পুঞ্জিভূত লোকসানের বৃত্তে সরকারি শ্যামপুর সুগার মিলস
আর্থিক দৈন্যদশার কারণে সংকটে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকল শ্যামপুর সুগার মিলস। বছর গড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কোম্পানিটির লোকসান।
২০১৯-২০ অর্থবছরের নিরীক্ষিত হিসাব অনুযায়ী, শ্যামপুর সুগার মিলসের পুঞ্জিভূত লোকসান ৫০৫ কোটি টাকা।
এক বছরের ব্যবধানে পুঞ্জিভূত লোকসান বেড়েছে ৬০.৬৯ কোটি টাকা অর্থাৎ ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে শ্যামপুর সুগার মিলসের পুঞ্জিভূত লোকসান ছিল ৪৪৪.৮৩ কোটি টাকা।
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বর্তমানে মিলটির কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে।
তবে অন্যান্য ব্যয় চলমান থাকায় ২০২০-২১ সালে ৫০ কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়েছে, যা কোম্পানিটির মোট আয়ের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি লোকসান।
মূলত, পুরনো মেশিনারিজের মাধ্যমে আখ থেকে রস আহরণ ও আশানুরূপ চিনি উৎপাদন না হওয়ায় আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য ধরে রাখতে পারছে না শ্যামপুর সুগার মিলস।
কোম্পানিটি উপজাত হিসেবে গুড়ও তৈরি করে থাকে; স্থানীয় বাজারে চিনি ও গুড় দুটোই বিক্রি হতো।
অর্ধশত বছরের পুরনো এই চিনিকলটিতে বর্তমানে নানান সংকট চলছে।
লোকসান কমাতে ২০২০-২১ অর্থবছরে মিলটিসহ আরও পাঁচটি চিনিকলে আখ মাড়াই স্থগিত করে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন (বিএসএফআইসি)।
বর্তমানে মিলটির উৎপাদন বন্ধ, যার কারণে শ্রমিকদের বেতন-ভাতাও বন্ধ। স্থায়ী কিংবা অস্থায়ী শ্রমিকদের প্রায় ছয়মাসের বেতন বকেয়া। সর্বশেষ মার্চ মাসের বেতন দিয়েছে মিলটি।
স্থায়ী ও মৌসুমী কর্মী মিলিয়ে সুগার মিলটিতে ৪৪৩ জন কর্মী ছিল। তবে বন্ধের কারণে এখন স্থায়ী শ্রমিক রয়েছে ১২৩ জন, কর্মীদের বড় অংশ বিভিন্ন সুগার মিলে বদলি হয়েছে।
আখ সরবরাহকারী চাষীদের পাওনা পরিশোধেও ব্যর্থতার পাশাপাশি চাকুরি থেকে অবসরে যাওয়া শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্রাচু্ইটি দিতে পারছে না শ্যামপুর সুগার মিলস।
মিলটির বর্তমান অবস্থা খুবই খারাপ বলে জানান শ্যামপুর সুগার মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আহসান হাবিব।
তিনি বলেন, "এমন সংকট কখনোই হয়নি। ছয়মাসের বেতন-ভাতা বকেয়া। সবমিলিয়ে প্রচণ্ড সংকটময় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।"
লোকসানের কারণ হিসাবে তিনি বলেন, "মেশিনারিজ অনেক পুরনো, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আখ থেকে রস ও চিনি আহরণ সম্ভব হচ্ছে না। তবে মিলটির অব্যবহৃত জমির পরিমাণ অনেক। এই জমির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতে কিছু বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।"
মিলটির জমির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে একে লাভজনক করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
আয়ের তুলনায় পাঁচগুণ লোকসান
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের মাসিক ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে শ্যামপুর সুগার মিলসের আয় হয়েছে প্রায় ১২ কোটি টাকা।
আর এই আয়ের বিপরীতে লোকসান হয়েছে ৫০.৪৫ কোটি টাকা। প্রতি মাসে গড়ে ৪ কোটি টাকা করে লোকসান করেছে শ্যামপুর সুগার মিলস।
মিলটির সবচেয়ে বেশি লোকসান হয়েছে ২০২০ সালে ডিসেম্বরে। এই মাসে কোম্পানিটির মোট আয় ছিল ৩০.৪২ লাখ টাকা। তবে লোকসান হয়েছে ৮.৫৪ কোটি টাকা।
সরকার মিলটির আখ মাড়াই স্থগিত করার পাশাপাশি শ্রমিকদের বেতন-বকেয়া পরিশোধ করায় বড় লোকসান হয়েছে।
বাড়ছে ঋণ
আয় না বাড়লেও অন্যান্য খরচ চলমান থাকায় লোকসান মেটাতে শ্যামপুর সুগারের ঋণ বাড়ছে।
ঘাটতি মেটাতে সরকারি ব্যাংক থেকে বড় অংকের ঋণ নিয়েছে মিলটি।
সবমিলিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে মিলটির ঋণের পরিমাণ ১৯০.০৯ কোটি টাকা। কোম্পানিটির নিরীক্ষিত হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে এর ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১৪%।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬৭.৫৩ কোটি টাকা।
শ্যামপুর সুগার মিলের স্বল্পমেয়াদী ঋণ ১৬৪.৪৯ কোটি টাকা আর দীর্ঘমেয়াদী ঋণ ২৫.৬০ কোটি টাকা।
দীর্ঘমেয়াদী ঋণ হিসেবে সরকারি ফান্ড, অপারেটিং লোন, বিদেশী ঋণ, গোল্ডেন হ্যান্ডশেক ও সীড মাল্টিপ্লিকেশনস এন্ড রিসার্চে ঋণ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
স্বল্পমেয়াদে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ও জনতা ব্যাংকের কাছে ঋণের পরিমাণ ১৬৪.৪৯ কোটি টাকা। আগের বছর এই ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫২.০৫ কোটি টাকা।
জনতা ব্যাংকের ঋণ ১৭.৭৫ কোটি টাকা আর সোনালী ব্যাংকে ঋণ ১৪৬.৭৬ কোটি টাকা।
এক নজরে শ্যামপুর সুগার মিলস
১৯৬৫-৬৭ সালে সরকার ৬৫.১১ মিলিয়ন টাকা ব্যয়ে শ্যামপুর সুগার মিলস প্রতিষ্ঠা করে।
এটি রংপুরের শ্যামপুরে অবস্থিত। চিনিকলটি ১৯৬৭-৬৮ সালে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করে।
মিলটির ৪৬,৭০০ একর আখচাষের উপযোগী জমি রয়েছে।
মিলের আখ পেষণ সক্ষমতা দিনপ্রতি ১০১৬ মেট্রিক টন এবং বার্ষিক চিনি উৎপাদন ক্ষমতা ১০,১৬০ মেট্রিক টন।
স্বাধীনতার পর থেকে ৭.৬৩% হারে আখ থেকে বছরে গড় চিনি উৎপাদন হয়েছে ৭,১৪০ টন।
তন্মধ্যে সর্বোচ্চ ১২,৮২৫ টন চিনি উৎপাদন হয়েছিল ১৯৮১-৮২ সালে।
শ্যামপুর সুগার মিলস ১৯৯০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। লোকসানের কারণে গত কয়েক বছর কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি কোম্পানিটি।
তবুও গত এপ্রিল মাস থেকে ছয়মাসে কোম্পানির শেয়ার দাম ১৬২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ৬ এপ্রিল কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম ৫০ টাকা থেকে বেড়ে ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দাঁড়ায় ১৩১.৬ টাকা।
তবে সর্বশেষ ১৪ অক্টোবর শেয়ারের দাম কমে দাঁড়িয়েছে ৯১ টাকায়।