বৈশ্বিক পুঁজির বিপুল প্রবাহে ভারতে অনলাইন ব্যবসায়ে বৈপ্লবিক অগ্রগতির সূচনা 

অর্থনীতি

টিবিএস ডেস্ক 
18 July, 2021, 09:10 pm
Last modified: 19 July, 2021, 10:31 am
চীনে তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক অনলাইন ব্যবসায়ের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণের চাপ বাড়ায় বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীরা ভারতমুখী হচ্ছেন

নতুন যে সকল বেসরকারি কোম্পানি শত কোটি ডলার বা তার বেশি বাজারমূল্য অর্জন করে তাদেরকে বলা হয় তথাকথিত ইউনিকর্ন প্রতিষ্ঠান। মহামারির হানা দেওয়ার আগেই বিপুল সম্ভাবনা ছিল ভারতে তথ্যপ্রযুক্তির নয়া উদ্যোগগুলোর। কিন্তু, মহামারির অভিঘাত মোকাবিলা করেও অনেক উদ্যোগ রূপ নিয়েছে সফল ও উদীয়মান ব্যবসায়ে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা এখাতের দুর্দান্ত বিকাশের ইঙ্গিতও দেয়।
   
অন্যান্য কিছু বৈশ্বিক ঘটনাও ভারতের পক্ষে কাজ করছে। যেমন; বিশ্বের সবচেয়ে বড় জনসংখ্যার বাজার চীন সরকার স্থানীয় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেয়, যা আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চীনে এ খাতে বিনিয়োগে আস্থা কমায়। এই অবস্থায় গত সপ্তাহে ভারতীয় প্রযুক্তিখাতের নতুন উদ্যোগগুলো সম্ভাবনার এক নতুন সন্ধিক্ষণ প্রত্যক্ষ করেছে। 

গত সপ্তাহে ফুড ডেলিভারির ভারতীয় উদ্যোগ জোমাটো লিমিটেড পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত হয়ে ১৩০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ সংগ্রহ করে। আর্থিক খাতের প্রথম সাড়ির সংস্থা- মরগ্যান স্ট্যানলি, টাইগার গ্লোবাল ও ফিডেল্টি ইনভেস্টমেন্টস কোম্পানিটির বাজার অন্তর্ভুক্তিতে সাহায্য করেছে। 

এছাড়া, পুঁজিবাজারে নিবন্ধনের একটি খসরা প্রস্তাব প্রস্তুত করেছে ডিজিটাল পেমেন্ট স্টার্টআপ পেটিএম- এর মূল মালিকানা প্রতিষ্ঠান। বাজার নিবন্ধনের মাধ্যমে ২২০ কোটি ডলার পুঁজি সংগ্রহের পরিকল্পনা রয়েছে সেখানে। 

অনলাইনে খুচরা পণ্য ক্রয়ের আরেকটি আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ফ্লিপকার্ড অনলাইন সার্ভিসেস লিমিটেড এ সপ্তাহে ৩৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ পুঁজি সংগ্রহ করে এবং তার ভিত্তিতে ৩৮ বিলিয়ন ডলার বাজারমূল্য অর্জন করেছে। অন্য কেউ ভাঙ্গার আগে যা এপর্যন্ত ভারতীয় কোনো স্টার্টআপ কোম্পানির সবচেয়ে বড় পুঁজি সংগ্রহের রেকর্ড।  

সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের প্রাণকেন্দ্র সিলিকন ভ্যালি ভিত্তিক বিনিয়োগ ব্যবস্থাপক জিজিভি ক্যাপিটালের ব্যবস্থাপনা অংশীদার হান্স ট্যাং বলেন, "প্রায় এক দশক ধরে অনেকটা নীরবেই নতুন ব্যবসাগুলোকে তৈরি করে চলেছেন ভারতীয় উদ্যোক্তারা। এসময়ে দেশটিতে ইন্টারনেট সংযোগের সুবিধা যেমন বেড়েছে, ঠিক তেমনি বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের শেয়ার ক্রয়ের আগ্রহ বেড়েছে।"

"বিনিয়োগকারীদের কাছে ভারতে পুঁজি লগ্নী করার সুফল দিনে দিনে স্পষ্ট হওয়ায়, তারা এখন ভারত এখাতে পরবর্তী চীন হয়ে উঠবে বলেও আশা করছেন," মন্তব্য করেন তিনি।

তবে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনীতির জন্য এই সম্ভবনা অর্জন চ্যালেঞ্জমুক্ত নয়। যেমন; চীনে ইন্টারনেট ব্যবহার অনেক বেশি বিকশিত হলেও- সে তুলনায় ভারতে সাড়ে ৬২ কোটি ব্যবহারকারী কেবল ভিডিও স্ট্রিমিং সার্ভিস, সামাজিক মাধ্যম এবং অনলাইন বাণিজ্যের সুবিধা নিতেই অভ্যস্ত। এখনও তারা অনেক পরিষেবার অনলাইন ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেননি। 

তারপরও দেশটিতে রয়েছে অনলাইন শপিং বিকাশের অমিত সম্ভাবনা। কারণ মোট খুচরা ক্রয়ের কেবলমাত্র ৩ শতাংশই এখন অনলাইন লেনদেনের মাধ্যমে হয়। ভারতীয় কোম্পানিগুলো সেবার পরিধি ও মান বাড়াতে এখনও তাদের সরবরাহ চক্র ও ডেলিভারি নেটওয়ার্ক উন্নয়নে বিনিয়োগ করে চলেছে।  

জনসংখ্যা বৃদ্ধির দিক থেকেও সুবিধাজনক অবস্থানে ভারত, চলতি দশকেই দেশটির জনসংখ্যা চীনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করা হচ্ছে। তাছাড়া, চীনের সার্বিক পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্ট নন বিনিয়োগকারীর দল। 

যেমন, স্থানীয় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ের সাম্প্রতিক বিধিনিষেধে- পুঁজিবাজারে এসব প্রতিষ্ঠান ফেব্রুয়ারির সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে ৮০ হাজার কোটি ডলারের বেশি বাজারমূল্য হারিয়েছে। এ দরপতনে কোম্পানিগুলোর বিখ্যাত উদ্যোক্তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণও উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়।

চলতি মাসে কপাল পুড়েছে চীনের রাইড সেবা দাতা ডিডি গ্লোবাল ইঙ্কের। সরকার চীনের অ্যাপস্টোর থেকে ডিডি'কে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে পুঁজিবাজারে রেকর্ড দরপতন হয় কোম্পানিটির। 

এর আগে চীনের সবচেয়ে বিখ্যাত ধনকুবের জ্যাক মা'র অ্যান্ট গ্রুপের বহুল প্রত্যাশিত আইপিও একবারে শেষ মুহূর্তে এসে স্থগিত করে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। চীনা প্রযুক্তিখাতের ওপর এমন আরও কঠোর পদক্ষেপ আসার ঝুঁকি থাকায় সে তুলনায় প্রতিবেশী ভারতের দিকে ঝুঁকছেন বিনিয়োগকারীরা। 

এব্যাপারে কোটাক মাহিন্দ্রা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কো. – এর গ্রুপ প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নীলেশ শাহ বলেন, "চীনা প্রযুক্তি কোম্পানির শেয়ার কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বিনিয়োগকারীদের ভারতীয় প্রযুক্তি উদ্যোগগুলো আকৃষ্ট করতে পারে।" 

পাশাপাশি লাভে থাকা স্টার্টআপগুলো পুঁজিবাজারে যুক্ত হলে এখাতের রেটিং নতুন মানে উন্নীত হয়ে পুঁজিবাজার আরও শক্তিশালী অবস্থানে যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।  

তহবিল সংগ্রহে রেকর্ড: 

দ্বিতীয় প্রান্তিকে ভারতীয় টেক স্টার্টআপগুলো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ও পুঁজিবাজার নিবন্ধন করে মোট ৬৩০ কোটি ডলারের তহবিল সংগ্রহ করেছে, একইসঙ্গে যা নতুন উচ্চতার রেকর্ড। অন্যদিকে, ২০২০ সালের চতুর্থ বা শেষ প্রান্তিকে চীন ভিত্তিক কোম্পানিসমূহে বিনিয়োগ ২৭.৭ বিলিয়ন ডলারের সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে ১৮ শতাংশ কমেছে বলে জানায় বাজার গবেষণা সংস্থা সিবি ইনসাইটস সূত্র। 

বেঙ্গালুরুতে কোম্পানির অফিসে গ্রাহকদের অর্ডার করা পণ্যের প্যাকেট ব্যাগে ভরছেন ফ্লিপকার্ডের একজন ডেলিভারি কর্মী। ছবি: ধীরাজ সিং/ ব্লুমবার্গ

চিত্রটি ভারতে বিপরীত। সেখানে স্থানীয় ই-কমার্স বাজারের মূল দুই শক্তি ফ্লিপকার্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক অনলাইন শপিং জায়ান্ট অ্যামাজন ডটকম ইঙ্কসহ আরও বেশ কয়েকটি স্টার্টআপ আগামী ২৪ মাসে পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগ সংগ্রহের পরিকল্পনা করছে। 

স্টার্টআপগুলোর মধ্যে পলিসিবাজারের মূল প্রতিষ্ঠান ইটেকঅ্যাক্সেস মার্কেটিং অ্যান্ড কনসাল্টিং প্রাইভেট লিমিটেড, লজিস্টিকস প্রোভাইডার দিল্লিভেরি প্রাইভেট এবং এঅ্যান্ডআই টেকনোলজি প্রাইভেটের রাইড পরিষেবা কোম্পানি ওলা অন্যতম। 

আইপিও বা প্রাইমারি শেয়ারের মাধ্যমে খুচরা বিনিয়োগকারীরাও এসব কোম্পানির মালিকানার একটি অংশ কেনার সুযোগ পাবেন, যা আগে শুধুমাত্র বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের জন্যই উন্মুক্ত ছিল। অর্থাৎ, জনসাধারণের অংশগ্রহণে আরও শক্তিশালী হবে উদ্যোগগুলোর আর্থিক সক্ষমতা, বাড়বে সেবাদানের পরিধি। 

গত কয়েক মাস ধরেই বৈশ্বিক বেসরকারি বিনিয়োগ বাজারের সুবিধা নিয়ে ভারতে শত কোটি ডলার বা তার বেশি মূল্যায়নের স্টার্টআপগুলোর সংখ্যা অবিশ্বাস্য গতিতে বাড়ছে। এপ্রিলে মাত্র চারদিনে এমন আধা-ডজন ইউনিকর্ন কোম্পানির সৃষ্টি হয়। অনেক স্টার্টআপের প্রতি রাউন্ড তহবিল সংগ্রহের মধ্যে বিরতির সময় কমে মাত্র কয়েক সপ্তাহে নেমে এসেছে।  

এব্যাপারে সফল একজন সিরিয়াল উদ্যোক্তা গণেশ কৃষনান বলেন, "ভারতে অনলাইন বাণিজ্যের সম্ভাবনা বিশাল, সে তুলনায় সেবার বিকাশ তেমন করে ঘটেনি। এ সম্ভাবনা উপলদ্ধি করেই বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসছেন। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের পুঁজি লগ্নী আগের চাইতে ১০ গুণ বেড়েছে।"

  • সূত্র: ব্লুমবার্গ 
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.