প্রতিমা-মূর্তি তৈরিতে ঝুঁকছে ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতল শিল্প প্রতিষ্ঠান 

অর্থনীতি

19 August, 2021, 02:50 pm
Last modified: 19 August, 2021, 03:20 pm
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চেয়ে অধিক মুনাফা হওয়ায় মূর্তি এবং প্রতিকৃতি তৈরিতে ব্যস্ত এখন ঢাকার ধামরাই উপজেলার কাঁসা-পিতল ব্যবসায়ী ও শ্রমিকেরা।
ছবি-টিবিএস

গেল কয়েক শতক যাবত কাঁসা-পিতলের তৈরি জিনিসপত্র বিকিকিনির পর এবার বিভিন্ন দেবদেবীর প্রতিমা, মূর্তি এবং জীবজন্তুর প্রতিকৃতি তৈরি ও বিকিকিনিতে ঝুঁকছে ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতল শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা। দেশ ও দেশের বাইরে প্রচুর পরিমাণে চাহিদা রয়েছে কাঁসা-পিতলের তৈরি এসব প্রতিমা, মূর্তি ও প্রতিকৃতির।

নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চেয়ে অধিক মুনাফা হওয়ায় মূর্তি এবং প্রতিকৃতি তৈরিতে ব্যস্ত এখন ঢাকার ধামরাই উপজেলার কাঁসা-পিতল ব্যবসায়ী ও শ্রমিকেরা। বিদেশে রপ্তানি করা গেলে এই শিল্প থেকে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।

দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে রয়েছে কাঁসা-পিতলের তৈরি নানা প্রকার দ্রব্যাদির ব্যবহার। নিত্য-প্রয়োজনীয় কাজে এক সময়ে কাঁসা-পিতলের তৈরি জিনিসের বেশ কদর ছিলো। তবে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকতে পারেনি এই কাঁসা-শিল্প।

স্বাধীনতার আগেও ঢাকার ধামরাই উপজেলায় কাঁসা-পিতলের কারখানার সংখ্যা ছিলো প্রায় ৪০টি। কাঁসা-পিতলের তৈরি জিনিসের জন্য বিখ্যাত ছিলো ধামরাই উপজেলা। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও এর বেশ কদর ছিলো বলে কথিত রয়েছে।

ঠিক কতো বছর আগে ধামরাই উপজেলায় কাঁসা-পিতলের প্রথম শিল্প কারখানা গড়ে উঠে তা স্পষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে ব্রিটিশ শাসন আমল থেকে ধামরাই উপজেলায় এই শিল্পের বেশ প্রসার ঘটতে শুরু করে। 

চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধামরাই উপজেলা সদরে বাড়তে শুরু করে কাঁসা-পিতলের শিল্প কারখানার সংখ্যা। থালা, বাটি, ঘটি, লোটা, গ্লাস, হাঁড়ি-পাতিল, হুক্কা, বাহারি রকমের চামচ, ড্যাগ, কলসসহ নিত্য প্রয়োজনীয় নানা জিনিস তৈরি হতো এসব কারখানায়।

শ্রমিকের কলরবে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মুখরিত থাকতো ধামরাই সদর এলাকা। দেশব্যাপী কাঁসা-পিতলের তৈরি জিনিসের চাহিদা বাড়তে থাকায় এসব শ্রমিকেরা দিন কাটাতেন আনন্দে। লাভবান ছিলেন কারখানা মালিকেরাও।

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। তৈরি হচ্ছে নানা রকমের শিল্প কারখানা। অল্প টাকায় হাতের নাগালে পাওয়া যাচ্ছে প্লাস্টিক, সিলভার, মেলামাইন, সিরামিকস বিভিন্ন কোম্পানীর তৈরি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।

যে কারণে চাহিদা কমেছে ধামরাই উপজেলার ঐতিহ্যবাহী কাঁসা-পিতলের তৈরি জিনিসের। তবে এজন্য বসে নেই কাঁসা-পিতল ব্যবসায়ীরাও। নতুন ব্যবসার স্বপ্ন দেখছেন তারা। কাঁসা-পিতল দিয়ে তৈরি করছেন শত রকমের প্রতিমা, মূতি ও জীবজন্তুর প্রতিকৃতি। পাল্টে গেছে ব্যবসায়িক ধরন।

কারখানায় এখন যা তৈরি হয়ে থাকে

এক সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব ধরণের জিনিসপত্র তৈরি করতো ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতল কারখানার ব্যবসায়ীরা। দেশের বিভিন্ন এলাকার পাইকারদের নিকট বেশ চাহিদা ছিল এসব জিনিসের। সাম্প্রতিক সময়ে চাহিদা কমতে শুরু করেছে এসব জিনিসের।

ফলে ব্যবসায়িক ধরন পালটে ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতল ব্যবসায়ীরা এখন চাহিদা অনুযায়ী কারখানায় তৈরি করছেন বিভিন্ন দেবদেবীর প্রতিমা, মূর্তি এবং জীবজন্তুর প্রতিকৃতিসহ নানান রকমের উপহার সামগ্রী। স্থানীয় বাজারে এর চাহিদাও বেশ।

কিছু ব্যবসায়ী আবার প্রয়োজনের তাগিদে থালা, ঘটি. বাটি, কলসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো টাঙ্গাইল, সাভারের শিমুলিয়া এবং জামালপুরের ইসলামপুর থেকে পাইকারি মূল্যে ক্রয় করেন।

কাঁসা-পিতলের বিকিকিনি

'ধামরাই মেটাল ক্রাফটস, ধামরাই মেটাল হ্যান্টিক্রাফটস, ক্ষিতিস বদনা কারখানা, আনন্দ পাল মেটাল এবং সাহা মেটাল নামের কারখানাগুলো তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে দেদারসে।  

এসব কারখানাগুলোর শো-রুমে কাঁসার থালা বিক্রয় হচ্ছে প্রায় ২৬শ টাকা কেজি। গ্লাসের বাজারদর প্রায় তিন হাজার। কলস বিক্রি হচ্ছে সাতশো টাকা কেজি। বদনা সাত থেকে আটশো টাকা কেজি। আর বিভিন্ন দেব-দেবীর প্রতিমা, মূতি এবং অন্যান্য জিনিসপত্র তৈরি হচ্ছে নকশা এবং ধরণ অনুযায়ী। 

নতুন পণ্য বিক্রির পাশাপাশি পুরাতন কাঁসা-পিতলের জিনিসপত্র স্থানীয়দের নিকট থেকে ক্রয় করেন এসব শো-রুম মালিকেরা। পুরাতন কাঁসার জিনিসপত্রের বাজারদর প্রতি কেজি ১৪শ। আর পিতলের তৈরি জিনিসের দাম প্রতি কেজি চারশো টাকা।  

যেভাবে বদলে গেল কাঁসা-পিতল ব্যবসা

মাত্র চার যুগের ব্যবধানে ধামরাইয়ে ৩৫টি কাঁসা-পিতলের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বিলুপ্তি ঘটেছে। এখন টিকে আছে মাত্র পাঁচটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কাঁসা-পিতলের ব্যবসা পতনের কারণ জানতে চাইলে এখানকার ব্যবসায়ীরা বেশ কিছু বিষয়কে দায়ী করেন। 

এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কাঁসা-পিতলের তৈরি জিনিসপত্রের প্রচার-প্রচারণা কম, অল্প টাকায় হাতের নাগালে প্লাস্টিক, মেলামাইন, সিরামিকস এর পণ্য পাওয়া, মানুষের সচেতনতার অভাব, শ্রমিক সংকট, রপ্তানির সুযোগ না থাকা।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ধামরাই হ্যান্ডিক্রাফটস এর মালিক মো. টুটুল জানান, বংশানুক্রমিকভাবে কাঁসা-পিতলের ব্যবসা করছেন তিনি। বাপ-দাদার আমলে কাঁসার নিত্যপ্রয়োজনীয় তৈজসপত্রের জমজমাট ব্যবসা ছিলো। এখন যার চাহিদা অনেকটাই কম। 

এখন কারখানায় তারা তৈরি করছেন প্রতিমা, মূর্তি, এবং বিভিন্ন প্রতিকৃতি। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, "নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চেয়ে দেব-দেবীর প্রতিমা এবং পশু-পাখিসহ অন্যান্য প্রতিকৃতির চাহিদা বেশি। তবে করোনাকালীন সময়ে ব্যবসায় কিছুটা ভাটা যাচ্ছে"।

এসব ব্যবসার বড় একটি অংশের ক্রেতা বিদেশী পর্যটক। হলি আর্টিজান হামলার পর থেকে বিদেশী অতিথি কমতে শুরু করে। আর করোনাকালীন সময় তা নেমে আসে শূন্যের কোঠায়। তবুও করোনাকালীন সময় পার করতে পারলে ব্যবসায় আবার সুদিনের স্বপ্ন গুনছেন এই ব্যবসায়ী। 

কাঁসা-পিতলের কাজ নিয়ে আলাপ হয় শ্রমিক গোরাঙ্গ পালের সঙ্গে; স্বাধীনতার কিছু সময় পরই কাঁসা-পিতলের কাজে যোগ দেন তিনি। আয়ত্ব করেন অনেক কঠিন কাজের নকশা। এক সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরিতে ব্যস্ত থাকলেও তার ব্যস্ততা এখন প্রতিমা তৈরি নিয়ে। 

করোনাকালে কাজের চাপ কিছুটা কম। লকডাউনের সময় কাজ বন্ধ থাকে পুরোপুরি। এতে করে অনেক সময় পরিবার নিয়ে কষ্ট করতে হয়। তবে কারখানায় কাজ থাকলে বেশ ভালো থাকেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

কাজের অভিজ্ঞতা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসসহ দেবদেবীর প্রতিমা তৈরীতেও তার দক্ষতা বেশ। অতীতে এ কাজ করে ভালো সময় কাটালেও বর্তমানে কাজ কমে যাওয়ায় বিপাকে রয়েছেন তিনি। 

এসব বিষয় নিয়ে আলাপ হয় ধামরাই হ্যান্ডিক্রাফটসের শ্রমিক মিঠু সরকারের সঙ্গে। দুর্গা প্রতিমার কাজে ব্যস্ত থাকা এই শ্রমিক বলেন, "কাজের অভিজ্ঞতার কোন কমতি নেই। কাঁসা-পিতলের কাজ খুব কষ্টের। কষ্ট অনুযায়ী নেই পারিশ্রমিক"। তবুও কারখানায় কাজ থাকলে বেশ ভালো করেই পরিবার-পরিজন নিয়ে চলতে পারেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ধামরাই মেটাল ক্রাফটস শোরুমে ক্রেতার অপেক্ষা বসে থাকা তারা রানী বনিক বলেন, তার স্বামী ফণী ভূষন বনিক বংশানুক্রমিকভাবে কাঁসা-পিতলের চার নাম্বার ব্যবসায়ী ছিলেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলেকে নিয়ে এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেছেন তিনি।

ব্যবসায় এখন কিছুটা মন্দ সময় যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "বিদেশী অতিথিরা কাঁসা-পিতলের মূর্তি বেশ পছন্দ করেন। অতিথি না থাকায় এখন শুধুমাত্র হিন্দু বিয়ের কিছু ক্রেতা আসে অতি প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতে"। 

তাদের শোরুমে বহু দেব-দেবীর প্রতিমা, মূর্তি, জীবজন্তুর প্রতিকৃতি বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা রয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী যে কোন ধরনের প্রতিমা বা প্রতিকৃতি নতুন করে তৈরি করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে শ্রমিক এবং কাঁচামাল রয়েছে বলেও জানান তিনি। 

তারা রানী বনিকের ছেলে সুকান্ত বনিক বলেন, "কাঁসা-পিতলের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছে তাদের ২০০ বছরের পূর্বপুরুষের স্মৃতি। একসময়ে শুধুমাত্র নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদা থাকায় সেগুলো তৈরি করা হতো। তবে এখন ব্যবসায়ের ধরন পাল্টে গেছে। কারখানায় তৈরি করা হচ্ছে নানা রকমের দেব-দেবীর প্রতিমাসহ বিভিন্ন দামী উপহার সামগ্রী"।

দেশ ও দেশের বাইরে এগুলোর বেশ চাহিদা রয়েছে। সহজ শর্তে এগুলো দেশের বাইরে রপ্তানি করা গেলে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে। বদলে যাবে কাঁসা-পিতল ব্যবসায়ীদের ভাগ্যের চাকা। রক্ষা পাবে দেশীয় ঐতিহ্য। এজন্য এসব বিষয়ে সরকার সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি কামনা করেন তিনি। 
 

 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.