ভরা মৌসুমেও সংকটে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাদুকা শিল্প
- বড় কারখানাগুলোতে কয়েক কোটি টাকার জুতা পড়ে আছে।
- লকডাউনের কারণে উৎপাদিত জুতা বাজারজাত করা যাচ্ছে না।
- লকডাউনের কারণে জুতা তৈরির কাঁচামালের দাম বেড়েছে।
- করোনায় গত বছর লোকসান হয়েছিল প্রায় ২০ কোটি টাকা।
রমজান মাসকে পাদুকা শিল্পের মূল মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। এই মাসে কারখানাগুলোতে পুরোদমে চলে জুতা তৈরি ও বাজারজাতকরণের কাজ। কিন্তু এবার ভরা মৌসুমেও সংকটে ভুগছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাদুকা শিল্প। গেল বছরের মতো এবারও করোনাভাইরাসের থাবায় বিপর্যস্ত সম্ভাবনাময় এই শিল্পটি। সরকারি নির্দেশনায় লকডাউনের মধ্যে কারখানা খোলা রেখে এখন লোকসান গুণতে হচ্ছে মালিকদের। সেজন্য স্বাস্থ্য বিধি মেনে বিপণিবিতানগুলো খুলে দেওয়ার দাবি তাদের।
পাদুকা শিল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে দেড়শ পাদুকা কারখানা সচল রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১৬টি কারখানায় জুতা তৈরি হচ্ছে মেশিনের সাহায্যে। আর বাকিগুলোতে জুতা তৈরি হয় কারিগরদের হাতে। ৬০ টাকা থেকে শুরু করে ৪০০ টাকা পর্যন্ত দামের জুতা তৈরি হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কারখানাগুলোতে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এসে জুতা নিয়ে যান ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে।
প্রায় তিন হাজার শ্রমিক পাদুকা কারখানাগুলোতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কিন্তু এতো মানুষের কর্মসংস্থান করা শিল্পটি মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ভরা মৌসুমেও মাথায় হাত পড়েছে ব্যবসায়ীদের। লকডাউনের কারণে জুতা তৈরির প্রয়োজনীয় কাঁচামালেরও দাম বাড়ায় উভয় সংকটে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া চলমান লকডাউনের কারণে জুতা নেওয়ার জন্য পাইকাররাও আসতে পারছেন না কারখানাগুলোতে।
মূলত পাদুকা শিল্পের দুর্দিন শুরু হয় গেল বছরের মার্চ মাসের শেষ দিকে। অদৃশ্য করোনাভাইরাসের কারণে তখন সরকারি নির্দেশনায় কারখানাগুলো বন্ধ করে দেন মালিকরা। পরবর্তীতে ওই বছরের জুনে কারখানাগুলো খুললেও করোনার ধকল কাটছিল না। সব শ্রমিকরা কাজে না আসায় এবং বাজারে চাহিদা কম থাকায় জুতার উৎপাদন প্রায় ৪০ শতাংশ কমে যায়।
ফলে গত বছরের মৌসুম ধরতে পারেননি কারখানা মালিকরা। এরপর শীত মৌসুমেও অলস সময় পার করেছেন পাদুকা কারখানার শ্রমিকরা। কারণ শীতে পরার মতো কোনো জুতা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কারখানাগুলোতে তৈরি হয় না। এর ফলে পাদুকা শিল্পের সুদিনের জন্য গ্রীষ্মকালের অপেক্ষা করতে থাকেন কারখানা মালিকরা। কিন্তু এই দুর্দিনেও কারখানার ভাড়া ও স্থায়ী শ্রমিকদের বেতন-ভাতাসহ সকল ব্যয়ই মেটাতে হয়েছে মালিকদের। এতে করে গেল বছর পাদুকা শিল্পে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২০ কোটি টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুদিনের আশায় থাকা পাদুকা শিল্পে নতুন করে সংকট দেখা দেয় চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে। মহামারি করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে লকডাউনের কারণে দোকানপাট বন্ধ থাকায় উৎপাদিত জুতা বাজারজাত করা যাচ্ছে না। অনেক কারখানায় উৎপাদিত কয়েক কোটি টাকার জুতা পড়ে রয়েছে।
এছাড়া জুতা তৈরির প্রয়োজনীয় কাঁচামালের দামও বেড়েছে। ১৭০ টাকা লিটারের কেমিকেল এখন কিনতে হচ্ছে ৩০০ টাকায়। আর লকডাউনের আগে এক গজ ফোমের দাম ছিল ৩৮০-৩৯০ টাকা। সেই ফোম এখন সাড়ে ৫০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য কাঁচামালেরও দাম বেড়েছে। কিছু কাঁচামাল বিদেশ থেকে আনতে হয়। কিন্তু ফ্লাইট বন্ধ থাকার কারণে সেগুলো আনা যাচ্ছে না। এতে করে আমদানিকারকেরা কাঁচামালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহাকে কেন্দ্র করেই পাদুকা ব্যবসা। এই সময়ে বড় কারখানাগুলো গড়ে ১ থেকে দেড় কোটি টাকা মূল্যের জুতা বিক্রি করে থাকে। আর ছোট কারখানাগুলো বিক্রি করে ২০-২৫ লাখ টাকার জুতা। গেল বছর করোনাভাইরাসের কারণে দুই ঈদে কোনো ব্যবসা হয়নি। এবারের ঈদ মৌসুমে ব্যবসা করে গত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আশা করলেও সেটি আর হচ্ছে না।
কাজের চাপে দম ফেলার সুযোগ না পাওয়া শ্রমিকরাও এখন কাজের আশায় অনেকটা অলস সময় পার করছেন। কিন্তু কাজ কম থাকায় এবারের ঈদও মাটি হওয়ার কথা জানিয়েছেন অনেক শ্রমিক।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পীরবাড়ি এলাকার এক্টিভ পিউ ফুটওয়্যারের ফিটিংম্যান মো. রফিক জানান, তিনি ২৮-২৯ বছর ধরে পাদুকা কারখানায় কাজ করছেন। এই কাজ করে মাসে ১৫-২০ হাজার টাকা আয় হয় তার। এই টাকা দিয়েই স্ত্রী ও চার সন্তানের সংসার চলে। আগে রোজার মাস এলে সারারাত কাজ করতেন। কিন্তু গত বছর থেকে কারখানায় আগের মতো কাজ নেই। এর ফলে রোজার সময় বাড়তি কাজ করে যে টাকাগুলো পেতেন, সেগুলো এবারও পাবেন না বলে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।
খলিল মিয়া নামে আরেক শ্রমিক জানান, তিনি আপারম্যানের কাজ করছেন প্রায় ২০ বছর ধরে। প্রতিবছর রোজায় বাড়তি কাজ করে বেতনের বাইরে ১০-১৫ হাজার টাকা উপার্জন করেন। এই টাকা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের জন্য ঈদের জামা-কাপড় কিনেন তিনি। কিন্তু গত বছর করোনাভাইরাসের কারণে কাজ করতে না পারায় বাড়তি টাকা আয় হয়নি। এবারও কারাখানায় কাজ কমে গেছে। জুতা বাজারজাত করতে না পারায় উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
এক্টিভ পিউ ফুটওয়্যারের স্বত্ত্বাধিকারী মো. রাকিবুর রহমান বলেন, 'করোনাভাইরাসের কারণে গত বছর আমার কারখানায় প্রায় ৩০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। এবারের ঈদ মৌসুমে ব্যবসা করে সেই লোকসান কাটিয়ে নিতে পারব বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু এখন উল্টো আরও লোকসানে পড়তে হচ্ছে। লকডাউনের কারণে কাঁচামালের দাম বেড়েছে'।
'দোকানপাট বন্ধ থাকায় উৎপাদিত প্রায় দেড় কোটি টাকার জুতা বাজারজাত করতে পারছি না। এর ফলে জুতার উৎপাদন কমে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে'- বলেন রাকিবুর রহমান।
সেভেন স্টার ফুটওয়্যারের পরিচালক মো. হানিফ জানান, 'আমার কারখানায় ৫০-৬০ লাখ টাকার জুতা পড়ে আছে। এগুলো বাজারজাত করা যাচ্ছে না। সরকার লকডাউনে দোকানপাট বন্ধ রেখেছে, অথচ কারখানা খোলা রাখতে বলেছে। কিন্তু দোকানপাট বন্ধ থাকায় কারখানা খোলা রেখে আমাদের আরও লোকসান হচ্ছে। সেজন্য আমাদের দাবি স্বাস্থ্য বিধি মেনে যেন দোকানপাটও খুলে দেওয়া হয়। নাহলে আমরা কারখানা খোলা রেখে শ্রমিকদের বেতন কোত্থেকে দেব?'
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পাদুকা শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি কাজী শফিউদ্দিন বলেন, 'বিদেশি জুতার কারণে বাজারে এমনিতেই আমাদের দেশীয় জুতার চাহিদা কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় পাদুকা শিল্পে নতুন সংকট তৈরি করেছে করোনাভাইরাস। পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণে না আসে এবং লকডাউন যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে গতবছরের মতো এবারও বড় ধরণের আর্থিক লোকসানে পড়তে হবে। সরকারের উচিত দেশীয় এই শিল্পের দিকে সুদৃষ্টি দেয়া'।