে সব রকমের খাবার মেলে। এ কারণে প্রতিটি যানবাহন (ঢাকাগামী-নিজ অঞ্চলগামী) প্রায় হাটিকুমরুল এলাকায় যাত্রা বিরতি দেয়। এ কারণে এখানকার অর্থনৈতিক লেনদেনও খুব জোড়ালা। সারারাত সমানতাহলে চলে এখানকার হোটেলগুলো। দূরে ঝিঁঝিঁপোকার ডাক কিংবা অন্ধকার ছাড়া মানুষের আনাগোনা দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে রাত হয়েছে। হোটেল আর রেস্টুরেন্টে মানুষের উপচে পড়া ভিড় থাকে সব সময়। এর সঙ্গে জীবন-জীবিকার পথও খুলেছে অনেকে। লাখ লাখ টাকা লেনদেন হয় প্রতিদিনে।  

হোটেল-রেস্তোরাঁয় বাস থামানোর বিষয়ে বিশেষ নীতি অনুসরণ করা হয়। এক্ষেত্রে চালকদের ১০ টাকার বিনিময়ে তিনজনকে খাবারও দেওয়া হয় কোনো রেস্টুরেন্টে। কেউবা আবার খাবার ফ্রি দেয়, সঙ্গে ৫০ টাকা মোবাইলে ফ্লেক্সিলোড। অনেক রেস্টুরেন্ট আবার বাস চালক-সহকারিকে গামছা-লুঙ্গি উপহার দেয়। তবে ঈদের সময় গিফটের ছড়াছড়ি লাগে। মোট কথা চালকদের সাথে সম্পর্কের উপরও রেস্টুরেন্টে বাস থামানোর বিষয়টি নির্ভর করে।

কিন্তু পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে বিশ্বকে নাজেহাল করা করোনাভাইরাস। বাংলাদেশে করোনা ব্যাপকভাবে হানা দেওয়ার পর সরকার বিভিন্ন বিষয়ে উপর বিশেষ বিধিনিষেধ আরোপ করে। তার মধ্যে অন্যতম হলো পরিবহন খাত। যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ আনা হয়। এক পর্যায়ে লকডাউন ঘোষণা করে দোকানপাটে খাবার বিক্রি বন্ধ করা হয়। তবে চালু থাকে দোকানে তৈরি খাবার অনলাইনে বিক্রি করার পদ্ধতি। কিন্তু রাস্তায় বাস চলাচল না করায় এসব রাস্তায় গড়ে ওঠা রেস্টুরেন্টর চোখে অন্ধকার নেমে আসে। ছোট ছোট রেস্টুরেন্টগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। বড় রেস্টেুরেন্টে শ্রমিকের ছাঁটাই করা হয়।   

প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক-কর্মকর্তা নিয়ে উত্তরাঞ্চলে ঢাকা-সিরাজগঞ্জ ও ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করে আসছে ফুড ভিলেজ। এসআর গ্রুপের এই প্রতিষ্ঠানের দুটি রেস্টুরেন্ট। একটি বগুড়ার দক্ষিণ সীমানায় ধনকুণ্ডি এলাকায় ১৮ বিঘা জমিতে অবস্থতি। এটি ২১ বছর আগে গড়ে তোলা হয়েছে। আরকেটি গড়ে উঠেছে প্রায় ৬ বিঘা জমিতে হাটিকুমরুল এলাকায়। চলতি বছরে করোনার কারণে প্রায় তিন মাস বন্ধ ছিল রেস্টুরেন্ট। এতে এই প্রতিষ্ঠান অর্থনৈতিকভাবে প্রায় দেড় কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছে।

ফুড ভিলেজ রেস্টুরেন্টে প্রায় এক যুগ ধরে চাকরি করছেন আশরাফুল ইসলাম সেলিম। তিনি বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের  ব্যবস্থাপক। আশরাফুল ইসলাম সেলিম বলেন, করোনার প্রভাব দেখা দেওয়ার পর থেকেই দেশের সবগুলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধুঁকে ধুঁকে চলছে। দেশে বিভিন্ন সময় সরকারি বিধি-নিষেধ আরোপের পর রেস্টুরেন্ট কার্যত বন্ধ রাখতে হয়েছে। কিন্তু কিছু খরচ ঠিকই হয়েছে। তবে মালিক পক্ষ প্রথম থেকেই অর্ধেক শ্রমিক রেস্টুরেন্টে রেখেছে। শিফট করে কাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর মধ্যে অবশ্য অনেকে  পেশা বদল করেছেন। 

তিনি আরও বলেন, লোকসান কমাতে মালিক পক্ষ শ্রমিকদের বেতনও অর্ধেকে নামিয়েছে; করোনাকালীন অবস্থায়। কারণ প্রতি মাসে এই রেস্টুরেন্টে অন্তত অর্ধকোটি টাকা শ্রমিকদের বেতন দিতে হয়। সম্প্রতি লকডাউন খুলে দেওয়ার পরও পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হয়নি। কারণ সাধারণ মানুষ আগের মতো করে এখনো রাস্তায় বের হয়নি। হলেও রেস্টুরেন্টমুখী কম। এ কারণে ব্যবসা নেই বললেই চলে। আশার করা হচ্ছে কোনো সমস্যা না থাকলে আগামী তিন মাসের মধ্যে আগের অবস্থায় ফেরা সম্ভব হবে। 

ফুডভিলেজ এখন অর্ধেক কর্মী দিয়ে চালু করা গেলেও একই এলাকায় অবস্থিত ওভি হাইওয়ে ভিলা সেভাবে চালুই হয়নি। এই প্রতিষ্ঠানে করোনার আগে ৪০০ কর্মী ছিলেন। এখন কমিয়ে অর্ধেক করা হয়েছে। তবে রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকার কারণে কোনো কর্মীর বেতন হয় না। এই রেস্টুরেন্টের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, করোনার কারণে রেস্টুরেন্ট বন্ধ রাখা হয়েছে। শ্রমিকদের কাজ নেই। এই কারণে তাদের বেতনও দেওয়া হয়নি। অনেকে ক্ষোভে চাকরি ছেড়েছেন। সরকারের তরফ থেকে একাধিকবার তালিকা নেওয়া হলেও কোনো সহায়তা পাওয়া যায়নি।

জানতে চাইলে ওভি হাইওয়ে ভিলা রেস্টুরেন্টের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক হাফিজুল ইসলাম বলেন, করোনার কারণে দেশের সব রেস্টুরেন্টের ব্যবসার অবস্থা খারাপ। সবাইকে বিভিন্ন সংকট মেনে কাজ করতে হচ্ছে। লকডাউনের সময় শ্রমিকদের বেতন বন্ধের কথা স্বীকার আর কোনো কথা বলতে রাজি হননি এই কমকর্তা।

সিরাজগঞ্জ-বগুড়া মহাসড়কের হাটিকুমরুল এলাকায় ২০ বছরের অধিক সময় ধরে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় রয়েছে অ্যারিস্টক্র্যাট। এখানে ১০০ জন শ্রমিক কর্মকর্তা কাজ করেন। তবে করোনার সময় এই প্রতিষ্ঠানের কাউকে ছাঁটাই করা হয়নি। কিন্তু বেতন কমানো হয়েছে। তারপরও মাসে আট থেকে ১০ লাখ টাকা খরচ হয়। তবে এ মাস থেকে শ্রমিকদের বেতন আবার স্বাভাবিক করা হয়েছে। 

অ্যারিস্টক্র্যাটে ১২ বছর ধরে ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করছেন শেখ গোলাম রহমান। তিনি বলেন, 'চাকরি জীবনে এমন পরিস্থিতির মুখে কখনো পড়তে হয়নি। ১২ বছর চাকরি করা অবস্থায় কাস্টমারের এতো সংকট কখনো দেখা দেয়নি। দুপুরে রেস্টুরেন্টে শত শত কাস্টমার থাকার কথা। কিন্তু আজ (২৮ আগস্ট) মাত্র ৪ জন রয়েছে। এখন রেস্টুরেন্ট চালালে কোনো মতে খরচের টাকা উঠছে। তবে মালিকের কোনো লাভ হচ্ছে না। করোনা চললে আদৌ লাভের মুখ দেখা যাবে কি না তাও বলা যাচ্ছে না।'

বগুড়ার শাজাহানপুরে ছোট পরিসরে গড়ে ওঠা জব্বার হোটেল কম সময়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। করোনায় তাদের অবস্থায়ও নাজুক। এই প্রতিষ্ঠানের ৫০ জন শ্রমিকের কাউকে ছাঁটাই করা হয়নি। তবে রেস্টুরেন্ট বন্ধের সময় কাউকে বেতনও দেওয়া হয়নি। 

ট্রাকচালক ও হেলপারদের কাছে বেশ জনপ্রিয় এই রেস্টুরেন্টের অন্যতম মালিক শাহিদুল ইসলাম বলেন, 'করোনায় সবাই মিলে বাঁচার চেষ্টা করা হচ্ছে। মহামারির উপর তো কারও হাত নেই!'

গাইবান্ধার অন্যতম বন্দর গোবিন্দগঞ্জ। বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের উপর এখানে মায়ামনি রেস্টুরেন্ট গড়ে ওঠেছে কয়েক বছর হলো। পঞ্চগড়-নীলফামারি থেকে আসা কিছু পরিবহন এখানে যাতাবিরতি দেয়। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক বাবুল লাল চৌধুরী বলেন, 'উত্তরাঞ্চলে ভালোমানের হাইওয়ে রেস্টুরেন্ট বিবেচনা করা হলে, সেগুলো হাটিকুমরুল গড়ে ওঠেছে। করোনায় তাদের মতোই আমাদের অবস্থা। লকডাউনে রেস্টুরেন্ট খোলা থাকলেও বিক্রি নেই। অথচ মাসে সাড়ে চার লাখ টাকা শ্রমিকদের বেতন দিতে হয়। সরকারি কোনো অনুদানও মিলছে না। লকডাউন খোলার পরও বিক্রি নেই। এ অবস্থা চলতে থাকলে পথে বসা ছাড়া উপায় থাকবে না।'

কর্তৃপক্ষ বলেন...

কুমিল্লা রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি এম এ মুকিত টিপু বলেন, 'কেন্দ্রীয় হিসাব মতে হাইওয়ে কুমিল্লা অংশের রেস্তোরাঁগুলোর ন্যূনতম লোকসান ৫০০ কোটি টাকা। বড় ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের মালিকদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে সরকারের কাছে প্রণোদনা পাওয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু সরকার এ খাতে এখনও প্রণোদনার ব্যবস্থা করেনি।'

কুমিল্লা হাইওয়ে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন বলেন, 'প্রতিষ্ঠান সচল না থাকায় অনেক আসবাবপত্র নষ্ট হয়েছে। বাস চালু হলেও হাইওয়ের অনেক রেস্তোরাঁ খোলা যায়নি। নতুন করে চালু করতে হলে অনেক বিনিয়োগ করতে হবে। আমরা ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত। প্রণোদনা না পেলে অনেক প্রতিষ্ঠান খোলাই যাবে না।'

কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, ' সমিতির পক্ষ থেকে যদি আবেদন জানানো হয়, আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জানাবো। মন্ত্রণালয় অনুমতি দিলে ক্ষতি অনুযায়ী ঋণের ব্যবস্থা করা হবে।'

উত্তরাঞ্চলের রেস্টুরেন্ট মালিকদের কোনো সংগঠন নেই। তবে বগুড়ায় রয়েছে।

বগুড়া হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান নিশাদ বলেন, 'করোনাকালে এই খাতে কোটি কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। অনেকে ব্যবসা বন্ধ করেছে। মহমারি করোনার সময় সব দিক বিবেচনা করা দরকার। মালিকেরা লোকসানে নাজেহাল হওয়ার পর টিকে থাকার জন্য শ্রমিকদের ছাঁটাই করেছেন। এখন সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে খোঁজ নিয়ে এসব শ্রমিকদের জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে।'

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.