ভিয়েতনামের রপ্তানি নীতিমালা থেকে শিক্ষা নিতে পারে বাংলাদেশ: বিশেষজ্ঞদের অভিমত

অর্থনীতি

টিবিএস রিপোর্ট
18 September, 2021, 12:05 am
Last modified: 18 September, 2021, 12:32 pm
রেহমান সোবহান বলেন, ‘স্যামসাং কেন বাংলাদেশে আসতে চেয়েও ভিয়েতনামে চলে গেল—এসব প্রশ্নের জবাব জানা দরকার। এটি অন্য বিনিয়োগকারীদেরও প্রভাবিত করছে। ইয়াং ওয়ান ছাড়া আরো কোনো বড়  কোরিয়ান কোম্পানি কেন বাংলাদেশে এল না?

বিনিয়োগ আকর্ষণ ও রপ্তানি বহুমুখীকরণ: ভিয়েতনাম থেকে যে শিক্ষা নিতে পারে বাংলাদেশ 

`স্যামসাং কেন কেন বাংলাদেশে আসতে চেয়েও ভিয়েতনামে গেল, সে প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার :  Professor Rehman Sobhan
টিবিএস রিপোর্ট

১৯৮০-র দশকে রপ্তানি ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে কাছাকাছি অবস্থানে ছিল বাংলাদেশের আর ভিয়েতনাম। কিন্তু এশিয়ার দেশটি এখন রপ্তানি আর বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশকে বহু পেছনে ফেলে রীতিমতো ঈর্ষণীয় অবস্থানে পৌঁছে গেছে। 

গত তিন দশকে ভিয়েতনাম কী এমন জাদুর কাঠির বলে এগিয়ে গেল, শুক্রবার সে আলোচনায় বসেছিলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা। তাদের মতে, রপ্তানিবান্ধব নীতিমালা, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে উদারনীতি, রপ্তানিপণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণ, মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তির সঙ্গে যুক্ত হওয়া আর সরকারের নেওয়া দীর্ঘমেয়াদী নীতিই দেশটির এ সাফল্যের মূল রহস্য।

তারা বলেন, সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ প্রত্যাশিত সাফল্য পায়নি। ভিয়েতনাম যে মডেল গ্রহণ করে সফল হয়েছে, বাংলাদেশ পুরোপুরো না হলেও, সে পথে হাঁটা উচিত। 

'রপ্তানিতে ভিয়েতনামের দুর্দান্ত এগিয়ে যাওয়া: বাংলাদেশের জন্য কী শিক্ষা রয়েছে' ওয়েবিনারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, 'আমাদের গভরনেন্সের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে ইপিজেড করেও এখনের জমির ফাইনাল অ্যাগ্রিমেন্ট হয়নি ইয়াংওয়ানের সাথে।'

তিনি আরও বলেন, 'তারা (ইয়াং ওয়ান) স্যামসাংকে আলোচনা করে বাংলাদেশে নিয়ে আসার চেষ্টা করলে। কিন্তু সে উদ্যোগ ব্যর্থ হলো। সেই স্যামসাং ভিয়েতনামে গেল, যা ভিয়েতনামের ইলেক্ট্রনিক শিল্পে বিপ্লব নিয়ে এলো।'

রেহমান সোবহান বলেন, 'স্যামসাং কেন বাংলাদেশে আসতে চেয়েও ভিয়েতনামে চলে গেল—এসব প্রশ্নের জবাব জানা দরকার। এটি অন্য বিনিয়োগকারীদেরও প্রভাবিত করছে। ইয়াং ওয়ান ছাড়া আরো কোনো বড়  কোরিয়ান কোম্পানি কেন বাংলাদেশে এল না?

'বাংলাদেশ ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পাচ্ছে। অথচ এই সুবিধা ছাড়াই ভিয়েতনামের রপ্তানি কীভাবে আমাদের চেয়েও ভালো করল, তা পর্যালোচনা হওয়া দরকার।'

২০১০ সালে মনমোহন সিংয়ের সময় ভারতের সঙ্গে শুল্কমুক্ত রপ্তানি চুক্তির সুযোগগুলোও বাংলাদেশ ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারছে না বলে মন্তব্য করেন রেহমান সোবহান।

তিনি বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র আমাদের জিএসপি সুবিধা বাতিল করেছে কত আগে, কিন্তু আদৌ তা ফিরিয়ে আনার জন্য তেমন কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না।

'অথচ ভিয়েতনাম একটি সমাজতান্ত্রিক ধারার এবং বেশি ইংরেজি না জানা দেশ হয়েও তাদের মেধা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রপ্তানি সুবিধা আদায় করেছে। ইউরোপের সঙ্গে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধার চুক্তি করেছে। অথচ আমরা তা এখনো করতে পারিনি।'

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, ভিয়েতনামের দৃঢ় নীতি সহায়তা দেশটির রপ্তানি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে সাহায্য করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ এমন সম্ভাবনা থাকলেও এ ধরনের সূচকে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) কর্তৃক আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে প্রতিষ্ঠানটির ভাইস চেয়ারম্যান ড. সাদিক আহমেদ। তিনি দেখিয়েছেন ১৯৯০-এর দশকে তেল-নির্ভরতা থেকে রপ্তানিপণ্যে বৈচিত্র্য এনে ভিয়েতনাম কীভাবে তাদের রপ্তানিমুখী শিল্পে সাফল্য পেয়েছে।

তিনি বলেন, রপ্তানিতে একটি খাতনির্ভর হয়ে থাকেনি, বরং বিভিন্ন খাতে গিয়েছে। অথচ এখনো বাংলাদেশের রপ্তানির ৮০ শতাংশের বেশি আসে একটি খাত থেকে। 

আলোচনায় বক্তারা বলেন, বিনিয়োগ ও বাণিজ্য তথা রপ্তানি বাড়াতে সরকারের নীতির আমূল সংস্কার প্রয়োজন। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে দূরদর্শী ও কার্যকর অর্থনৈতিক কুটনীতি জোরদার করতে হবে। সারা বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ ব্যাপক হার বাড়াতে হবে।

পিআরআই-এর চেয়ারম্যান ড. জাইদি সাত্তারের সভাপতিত্বে আলোচিত ওই সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। 

ঢাকা চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ-এর (ডিসিসিআই) প্রেসিডেন্ট রিজওয়ান রহমান বলেন, আমরা আর কোনো স্যামসাংকে হারাতে চাই না।

আলোচনায় অংশ নেওয়া ব্যবসায়ী নেতারা বাংলাদেশের রপ্তানিতে এক-পণ্য-নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে কার্যকর উদ্যোগ না থাকার বিষয়টি তুলে ধরেন। তারা বলেন, এসব ইস্যু নিয়ে অনেক কথা বলা হলেও কাজ হচ্ছে না। 

মেট্রোপলিটন চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট নিশাদ কবি বলেন, 'কাগজে কলমে আমাদের সবই চমৎকার। কিন্তু বাস্তবতা কী বলছে? বিনিয়োগকারীরা কী চায়, কেন চলে যাচ্ছে, তা কেউ জানতে চায় না। অথচ আমরা বলি, আমাদের কি এফডিআই দরকার আছে? বিদেশিরা সামান্য টাকা নিয়ে এসে অনেক টাকা নিয়ে যায়।'

অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মনজুর ব্যবসার ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সরকারের বিভিন্ন নীতিমালায় ফ্লিপ-ফ্লপিং রয়েছে। কখনো ইয়েস তো কখনো নো।' 

কাস্টম ক্লিয়ারেন্স, ট্যারিফ রেট, লজিস্টিকসহ ইজ অব ডুয়িং বিজনেসে বিভিন্ন দুর্বলতা নিয়েও কথা বলেন তিনি। 

পরিকল্পনামন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেন, 'গত কয়েক বছর ধরে সবকিছুতে ভিয়েতনামের সঙ্গে তুলনা করা একটা প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে রাখা দরকার, দে আর ওয়ান পার্টি স্টেট, যা বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে মেলানো যাবে না। তাদের অনেক কিছুর সঙ্গে আমাদের মিল নেই।'

তারপরও আলোচনা থেকে উঠে আসা বিভিন্ন সুপারিশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখার আশ্বাস দেন পরিকল্পনামন্ত্রী। 

ওয়েবিনারে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বিজিএমইএ-র সাবেক প্রেসিডেন্ট রুবানা হক, পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাসরুর রিয়াজ, সিপিডির ডিস্টিঙ্গুইশড ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান এবং ইউএনডিপির কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.