বিনিয়োগে বাধা দূর করার পরামর্শ চীনা বিনিয়োগকারীদের

অর্থনীতি

টিবিএস রিপোর্ট
26 January, 2021, 06:00 pm
Last modified: 26 January, 2021, 06:00 pm
গত সোমবার এক ওয়েবিনারে এফডিএ বাড়াতে সুদের হার কমিয়ে এবং ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করার মাধ্যমে বিনিয়োগ বাধা দূর করার পরামর্শ দেন চীনা বিনিয়োগকারীরা।

অবকাঠামো সঙ্কট, নীতিমালা সংস্কারের অভাব ও নিরাপত্তাহীনতাকে নিবন্ধিত প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে অন্যতম বাধা বলে মনে করছেন চীনা বিনিয়োগকারীরা। ফলে বাংলাদেশে কমে যাচ্ছে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগও (এফডিএ)।   
 
গত সোমবার এক ওয়েবিনারে এফডিএ বাড়াতে সুদের হার কমিয়ে এবং ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করার মাধ্যমে বিনিয়োগ বাধা দূর করার পরামর্শ দেন চীনা বিনিয়োগকারীরা। 

"বাংলাদেশে সুদের হার অত্যন্ত বেশি, নিম্ন সুদের হার বিনিয়োগকারীদের খরচ কমাতে সাহায্য করবে," বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন ওভারসিজ চায়নিজ অ্যাসোসিয়েশন ইন বাংলাদেশের সভাপতি ঝুয়াং লিফেং।  

বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেন, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশের স্বীকৃতি অর্জনের পথে আছে। তবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাধা দূর করে ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করার জন্য কাজ করতে হবে। 

স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড চায়নার গ্লোবাল ব্যাংকিং অ্যান্ড কর্পোরেট অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল ব্যাংকিং-এর প্রধান জিন লু জানান, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে অবকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে বাংলাদেশকে। 

বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারের দর পরিবর্তনের ঝুঁকি এড়াতে বিনিময় মুদ্রা হিসেবে চীনা মুদ্রা আরএমবি চালু করার পরামর্শও দেন তিনি।

বাংলাদেশে ৯.১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের লক্ষ্যে চীনের ৫১২ প্রকল্প নিবন্ধিত রয়েছে। 'চায়না বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট' শীর্ষক ওয়েবিনারে নীতি নির্ধারক ও সরকারি কর্মকর্তারা এ তথ্য জানান।  এসব প্রকল্প আলোর মুখ দেখলে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে প্রায় সোয়া এক লাখ মানুষের। 

এ পর্যন্ত চীন থেকে মোট এফডিআই এসেছে ১.০২ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে গত অর্থবছরেই এসেছে ৮০.২৯ মিলিয়ন ডলার। তবে অবকাঠামো খাতকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলে বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। 

অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান প্রধান অতিথি ও প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ. রহমান বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন। এম এ মান্নান বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চীন বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে কৌশলী ও বিচক্ষণ দেশ। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তিতে চীনের সাথে সম্পর্কের প্রসার চায় বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম সহযোগী দেশ চীন।  

অনুষ্ঠানে 'বাংলাদেশ- অ্যা ল্যান্ড অব ইনভেস্টমেন্ট অপরচুনিটিস ফর চায়নিজ ইনভেস্টরস' শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান মো সিরাজুল ইসলাম। সিরাজুল ইসলাম জানান করছাড়, প্রণোদনাসহ বেশ কিছু সুবিধার পাশাপাশি সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিষয়ে সরকারের গৃহীত জিরো টলারেন্স নীতির কারণে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।  
 
মূল প্রবন্ধে বাংলাদেশে চীনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, এফডিআই নিবন্ধন, বাস্তবায়নের অবস্থা এবং বিদেশি বিনিয়োগে সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া বিভিন্ন সুবিধা তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশে চীনের পক্ষ থেকে বিনিয়োগের সম্ভাবনাময় ৯ টি খাত তুলে ধরেন সিরাজুল ইসলাম।

বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির শীর্ষ পাঁচটি দেশের একটি বাংলাদেশ উল্লেখ করে তিনি জানান, গত অর্থবছরে মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশে ৫.২৪ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করেছে।  
টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য বেসরকারি খাতের সাথে সংযুক্তি, অর্থনৈতিক নীতি সংস্কারের উদ্যোগ ও ১৪.৬২ বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ। 

"বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিনিয়োগের লাভজনক ও নিরাপদ গন্তব্যস্থল বাংলাদেশ, পুনরায় বিনিয়োগের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।" বলেন তিনি। এফডিআই'র অর্ধেকের বেশিই পুনবিনিয়োগ বলে উল্লেখ করেন তিনি।

"গ্রিনফিল্ড, ব্রাউনফিল্ড ও যৌথ উদ্যোগসহ অন্যান্য নানা ধরনের সীমাহীন ব্যবসায়িক সুবিধা আছে এখানে। ব্যাকগ্রাউন্ড লিঙ্কেজের সুবিধাসহ আপনাদের কার্যক্রমে সহায়তার জন্য প্রস্তুত এখানকার শিল্পখাত।" যোগ করেন তিনি।         

২০১৯-২০ অর্থবছরে ১২.০৯ বিলিয়ন ডলার মূল্যের দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে পৌঁছেছে দেশ দুটি। ১১.৪৯ বিলিয়ন ডলার আমদানির বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে চীনে মাত্র ৬০০.১১ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি হয়েছে। ১০.৮৯ বিলিয়ন ডলারের বিরাট এ বাণিজ্য উদ্ধৃত্ত মূল্য চীনা বিনিয়োগকারীদের এদেশে বিনিয়োগের সুযোগ করে দেবে এবং চীন ও অন্যান্য দেশে পণ্য রপ্তানির সুবিধা দেবে। 
১০১৯.৫৩ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের এফডিএ-তে শক্তিখাত পেয়েছে ৩৪২.০৬ মিলিয়ন ডলার। টেক্সটাইল খাত ২৬৫.৩৫ মিলিয়ন, লেদার খাত ১০৬.৩৮ মিলিয়ন ও বাণিজ্য খাত ৪৪.৭৫ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে।          

সিরাজুল ইসলাম বলেন, বিনিয়োগের সহায়ক পরিবেশ থাকায়, বাজারে প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত থাকায় এবং বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শতভাগ ন্যায্যতা থাকায় বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনা তুলনামূলক সহজ। জাতীয়তাবাদের বাইরে গিয়ে বিদেশি বিনিয়োগের স্বার্থরক্ষা নিশ্চিত করা হয় এদেশে। 

বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য অসংখ্য খাত খোলা আছে। তৈরি পোশাক খাত, লেদার, ফার্মাসিউটিক্যালস, এপিআই ও মেডিক্যাল সরঞ্জামাদি, সফটওয়্যার ও আইটি পরিষেবা, কৃষি/খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, কৃষি সরঞ্জামাদি, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য, অটোমোবাইল ও জাহাজ নির্মাণ খাতের কথা উল্লেখ করেন সিরাজুল ইসলাম। 

তিনি আরও বলেন, দেশে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা টিকিয়ে রাখা ও প্রতিষ্ঠানের লাভের কথা বিবেচনায় আকর্ষণীয় সুযোগ দিচ্ছে সরকার। এরমধ্যে আছে নির্দিষ্ট কিছু খাতে ৫-১০ বছরের আয়কর কমানো, ১০ বছর অবধি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড),রপ্তানি আয়ের কর অব্যাহতি, মূলধনের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির আমদানি শুল্ক কমানো।

বাংলাদেশে অবকাঠামোগত উন্নয়নের উদাহরণ হিসেবে মাতারবাড়ি ও পায়রা দ্বীপ সমুদ্র বন্দর, ঢাকা বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনাল, পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, ঢাকায় বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্প, অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাই-টেক পার্কের কথা উল্লেখ করেন সিরাজুল ইসলাম। 

চীনে নিয়োজিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাহবুব উজ জামান চীনা উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের অনুরোধ জানান। বিডাকে দেশের ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নয়নের লক্ষ্যে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। 

এফবিসিসিআই এর সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম অনুষ্ঠানে বলেন, বাংলাদেশ সন্তোষজনকভাবে কোভিড-১৯ সঙ্কট মোকাবেলা করেছে। তৈরি পোশাক খাত, ম্যাশিনারি, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, টেক্সটাইল, সাইবার নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট খাত ও জাহাজ নির্মাণ খাতে বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে চীনা উদ্যোক্তাদের। 

সালমান এফ রহমান অনুষ্ঠানে বলেন, দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকার অবকাঠামো খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। গত দশকে দেশের টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় ছিল, তবে গত বছর কোভিড-১৯ এর আঘাতে তা কিছুটা বাধাগ্রস্থ হয়েছে বলেও জানান তিনি। 

তিনি আরও বলেন, বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার শিল্পায়ন ও বিনিয়োগ নীতিকে উন্মুক্ত রেখেছে। নির্দিষ্ট কিছু দেশের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের ব্যবস্থাও করেছে বাংলাদেশ। এ উদ্যোগে চীনও অন্তর্ভুক্ত আছে বলে জানান তিনি।  

দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সরকার সমান সুবিধার ব্যবস্থা রাখছে এবং স্থিতিশীল দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ নীতি ও বিদেশি লেনদেন নীতির ব্যবস্থা আছে বলে জানান তিনি। বিডা ওএসএস-এর মাধ্যমে অনলাইনে ৪১টি পরিষেবার ব্যবস্থা করেছে এবং এবছরের মধ্যে এসব পরিষেবার সংখ্যা ১৪৬-এ উন্নীত করা হবে বলেও জানান তিনি।  

স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বেল্ট অ্যান্ড রোডের জ্যানেট মিং অনুষ্ঠানে বলেন, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের পূর্বাভাস বলছে এই অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৫.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। আগামী অর্থবছরে এ হার ৭ শতাংশে পৌঁছাতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। 

স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাসের এজাজ বিজয়, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক চায়নার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জেরি চ্যান, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান পাবন চৌধুরীও অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.