মহামারিতে চাঙ্গা অর্গানিক কেমিক্যালের বাজার  

অর্থনীতি

05 September, 2021, 02:35 pm
Last modified: 05 September, 2021, 03:25 pm
বাংলাদেশে যে ৮ হাজার কোটি টাকার অর্গানিক কেমিক্যালের বাজার রয়েছে, তারমধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বাজারই হলো ইথাইল এলকোহলের। করোনার মধ্যে এর চাহিদা আরও বেড়েছে।

হ্যান্ড স্যানিটাইজার, ওষুধ, খাবার, কসমেটিকস, রং ও কোমল পানীয় উৎপাদনের মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত বিভিন্ন কেমিক্যালের (অর্গানিক কেমিক্যাল) বাজারের পরিসর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ এর প্রভাবে অন্যান্য ব্যবসায় মন্দা দেখা দিলেও, অর্গানিক কেমিক্যালের বাজার হয়েছে আরও চাঙ্গা।

বাংলাদেশে অর্গানিক কেমিক্যালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত হয় ইথাইল এলকোহল যার আরেক ধরন হলো রেক্টিফাইড স্পিরিট। এছাড়াও রয়েছে কার্বোহাইড্রেট, হাইড্রোকার্বন, সালফার, নাইট্রাস, বেনজিন, ফেনল, থ্যালিক অ্যানহাইড্রাইড সহ বেশ কয়েক ধরনের কেমিক্যাল। 

বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) একজন কর্মকর্তা জানান, বৈজ্ঞানিক ভাষায় সহজে বলা যায়, যে রাসায়নিকগুলোর মধ্যে অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, সালফার ও ফসফরাস সবসময় উপস্থিত থাকে সেগুলোই হলো অর্গানিক কেমিক্যাল। এই কেমিক্যালগুলো মানুষের নিত্যদিনের বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনে বহুল ব্যবহৃত। 

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কোভিডকালে এসব কেমিক্যাল নির্ভর পণ্যের চাহিদা বাড়ার কারণেই বাজারও বৃদ্ধি পেয়েছে।   

সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ, আমদানি-রপ্তানিকারক, প্রস্তুতকারক, ব্যবসায়ী ও ব্যবহারকারীদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে অর্গানিক কেমিক্যালের ক্রমবর্ধমান বাজার নিয়ে।

আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৮,০০০ কোটি টাকার বাজার তৈরি হয়েছে ক্রমবর্ধমানভাবে। যার প্রায় ৬,১৯২ কোটি আমদানি নির্ভর এবং প্রায় ৮৭৭.২০ কোটি টাকার অর্গানিক কেমিক্যাল রপ্তানি হয় বিভিন্ন দেশে।    

এ দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে প্রায় ৬৬৫ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের অর্গানিক কেমিক্যাল আমদানি করা হয়; ওই বছর প্রায় ৬১ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের রপ্তানি হয়েছে বাংলাদেশ থেকে।      

২০২০-২০২১ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭২০ মিলিয়ন ডলারে এবং রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ৮৬ মিলিয়ন ডলারে।  

কেমিক্যাল আমদানি-রপ্তানিকারক এসোসিয়েশনের সভাপতি ও এনসিয়েন্ট কেমিক্যালস লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী সোহায়েল হোসেন টিবিএসকে বলেন, বাংলাদেশে ১০০ এর বেশি কেমিক্যাল আমদানি করা হয়। যার মধ্যে ১১টি রয়েছে অর্গানিক কেমিক্যাল। এছাড়াও বাংলাদেশে প্রায় ৪৭টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা এসব কেমিক্যাল উৎপাদন করে।  

তিনি বলেন, যেসব কেমিক্যাল অন্য কোনো কেমিক্যালের সাথে বিক্রিয়া ছাড়াই সরাসরি কোনো পণ্য উৎপাদনে ব্যবহার করা যায়, সেগুলোকেই আমরা অর্গানিক কেমিক্যাল হিসেবে গণ্য করি। আর ইথাইল এলকোহল বা রেক্টিফাইড স্পিরিট হলো অর্গানিক কেমিক্যালের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত।   

ইথাইল এলকোহলের বহুল ব্যবহার

বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) কেমিক্যাল রিসার্চ ডিভিশনের প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অফিসার মো. হেমায়েত হোসেন টিবিএসকে বলেন, শ্বেতসার জাতীয় পদার্থের লঘু দ্রবণের সঙ্গে ইস্টের বিক্রিয়ায় প্রথমে ইথাইল অ্যালকোহলের লঘু জলীয় দ্রবণ উৎপাদন হয়। এই কেমিক্যালের মূল উপাদান হিসেবে বেশীরভাগ সময় চিটাগুড় ব্যবহার হয়। এছাড়াও পোড়া চুন ও বিভিন্ন ধাতব, ক্যালসিয়াম, নারকেলের পানি ও বিভিন্ন ফলের রস থেকেও এই কেমিক্যাল উৎপাদন করা যায়। 

তিনি বলেন, এখন হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও জীবাণুনাশক উৎপাদনের মূল উপাদান হিসেবে ইথাইল এলকোহল ব্যবহার হচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন ওষুধ, সুগন্ধি, হোমিও ওষুধের দ্রবণ হিসেবে, সাবান তৈরি, কসমেটিক সামগ্রী, বিভিন্ন রকম রং এবং বার্নিশ শিল্পে, ধোঁয়াহীন বারুদ প্রস্তুতিতে, বিয়ার, হুইস্কি, ব্র্যান্ডি তৈরিতে, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি প্রস্তুতিতে, পরীক্ষাগারে উদ্ভিদ এবং প্রাণীর নমুনা সংরক্ষণে বহুল ব্যবহৃত হয়ে এই এলকোহল।  

কেমিক্যাল আমদানি-রপ্তানিকারক এসোসিয়েশনের সভাপতি সোহায়েল হোসেন টিবিএসকে বলেন, বাংলাদেশে যে ৮ হাজার কোটি টাকার অর্গানিক কেমিক্যালের বাজার রয়েছে, তারমধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বাজারই হলো ইথাইল এলকোহলের। করোনার মধ্যে এর চাহিদা আরও বেড়েছে।

আবার বাংলাদেশের কেরু এন্ড কোং, বিএমএস ট্রেড কমিউনিকেশন, ফোর এসি কর্পোরেশন সহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এলকোহল, সালফার, নাইট্রাস এবং কার্বনসহ বিভিন্ন অর্গানিক কেমিক্যাল উৎপাদন করে।

তিনি বলেন, শুধু কেরু এন্ড কোং নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এলকোহল তৈরি করে। এছাড়া আরও ২৩টি প্রতিষ্ঠান ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনাসহ ১০ দেশ থেকে কাাঁচামাল আমদানি করে এলকোহল উৎপাদন করে। আর নেদারল্যান্ডের এলকোহলের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি করা এলকোহল তাদের বাজারের প্রায় ৫০ শতাংশ।  

বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি ডা নুরুজ্জোহা টিবিএসকে বলেন, প্রতিবছর প্রায় ৬০০ কোটি টাকার এলকোহল বা রেক্টিফাইড স্পিরিট ব্যবহৃত হয়ে থাকে হোমিও ওষুধ প্রস্তুতে।  

সালফার, নাইট্রাস এবং কার্বনসহ বেশ কয়েকটি কেমিক্যাল উৎপাদন করে মেঘনা গ্রুপের 'তাসনিম কেমিক্যাল'। প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, এসব কেমিক্যাল উৎপাদনের জন্য জাপান, কোরিয়া, চীন, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে কাঁচামাল রপ্তানি করতে হয়।  

মিটফোর্ড পাইকারি কেমিক্যাল মার্কেটের সবচেয়ে বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মের্সাস আলম কেমিক্যাল ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী সরদার হোসেন আলী টিবিএসকে বলেন, দেশে যে কার্বোনেটেড বেভারেজ বা কোমল পানীয় উৎপাদন হয় তার মূল উপাদান হলো কার্বন। প্রতিবছর বিদেশ থেকেই প্রায় ১২০০ কোটি টাকার কার্বন আমদানি করা হয়। এছাড়াও দেশের মেঘনা গ্রুপের তাসনিম কেমিক্যাল, মেক্সিমকো লিমিটেড, ফারিজা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল  সহ ৫টি কোম্পানী আরও ১০০ কোটি টাকার কার্বন উৎপাদন করে বাজারজাত করে। 

মোঃ হেমায়েত হোসেন বলেন, বিভিন্ন ওষুধ যেমন কাশির ওষুধ, ঘুমের ওষুধ, এলার্জিজনিত ওষুধ তৈরিতে সালফার ও নাইট্রাসের ব্যবহার হয়। এছাড়াও কসমেটিক পণ্য তৈরিতে এই দুই কেমিক্যাল সহ আরও কয়েকটি অর্গানিক কেমিক্যালের ব্যবহার অপরিহার্য।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের সাধারণ সম্পাদক এবং হাডসন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম শফিউজ্জামান বলেন, অনেক ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি নিজেরাই এসব কেমিক্যাল আমদানি করে। আবার অনেকেই আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পাইকারি মূল্যে ক্রয় করে ব্যবহার করে। সব মিলিয়ে প্রতিবছর প্রায় ৪০০০ কোটি টাকার অর্গানিক কেমিক্যাল শিল্পে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।  

বাংলাদেশ কসমেটিকস অ্যান্ড টয়লেট্রিজ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি  মো রেজাউল করিম টিবিএসকে বলেন, কসমেটিকস অ্যান্ড টয়লেট্রিজ ম্যানুফ্যাকচারার্স কোম্পানিগুলো কসমেটিক পণ্য উৎপাদনে অন্যান্য কেমিক্যাল ব্যবহারের পাশাপাশি প্রতিবছর প্রায় ১০০০ হাজার কোটি টাকার অর্গানিক কেমিক্যাল ব্যবহার করে। অর্গানিক কেমিক্যাল হলো এসব পণ্য উৎপাদনের মূল উপাদান। এখন কসমেটিকসের বাজার ধীরে ধীরে বাড়ছে সে হিসেবে অর্গানিক কেমিক্যালের চাহিদাও বাড়ছে এই খাতে।   

নতুন বিনিয়োগ

বাংলাদেশে অর্গানিক কেমিক্যালের বাজার চাঙ্গা হওয়ায় আরও কয়েকটি দেশী ও বিদেশী কোম্পানী বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে এই খাতে। 

এর মধ্যে অন্যতম জার্মান কোম্পানি সিগওয়ার্ক। তারা ইতোমধ্যে বিনিয়োগ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এছাড়াও দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এসআর কেমিক্যাল লিমিটেড ইতোমধ্যে প্রায় ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামোগত নির্মাণ শেষ। আগামী বছরের শুরুর দিকে উৎপাদনে যাবে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা।  

সিগওয়ার্কের কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, ইতোমধ্যে আইনগত প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। খুব শিগগিরই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে জমি দেখার কাজ চলছে। ২০২৩ সালের মাঝামাঝি উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব।

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো সাখাওয়াত হোসেন ফিরোজ বলেন, আমাদের দেশে এলকোহলের বাজার সবচেয়ে বড়। কিন্তু উৎপাদন হয় চাহিদার মাত্র ৮ শতাংশ। বাদবাকি বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। কিন্তু এলকোহলসহ অন্যান্য অর্গানিক কেমিক্যাল বাংলাদেশেই উৎপাদন করে চাহিদা পূরণ সম্ভব। শুধু রয়েছে উদ্যোগের অভাব।

তিনি বলেন, প্রতিবছর লোকসানে থাকা চিনিকলগুলোর চিটাগুড় কাজে লাগিয়ে উৎপাদনের ব্যবস্থা করলে এলকোহলের বাজার পুরো দেশ নির্ভর হবে। 

তাছাড়া সালফার, কার্বন নাইট্রাসসহ অন্যান্য কেমিক্যালেরও অন্যান্য উৎস আছে। এক্ষেত্রে গবেষণার প্রতি জোর দিতে হবে। 

বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান শাহ্‌ মোঃ ইমদাদুল হক টিবিএসকে বলেন, দেশে এখন প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার কেমিক্যালের বাজার রয়েছে। যার বড় অংশই আমদানি নির্ভর।

তিনি বলেন, সরকার দেশীয় উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে আন্তরিক। স্থানীয় উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসলে নিজস্ব বাজারের পরিসর আরও বাড়ানো সম্ভব। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.