ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধা হারানোর ঝুঁকিতে আরএমজি খাতের ৫০০ প্রতিষ্ঠান

অর্থনীতি

09 September, 2021, 01:00 am
Last modified: 09 September, 2021, 02:24 pm
তিন দশক ধরে বন্ড লাইসেন্স না থাকা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধা নিয়ে এবার আপত্তি তুলে তা বন্ধ করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে গত ৩১ আগস্ট চিঠি পাঠিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। 

তিন দশক ধরে বন্ড লাইসেন্স না থাকা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধা নিয়ে এবার আপত্তি তুলে তা বন্ধ করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে গত ৩১ আগস্ট চিঠি পাঠিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। 

শুধু তাই নয়, একে আইন লঙ্ঘণ বলে উল্লেখ করে এতদিন ধরে এই সুবিধা দিয়ে আসা ব্যাংকগুলোর বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা করার অনুরোধও জানিয়েছে সরকারের রাজস্ব আদায়কারী এ সংস্থা।

তবে খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এনবিআরের চিঠির ভিত্তিতে ব্যাংকগুলো তা কার্যকর করলে পোশাক রপ্তানিকারক অন্তত ৪৫০ প্রতিষ্ঠান এবং অন্তত ৫০টি হোম টেক্সটাইল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ব্যাক টু ব্যাক এলসির সুবিধা পাবে না। স্থানীয়ভাবে ক্রয়ের ক্ষেত্রে ভ্যাট পরিশোধের শর্ত মানতে গিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ব্যবসায় টিকে থাকাও সম্ভব হবে না।

ব্যাক-টু-ব্যাক এলসিতে, একজন আমদানিকারক একটি রপ্তানিকারককে একটি এলসি প্রদান করে এবং রপ্তানিকারক এটিকে জামানত হিসাবে ব্যবহার করতে পারে যাতে বাকীতে কাঁচামাল এবং অ্যাক্সেসরিজ সংগ্রহের জন্য আরেকটি এলসি জারি করা যায়।

সরকারের এমন সিদ্ধন্তে বিস্ময় প্রকাশ করে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন-বিকেএমইএ এর সিনিয়র সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধা বন্ধ করলে এই সুবিধাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। কেননা তারা স্থানীয় উৎস থেকে এই সুবিধার আওতায় ৭০-৮০ শতাংশ পর্যন্ত কাঁচামাল ও অ্যাক্সেসরিজ বাকীতে ক্রয় করতো। কয়জনের আর্থিক সক্ষমতা রয়েছে যে, তারা সব নগদ অর্থে ক্রয় করবে? আবার স্থানীয়ভাবে ক্রয় করতে গেলে ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে, যার ফলে বন্ড লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় তারা রপ্তানিতে টিকে থাকতে পারবে না।"

অন্যান্য রপ্তানিমুখী কারখানার মতো, নন-বন্ডেডরা গত তিন দশক ধরে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি সুবিধা ভোগ করলেও যদিও এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদ্যমান নির্দেশনার বিপরীত বলে এনবিআর সূত্রে জানা যায়।

এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বন্ড লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলো কোন অনিয়ম করছে কিনা তা নজরদারি করা সম্ভব। কিন্তু বন্ড লাইসেন্স না থাকা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোয় অডিট করা কিংবা নজরদারি করা সম্ভব হয় না। ফলে এ খাতে রপ্তানির নামে কাপড় খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে কিনা, তাও দেখা সম্ভব হয় না। এজন্য রপ্তানিকারকদের বন্ড লাইসেন্স নেয়ার মাধ্যমে নিয়মের মধ্যে আসা উচিত।

"নন-বন্ডেড কারখানার জন্য ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি সুবিধার গাইডলাইন সংশোধনের জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অনুরোধ করে আসছি, কিন্তু এখনও তা হয়নি।"

তবে ওই কর্মকর্তা স্বীকার করেন যে, সুবিধা বন্ধ করার অর্থ হচ্ছে বিদেশ থেকে কাঁচামাল এবং অ্যাক্সেসরিজ আমদানিকে উৎসাহিত করা।

এনবিআরের চিঠিতে বলা হয়, শুধুমাত্র বন্ডেড ওয়্যারহাউজ লাইসেন্স এর আওতায় পরিচালিত শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান ব্যাক টু ব্যাক এলসি খুলে সব ধরনের কাঁচামাল আমদানির সুবিধা পাবে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে বিজিএমইএ ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন (ইউডি বা কাঁচামাল আমদানির প্রাপ্যতার অনুমোদন) দিতে পারবে।

গত তিন দশক ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ গাইডলাইন অমান্য  করে এলসি ইস্যুকারী ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ রয়েছে রাজস্ব বোর্ডের চিঠিতে। 

রাজস্ব বোর্ডের একজন সদস্য খন্দকার মোহাম্মদ আমিনুর রহমান টিবিএস'কে বলেন, "নন-বন্ডেড প্রতিষ্ঠানকে ব্যাক টু ব্যাক এলসি বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার মধ্যেও নেই। এতদিন যা করা হয়েছে, তা আইনের পরিপন্থী।"

বিজিএমইএ সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, পদে পদে বাধা তৈরি না করে ব্যবসার প্রক্রিয়াকে সহজ করতে পারলে 'ইজ অব ডুয়িং বিজনেস' সূচকে দেশের অবস্থানের উন্নতি হবে। এতে রপ্তানি বাড়ার পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও আগ্রহী হবে।

'বিদ্যমান আইনের কিছু জটিলতা নিরসন করা গেলে এক বছরের মধ্যে রপ্তানি আরো চার থেকে ছয় বিলিয়ন ডলার বাড়বে' – বলেন তিনি।

এদিকে এনবিআরের চিঠির উপর ভিত্তি করে এ বিষয়ে চট করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রপ্তানিতে ক্ষতির বিষয়টিও ভাবছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল রোববার এনবিআরের চিঠিটি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে টিবিএস'কে বলেন, এটি নিছক রুটিন কাজ নয়, বরং অনেক ভাবনা-চিন্তার দরকার আছে। এনবিআরের সাথে বসে পরামর্শ করে তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

'এখনই সুবিধাটি বন্ধ করলে (ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধা) নন-উভেন রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নন-উভেন রপ্তানিকারকদের ৮০ শতাংশেরই বন্ড লাইসেন্স নেই। তাদের কথাও ভাবতে হবে' – বলেন তিনি।

অবশ্য কাকে সুবিধা দেবে কিংবা না দেবে, সে বিষয়টি এনবিআরের এখতিয়ার বলেও মত দেন ডেপুটি গভর্নর।

এদিকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত আজকের এই সফল অবস্থানে আসার পেছনে ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধা ও বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধাকে অন্যতম নিয়ামক বলে মনে করছেন উদ্যোক্তা ও অর্থনীতিবিদরা। 

পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, উভেন পোশাক রপ্তানির প্রায় ৪০ শতাংশ কাঁচামাল স্থানীয়ভাবে সরবরাহ করা হয় আর নিটওয়্যারের ক্ষেত্রে এটি ৮০ শতাংশ। এছাড়া, অ্যাক্সেসরিজেরও ৯০ শতাংশের বেশি স্থানীয় উৎস থেকে সংগ্রহ করা হয়। 

বেশিরভাগ কাঁচামাল আমদানি করতে হয় বলে উভেন পোশাক রপ্তানিকারকদের অল্প কিছু বাদে সবারই বন্ড লাইসেন্স রয়েছে। কেননা রপ্তানির জন্য কাঁচামাল আমদানি করতে হলে তার জন্য বন্ডেড ওয়্যারহাউজ লাগবেই, সেজন্য তাকে বন্ড লাইসেন্স নিতেই হয়।

অন্যদিকে নিটওয়্যার ও টেরিটাওয়েল রপ্তানিকারকদের বেশিরভাগ কাঁচামাল স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করার সুযোগ থাকায় তারা বন্ড লাইসেন্স নিতে আগ্রহী হন না। মূলত বন্ড লাইসেন্স সংগ্রহ করা ঝামেলাপূর্ণ ও বেশকিছু শর্ত পরিপালন করার বাধ্যবাধকতা এবং বাড়তি 'খরচের' উৎপাত থেকে বাঁচতে তারা বন্ড লাইসেন্স নিতে আগ্রহী হন না।

বেসরকারি খাত বিশেষজ্ঞ, বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সাবেক সিনিয়র ইকোনমিস্ট ও বর্তমানে পলিসি এক্সচেঞ্জ এর চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ টিবিএস'কে বলেন, "বন্ড লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠানের ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধা বন্ধ করা হলে অপেক্ষাকৃত ছোট ও মাঝারি বিনিয়োগের উদ্যোক্তাদের মূলধন চাহিদা বেড়ে যাবে, যা তাদের অনেকের পক্ষেই যোগাড় করা সম্ভব হবে না। ফলে অনেকের পক্ষে ব্যবসায়ে টিকে থাকাও সম্ভব হবে না।"

তিনি বলেন, 'নীতি নির্ধারনের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত হবে ব্যবসা কঠিন করার চেয়ে কীভাবে সহজ করা যায়, সেদিকে মনযোগ দেওয়া।'

'বর্তমান করোনার মত কঠিন পরিস্থিতিতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদে বিচার বিশ্লেষণ করে যদি সিদ্ধান্ত নিতে হয়ও, সেক্ষেত্রে ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, সব রপ্তানিকারক যাতে সমান সুবিধা পায়' – বলেন তিনি।

১৯৮০'র দশকে বাংলাদেশের রপ্তানি শুরুর পর কাঁচামালের পুরোটাই আমদানি নির্ভর ছিলো। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ফরেন এক্সচেঞ্জ ম্যানুয়ালে প্রথম এ বিষয়টি যুক্ত করা হয়, যাতে ব্যাক টু ব্যাক এলসির জন্য বন্ড লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করার শর্ত যুক্ত হয়। 

রপ্তানিকারকরা জানান, তখন যেহেতু সবই আমদানিনির্ভর ছিলো, ফলে সে বাস্তবতায় এই শর্ত যৌক্তিক ছিল। 

কিন্তু পরবর্তীতে দেশে শক্তিশালী ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ তৈরি হওয়ায় স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল সংগ্রহ সহজ হয়। ফলে বন্ড লাইসেন্স ছাড়াই স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল ও অ্যাক্সেসরিজ সংগ্রহ করা হতো ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে। তখন এনিয়ে সমস্যা হয়নি।

২০১৪ সাল থেকে এ সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে। পরবর্তীতে বিকেএমইএ থেকে ইস্যুটি সমাধানে চিঠি পাঠানোর পর বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়। তবে ২০১৯ সালে ফরেন এক্সচেঞ্জ ম্যানুয়াল সংশোধনকালে ইস্যুটি সমাধানের দাবি থাকলেও তা উপেক্ষিত হয়। এখনও এনিয়ে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। 

অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএস'কে বলেন, বিষয়টি সমাধানের জন্য গত বছর এনবিআরের কাস্টমস বন্ড বিভাগকে অনুরোধ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, এ দোটানায় পড়ে বছরে পর বছর ধরে একটি যৌক্তিক ইস্যুকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.