ভিন জগতের বাসিন্দা ভারতের পুঁজিবাজার
অর্থনীতির সার্বিক হালচালে প্রভাবিত হয় পুঁজিবাজার । তাহলে ভারতীয় মূলধনী বাজারে সূচক পতন হচ্ছে না কেন? – এই প্রশ্ন একেবারেই ন্যায্য ও প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে, ৭৫ বছর আগের দাঙ্গা ও দেশভাগের পর করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়েই দেশটি যখন সবচেয়ে করুণ অবস্থার শিকার, মানবতাও যখন অসহায়- তখন এই দুর্যোগের প্রভাব পুঁজিবাজারকে আন্দোলিত করার কথাই ছিল।
গত দুই সপ্তাহ ধরেই দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা ৩ লাখের উপরে, মহামারি দেখা দেওয়ার পর পৃথিবীতে এটাই সর্বোচ্চ আকারের কেস শনাক্তকরণের রেকর্ড। আনুষ্ঠানিক মৃতের সংখ্যাও ৩,৭০০ জনের বেশি, সরকারি তথ্যের অনির্ভরযোগ্যতার হিসাব আমলে নিলে বলা যায় প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি।
ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিও সর্বব্যাপী। হবেই বা না কেন, আক্রান্ত হলে খোদ ধনী এবং প্রভাবশালী অনেক পরিবারের সদস্যরাও যে হাসপাতালের শয্যা বা অক্সিজেন সিলিন্ডার যোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন।
এতকিছুর পরও ভারতীয় পুজিবাজারে শীর্ষ ৫০ প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত বাজার সূচক নিফটি ৫০ ইনডেক্স খুবই সামান্য কমেছে, এমনকি মধ্য ফেব্রুয়ারির পর এর পতন হয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ।
লগ্নীকারীদের ৩২ গুণ বেশি আয়ের সুযোগ করে দিয়ে, শীর্ষ ভারতীয় কোম্পানিগুলোর শেয়ারপ্রতি মূল্যায়ন চীনের চাইতেও দ্বিগুণ, ভারতীয় বাজারে তাই নতুন বিনিয়োগ করাও অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
এমন মূল্যায়ন ধরে রাখার পেছনে যেসব যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, তার অন্যতম একটি হলো; গেল বছরের মতো এবার জাতীয় লকডাউন জারি করা হয়নি। মহামারি বিশেষজ্ঞদের প্রণীত মডেল অনুযায়ী, হয়তো আর এক বা দুই সপ্তাহ পড়েই সংক্রমণের সর্বোচ্চ উত্থান দেখা দেবে, তারপর স্বাভাবিকভাবেই কেস সংখ্যা কমবে।
তাছাড়া, ২০২০ সালে মহামারির প্রথম ঢেউয়ের সময়ে বিনিয়োগকারীরা দেখেছেন, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মী ছাঁটাই করে বা কার্যক্রমের পরিধি সঙ্কোচন করে হলেও পুঁজিবাজারে অবস্থান ঠিক রাখার চেষ্টা করে, এবং দরকারে এবারও তাই করবে। যাদের চাকরি বাঁচবে তারা বাড়তি ব্যয় করতে চাইবেন না। এক পর্যায়ে তাদের সঞ্চয় অবশ্যই পুঁজিবাজারের প্রতি আকর্ষিত হবে। বাজারের বাইরে থাকা ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো যখন মূলধন ও আয় দুই নিয়েই দুর্দশায়, তখনই দেখা যাচ্ছে বড় কোম্পনির প্রতি আস্থার এ জুয়া।
বাজার আশাবাদের আরেক কারণ কতৃপক্ষের কাছ থেকে প্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া। গত বছরের অভিজ্ঞতা থেকেই এমন আশাবাদ তৈরি হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ভাইরাসের মারাত্মক নতুন ধরন নিয়ন্ত্রণে আনতে জাতীয় লকডাউন দেওয়া হলে, গত বছরের মতোই অর্থ মন্ত্রণালয় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক একযোগে পুঁজিবাজারের লেনদেনে বিরতি টানবে, দেবে রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টির ঋণ এবং নেওয়া হবে অন্যান্য তারল্য বর্ধক পদক্ষেপ। তখন নতুন পুঁজির ঘাটতিকেও পূরণ করবে কর্তৃপক্ষ।
ধারণাটি সত্যি করেই যেন গত বুধবার ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক- রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) ঋণ পরিশোধে ছাড় ঘোষণার পাশাপাশি, ভ্যাকসিন উৎপাদক সংস্থা, হাসপাতাল এবং মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদকদের জন্য ৪ শতাংশের সুদহারে তিন বছর মেয়াদি অর্থায়ন সুবিধা ঘোষণা করে।
কয়েক মাস আগের তুলনায় এখন নীতি-নির্ধারকদের কাছে নানা রকম প্রণোদনার পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ বেশি- সেকথা অস্বীকার করা যাবে না। রাষ্ট্রীয় বন্ড এবং বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের স্ফীত অবস্থার সুবিধা নিয়েও বার্ষিক মুদ্রানীতি আরও শিথিল করা সম্ভব। তাছাড়া, গত বছরের মতো এবারও সঙ্কট আঘাত হানা মাত্রই সরকারি সিক্যুইরিটিজের দরবৃদ্ধি বা রুপির মূল্য পতনের পেছনে ভূমিকা রাখা লেনদেনকারীরা পিছু হটেছেন। আশাবাদী থাকার সেটাও কারণ।
তবু, এসব কিছুই যেন বাস্তবতার মৌলিক দিককে অস্বীকার করছে। ২০২১ সালের ঘটনাপ্রবাহ নিঃসন্দেহে ২০২০ সাল থেকে অনেক ভিন্ন মাত্রার। এক বছর আগে কড়াকড়ি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিধিমালা এবং আগেভাগে জারি করা লকডাউনে জনজীবনে আতঙ্ক ছড়ায়, হঠাৎ করেই কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েন শহরবাসী লাখো গ্রামীণ পরিযায়ী কর্মী। কিন্তু, তবুও রোগীর ভিড়ে স্বাস্থ্য সেবাখাত ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়নি।
এবারের দশা আসলেই ভয়ানক, গাঁওগঞ্জে অনুপ্রবেশ করেছে ভাইরাস। গেল বছর এসব প্রত্যন্ত এলাকায় পরিযায়ী শ্রমিকেরা ফিরে এসে নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছিলেন। স্থানীয় কৃষি অর্থনীতিতে কাজও পান অনেকে। এবছর তাদের সিংহভাগকেই সাহায্য দেওয়ার প্রয়োজন হবে। এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় মূল্যস্ফীতি দেখার আভাস দেওয়া হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতিতে, বাড়বে কাঁচামাল ও খাদ্যের দাম, তাই বড় কৃষি খামার ও কৃষকের জন্য সহায়তার তত্ত্বটি হয়তো প্রযোজ্য নাও হতে পারে। গেল বছরের তুলনায় এবছর শিল্পোৎপাদনে ব্যবহৃত ধাতু, বিদ্যুৎ এবং কৃষিপণ্যের দাম বৃদ্ধির ঘটনা এরমধ্যেই চোখে পড়ছে।
অন্য আরেকটি পার্থক্য হলো, ভারতীয় পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ সঞ্চালনের উৎস ধনী দেশগুলোতে গত বছর টিকা দেওয়া হয়নি, কিন্তু এখন এসব দেশে টিকাদান কর্মসূচি ভারতের চাইতে বহুগুণ জোর গতিতে চলছে। সেই তুলনায় ভারত মোট জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশকে টিকা দিয়েছে।
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল রেটিংসের আভাস অনুসারে, মে'তে সংক্রমণ বাড়লে চলতি বছর ভারতের মোট দেশজ উৎপাদন ৯.৮ শতাংশ হতে পারে, মার্চের ১১ শতাংশের আভাস সংশোধন করে এই প্রাক্কালন করা হয়। আর এক মাস সংক্রমণের বিস্তার জিডিপিকে ৮.২ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারে। গত ৩১ মার্চ সমাপ্ত অর্থবছরে ভারতের জিডিপি ৮ শতাংশের যে বড় সঙ্কোচন লক্ষ্য করে তার তুলনায় আভাসগুলো কিছুটা আশাপ্রদ। আর সেই আশার উপরই ভরসা করে আছে ভারতে বিনিয়োগের অত্যন্ত অস্থিতিশীল রেটিংস।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত
- লেখক: অ্যান্ডি মুখার্জি ব্লুমবার্গের মতামত কলাম লেখক। তিনি শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং আর্থিক সেবাখাত নিয়ে বিশ্লেষণ করেন। ইতোপূর্বে, তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ব্রেকিংভিউজেও কলাম লিখতেন।