বন্ড লাইসেন্স নবায়নের দীর্ঘসূত্রিতায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রপ্তানিমুখী শিল্প

অর্থনীতি

10 August, 2021, 10:40 pm
Last modified: 11 August, 2021, 02:12 pm
প্রতিবছর বন্ড লাইসেন্স ও ইউপি সার্টিফিকেট নবায়নের বাধ্যবাধকতা থাকায় মেয়াদ শেষ হওয়ার পর একটি নির্দিষ্ট সময়ে হয়রানির শিকার হতে হয় লাইসেন্স প্রাপ্ত প্রায় ১৩ হাজার প্রতিষ্ঠানকে

বছরে ৭০০ কোটি টাকার বেশি পোশাক রপ্তানি করে এনজেএম কম্পোজিট টেক্সটাইল (ছদ্মনাম)। প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে তাদের ইউটিলিটি পারমিশন সার্টিফিকেট (ইউপি) নবায়নের আবেদন করে, যা বন্ড সুবিধার মাধ্যমে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের জন্য দরকার হয়। তবে আবেদনের পরও পোশাক রপ্তানিকারক কোম্পানিটি এখনও কোনো সাড়া পায়নি।  

এরই মধ্যে আগস্টের শুরুতে টেক্সটাইল কোম্পানিটির আমদানি করা এবং পোশাক তৈরিতে ব্যবহৃত প্রায় ২ হাজার মেট্রিক টন রাসায়নিক এসে পৌঁছায় চট্টগ্রাম বন্দরে। তবে প্রতিষ্ঠানটির আমদানি পণ্যে ইউপি সুবিধা (ইউটিলিটি পারমিশন বা কাঁচামালের প্রাপ্যতার অনুমোদন) সনদের মেয়াদ উত্তীর্ন হওয়ায় তা আটকে দেয় চট্টগ্রাম কাস্টমস। 

নবায়নের আবেদনে সাড়া না পাওয়ায় গত ১৪ জুলাই অস্থায়ী সনদের জন্যেও আবেদন করেছিল এনজেএম কম্পোজিট টেক্সটাইল। কিন্তু এই সনদও তারা গত ৮ আগস্টের আগে পায়নি।  

ফলে বন্দর থেকে কাঁচামাল খালাস করতে না পেরে উৎপাদন প্রায় বন্ধ তাদের।  

শুধু এনজেএম কম্পোজিট নয়, বন্ড লাইসেন্স ও ইউপি সনদ নবায়নের দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়ায় কারখানা খুলে যাওয়ার পর উৎপাদন চালু রাখতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন অনেক রপ্তানিমুখী কারখানার মালিক।  

ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতিবছর নবায়নের বাধ্যবাধকতা থাকায় মেয়াদ শেষ হওয়ার পর একটি নির্দিষ্ট সময়ে হয়রানির শিকার হতে হয় লাইসেন্স প্রাপ্ত প্রায় ১৩ হাজার প্রতিষ্ঠানকে। বন্দরে কাঁচামাল আটকে থেকে বিপুল ডেমারেজ দিতে হয় রপ্তানিকারকদের। রাসায়নিকের চালান বন্দরে আটকে যাওয়ায় বায়ারদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদনও অনেক সময় ব্যাহত হয়।

নাম-পরিচয় না প্রকাশের শর্তে টেক্সটাইল মিলটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন,"বায়ারদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করতে কিছু কাঁচামাল অন্য ফ্যাক্টরি থেকে ধার করেছি। সব ফ্যাক্টরি তাদের নির্দিষ্ট চাহিদা অনুযায়ী কাঁচামাল আমদানি করে মজুদ করে। ফলে চাইলেও শুধু ধার করে সম্পূর্ণ উৎপাদন কাজ চালানো সম্ভব নয়। তাই ইউপি লাইসেন্স নবায়ন করতে না পেরে উৎপাদন কমাতে হয়েছে।"

"ইউপির জন্য বারবার চেষ্টা করেও ফল পাননি জানিয়ে তিনি বলেন, আবেদন করার পর নিয়মিতই বন্ড কমিশনারেটে যোগাযোগ করা হয়েছে। করোনার কারণে লিমিটেড লোকবল দিয়ে বন্ড কমিশনারেট চলছে। পিয়ন থেকে বিভিন্ন ধাপ পার হয়ে মূল কর্মকর্তার কাছে পৌছানোই যাচ্ছে না,"- যোগ করেন তিনি।  

জুলাই মাসের ১৪ তারিখে চীন থেকে ২৩০ টন কেমিক্যাল আমদানি করে সাভার চামড়া শিল্প নগরীর একটি ট্যানারি প্রতিষ্ঠান- জেড ট্যানারি (ছদ্মনাম)। কোরবানির ঈদের চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে ওই রাসায়নিক আমদানি করা হলেও বন্দর থেকে খালাস করতে না পারায় তা ব্যবহার করতে পারেনি প্রতিষ্ঠিানটি। কারণ বন্দরে পণ্য পৌছার ঠিক তিনদিন আগে, প্রতিষ্ঠানটির বন্ড লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। 

ঈদে ৫০ হাজার চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য থাকলেও; রাসায়নিক ছাড় করতে না পারায় মাত্র ১৫ হাজার পিস কিনেছে ট্যানারিটি। 

প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা বলেন, "সরবরাহকৃত প্রতিষ্ঠানের সময়ক্ষেপনে চালান পৌঁছাতে দেরি হয়। এর মধ্যে সাময়িক আমদানি প্রাপ্যতার আবেদন করা হলেও ঈদের আগে তা দেয়নি বন্ড কমিশনারেট। ফলে এবার ঈদের সম্পূর্ণ ব্যবসা হারাতে হয়েছে।" 
 
লাইসেন্স ও ইউপি নবায়ন জটিলতায় ব্যবসা বন্ধ হয়ে সংকটে ভুগছে 'এনজেএম কম্পোজিট টেক্সটাইল' এবং 'জেড' ট্যানারির মতো বহু রপ্তানিকারক। বন্ড লাইসেন্সের জটিল নিয়ম ও সময়ক্ষেপণের কারণে বিপাকে দেশের রপ্তানি খাতের সব প্রতিষ্ঠান। 

এনিয়ে বাংলাদেশ ট্যানার অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, "মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অডিট ছাড়া নতুন লাইসেন্স নবায়ন করে না বন্ড অফিস। এনবিআর কর্মকর্তারা অডিট করে প্রতিবেদন দিয়ে লাইসেন্স নবায়ন করতে অনেক সময়ই ২-৩ মাস সময় নেয়। এ সময়ে কাঁচামাল এনে বিপাকে পড়েন প্রায় উদ্যোক্তা।"  

বন্ড লাইসেন্সিং হলো শতভাগ রপ্তানির শর্তে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির সুযোগ। পণ্য আমদানির পর প্রতিবছর ইউপি সনদ নিয়ে বন্ড লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানকে বন্ডেড ওয়্যারহাউজে রেখে ওই কাঁচামাল ব্যবহার করতে হয়।

এনবিআরের বন্ড লাইসেন্সিং নীতিমালা অনুযায়ী- বন্ডারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই বাৎসরিক ফি, অডিট রিপোর্ট এবং লাইসেন্সের অডিটের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বন্ড অফিসে জমা দিতে হয়।  

বন্ড কর্মকর্তারা কারখানা অডিট করে পূর্বে আমদানিকৃত কাঁচামালের সঠিক ব্যবহার সাপেক্ষে তা নবায়ন করেন। গার্মেন্টস শিল্পকে তিন বছর ও অন্য সব শিল্পকে এক বছরের জন্য এ নিবন্ধন দেয়া হয়। তবে সব প্রতিষ্ঠানকেই প্রতিবছর ইউপি সনদ নবায়ন করতে হয়। 

সব ডকুমেন্টস ঠিক থাকলে নবায়নের জন্য ৭ কার্যদিবসের কথা বলা হলেও কোনো প্রতিষ্ঠানটিই এই সময়ের মধ্যে তা হাতে পায় না বলে অভিযোগ উদ্যোক্তাদের। অন্যদিকে অডিট সময় সাপেক্ষ হওয়া আইনে সাময়িক সনদপত্র দেয়ার নির্দেশনা থাকলেও তা পেতে বহু হয়রানির শিকার হতে ব্যবসায়ীদের।  

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে গাজীপুর ভিত্তিক একজন পোশাক রপ্তানিকারণ টিবিএস'কে বলেছেন, "অস্থায়ী সনদের অপেক্ষায় বসে থাকার সময় বন্দর থেকে মাল খালাসে দেরি হয়, ফলে পোর্ট চার্জও বেড়ে যায়।"

"মহামারিকালে অস্থায়ী সনদ সংক্রান্ত দীর্ঘসূত্রিতায় খরচ ২০০ গুণ বেড়েছে," বলেও জানান তিনি। 

এ রপ্তানিকারক আরও বলেছেন, সব কারাখানার বন্ড লাইসেন্সের মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ায়, সেগুলোর মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার তারিখ চাইলে আরও তিন মাস (আগস্ট- ডিসেম্বর পর্যন্ত) বর্ধিত করা যায়। মহামারিজনিত পরিস্থিতি আমলে নিয়ে, লাইসেন্স নবায়নের পর চাইলে অডিট করা যেতে পারে।   

দেশের পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন (বিজিএমইএ) এর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, "লাইসেন্স নবায়নের প্রক্রিয়া সহজ করাসহ অস্থায়ী সার্টিফিকেট ইস্যু করার নির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধ করে আমরা এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করেছি।"

"আমাদের অনেক সদস্য ফোন করে অভিযোগ করছেন যে তাঁরা অস্থায়ী সনদ পেতে সমস্যার মধ্যে পড়েছেন। দেশের আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া বাধাহীন করতে খুব দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করা হবে- বলে আমরা আশা করছি," যোগ করেন তিনি।  

আমদানি প্রাপ্যতার ইউপির মেয়াদ এক বছরের বেশি দিলে বা নবায়ন ছাড়াই ব্যবহারের সুযোগ দিলে- তা অপব্যবহার হয় বলে দাবি করছে এনবিআর।

ঢাকা বন্ডের কমিশনারেট এর একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, লাইসেন্স নিয়ে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল এনে কেউ কেউ খোলা বাজারে বিক্রি করে দেয়। ইউপি সনদ নবায়নের বাধ্যবাধকতা না থাকলে প্রতিষ্ঠানগুলো কাঁচামাল ব্যবহারের প্রতিবেদন জমা দেয় না। তখন হিসাবও পায় না এনবিআর। আর এ কারণেই প্রতিবছর নবায়ন জরুরি।" 

হয়রানি নতুন লাইসেন্স পেতেও:  

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেটে লাইসেন্স পেতে আবেদন করে একটি ডিজিটাল এক্সেসরিজ কোম্পানি। সব শর্ত পরিপালন করে আবেদন করার পরও জুলাই মাসে লাইসেন্স হাতে পায় ওই প্রতিষ্ঠানটি। যদিও আইনে বলা হয়েছে, ৩০ দিনের মধ্যে লাইসেন্স দেবে বন্ড কমিশনারেট। 

নিয়ম অনুযায়ী ফি দেয়ার পরও লাইসেন্স পেতে বিভিন্ন কর্মকর্তাদের টেবিলে ঘুরতে হয় বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের বিজিএপিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি তসলিমউদ্দিন চৌধুরী বলেন, "নীতিমালা অনুসারে ১৯টি নথি জমা দেয়ার ৩০ দিনের মধ্যে বন্ড লাইসেন্স নবায়নেরর কথা। কিন্তু বাস্তবে এসব নথি দেয়ার পরও কয়েক মাস ঘুরতে হয়।" 

এসব অভিযোগের ব্যাপারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (কাস্টমস, রপ্তানি ও আইটি) খন্দকার আমিনুর রহমান বলেন, "আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পাইনি। আইন অনুযায়ী দ্রুত নবায়ন করার ব্যবস্থা আমরা করছি। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সঙ্গে বসে সমাধান করা হবে।"  

এদিকে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ, এক বছরের পরিবর্তে বন্ড লাইসেন্স তিন-পাঁচ বছর মেয়াদে দেওয়া যেতে পারে। লাইসেন্সের মেয়াদ পেরোনোর আগেই এনবিআর- এর অডিট করাও উচিত। এর মাধ্যমে মেয়াদ ফুরোনোর আগেই রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে সনদ দেওয়া যাবে।  

বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা পরিচালক ড. এম এ রাজ্জাক বলেন, এ ধরনের লাইসেন্স দীর্ঘমেয়াদে দেওয়া দরকার। তবে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার যেন না হয়- সেটা নিশ্চিতে এনবিআর তাদের অডিট কার্যক্রমকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিতে পারে। 

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.