পাইকারিতে চালের দাম কমলেও প্রভাব নেই খুচরা বাজারে

গত কয়েক মাস ধরে দেশে চালের দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। সরকারি মজুদ কমে আসার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ আশানুরূপ না হওয়ায় সরকারি অনুমোদন নিয়ে ইতোমধ্যে ভারত থেকে চাল আমদানি শুরু হয়েছে। এতে পাইকারি বাজারে গত কয়েক দিন ধরে কমতে শুরু করেছে চালের দাম।
ব্যবসায়ীদের মতে, গত এক সপ্তাহে পাইকারি বাজারে প্রতি বস্তা চালের দাম ২০০-৩০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। কিন্তু পাইকারি বাজারের দাম কমলেও আগের বাড়তি দামেই চাল বিক্রি হচ্ছে খুচরা পর্যায়ে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মূলত ভারত থেকে স্বর্ণা সিদ্ধ ও মিনিকেট সিদ্ধ জাতীয় চালের আমদানিই সবচেয়ে বেশি হয়। প্রতি বছরের মতো এবারও একই জাতের চাল আমদানি করেছেন ব্যবসায়ীরা। এ কারণে গত কয়েক দিনের ব্যবধানে এ দুটি জাতের চালের দাম বস্তাপ্রতি সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। এর প্রভাবে দেশীয় নতুন চালের দামও বস্তাপ্রতি ১৫০-২০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে।
দাম কমার পাশাপাশি পাইকারি বাজারে চালের বিকিকিনিও আগের চেয়ে কমে গেছে। চাহিদা কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা আগের চেয়ে কম দামে চাল বিক্রি করছেন বলে জানিয়েছেন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, চালের সরবরাহ সংকট ও দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে সরকার আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনে। এরমধ্যে সরকার ৩০০ প্রতিষ্ঠানকে ১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে। এরপর বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান খাদ্য বিভাগের অনুমতি নিয়ে ভারত থেকে চাল আমদানি শুরু করে। এরমধ্যে আমদানিকৃত বেশ কিছু চাল বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশও করেছে। তবে ভারত থেকে চাল আমদানি শুরুর পর পাইকারি পর্যায়ে চালের দাম কিছুটা কমলেও বাজারে এখনো আগের বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে।
পাইকারি থেকে বাড়তি দামে আগে সংগ্রহ করা চাল হঠাৎ করে বড় ধরনের লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে না পারায় খুচরা বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটির দাম সহজে কমছে না বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রামের বৃহত্তর চালের পাইকারি বাজার চাক্তাই রাইস মিল মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি শান্ত দাশগুপ্ত বলেন, বিশ্ববাজার থেকে সরকার ঘোষিত ১০ লাখ টন চাল পুরোদমে আমদানি শুরু না হলে দেশীয় বাজারে প্রভাব পড়তে একটু সময় লাগবে। তবে ভারত থেকে কিছু চাল আমদানি হওয়ায় পাইকারি বাজারে দাম কিছুটা নিম্নমুখী হয়েছে। গত কয়েক মাস চালের বাজারের যে অস্থিরভাব ছিল, তা এখন আর নেই।
চট্টগ্রামের চাক্তাই ও পাহাড়তলী পাইকারি চালের আড়তে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) মিনিকেট সিদ্ধ চালের দাম ৩০০ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৩০০ টাকায়; এছাড়া বস্তাপ্রতি প্রায় ২৫০ টাকা কমে স্বর্ণা সিদ্ধ চাল লেনদেন হচ্ছে ২ হাজার ১০০ টাকায়। অন্যদিকে, সিদ্ধ জিরাশাইল চালের দাম বস্তাপ্রতি ১০০ টাকা কমে ২ হাজার ৮০০ টাকায়, কাটারি সিদ্ধের দাম ১০০ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে বস্তাপ্রতি (২৫ কেজি) ১ হাজার ৩০০ টাকায়, গুটি সিদ্ধ ১০০ টাকা কমে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে, আতপ চালের দাম বস্তাপ্রতি সর্বোচ্চ ২০০ টাকা পর্যন্ত কমে লেনদেন হচ্ছে পাইকারি বাজারে। বর্তমান বাজারে পুরাতন চাল হিসাবে বেতি মানভেদে ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। চিনিগুঁড়া চালের দামে কোনো পরিবর্তন না হয়েই লেনদেন হচ্ছে মানভেদে ৩ হাজার ৮০০ থেকে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৭০০ টাকায়। তবে মিনিকেট আতপ বস্তায় ১৫০ টাকা কমে ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকায়, একইভাবে পাইজার আতপ ১৫০ টাকা কমে মানভেদে ২ হাজার ১০০ থেকে ২ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের দাবি, ভারত থেকে চাল আমদানি শুরুর পর পাইকারি বাজারে উত্তরবঙ্গ থেকে চালের সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের বৃহৎ পাইকারি বাজারগুলোতে লেনদেন কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরাও আগাম চাল ক্রয়ে অনাগ্রহী হয়ে পড়েছেন। আগে প্রতিদিন চট্টগ্রামের বৃহৎ দুটি পাইকারি বাজার চাক্তাই ও পাহাড়তলীতে গড়ে ১৫০ থেকে ২০০ ট্রাক চাল প্রবেশ করত। বর্তমানে সেটি কমে ৫০-৭০ ট্রাকে নেমে এসেছে।
সরবরাহ কমিয়ে চালের বাজার স্বাভাবিক রাখতে ব্যবসায়ীরা ক্রয়ের পরিবর্তে মজুদ চালের দাম ধীরে ধীরে কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাইছেন।
চাক্তাইয়ের চাল ব্যবসায়ী ফরিদ উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, যেকোনো ভোগ্যপণ্যের বাজার চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল। দাম কমে যাওয়ার মিলাররা বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে ভারত থেকে চালের আমদানি শুরু হলেও পাইকারি পর্যায়ে পণ্যটির দামে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি; তবে কিছুটা কমেছে। মজুদ চাল বিক্রির জন্য মিল থেকে সরবরাহ কমিয়ে বাজারকে স্থিতিশীল করতে পাইকারি ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বৃহৎ মিলগুলো চেষ্টা করছে বলে দাবি করেন তিনি।
বলে রাখা ভালো, ২০২০ সালের আমন সংগ্রহ শুরু হয় ৭ নভেম্বর থেকে। তবে সংগ্রহ শুরু হলেও আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছে না খাদ্য বিভাগ। সর্বশেষ গত ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত ২৮ হাজার ৭২৭ টন আমন সিদ্ধ চাল, ১ হাজার ৭৪ টন আতপ চাল এবং ১ হাজার ৬৭৩ টন আমন ধান সংগ্রহ করতে পেরেছে খাদ্য বিভাগ। আমন ধানকে চালে রূপান্তর করলে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারের চাল সংগ্রহ হয়েছে সর্বমোট ৩০ হাজার ৯১৩ টন। মূলত সরকারি পর্যায়ে কৃষকদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে সরকার ক্রমান্বয়ে প্রায় ১০ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে ভারত থেকে শুরুতে আড়াই লাখ টন চাল আমদানি শুরু হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে।
পাইকারিতে কিছুটা কমলেও খুচরা বাজারে এখনো আগের বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে চাল। গত কয়েক মাস ধরে পাইাকারির সঙ্গে খুচরায় চালের দাম পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। কিন্তু আমদানির প্রভাবে পাইকারিতে বস্তাপ্রতি ২০০-৩০০ টাকা পর্যন্ত কমলেও সেই আগের বাড়তি দরেই বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে।
বর্তমানে চট্টগ্রামের বিভিন্ন মুদির দোকান ও খুচরা বাজারগুলোতে প্রতিকেজি সিদ্ধ জিরাশাইল ৬৪ টাকা, পাইজাম ৫৪ টাকা, গুটি স্বর্ণা ৫০ টাকা ও মিনিকেট ৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
একইভাবে প্রতি কেজি আতপ মিনিকেট ৬০ টাকা, বেথি ৫৪ টাকা, কাটারিভোগ ৬৩ টাকা এবং চিনিগুড়া ৯০-৯৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
নগরীর দেওয়ান বাজার এলাকার মুদি দোকানদার মো. ইদ্রিচ বলেন, 'বর্তমানে দোকানে যেসব চাল রয়েছে, তা আগের বাড়তি দামে কেনা। তাই পাইকারিতে দাম কিছুটা কমলেও আমরা হঠাৎ করে কমাতে পারছি না। তবে আমদানিকৃত সিদ্ধ বাজারে আসার পর আমরাও সিদ্ধ চালের দাম কেজিপ্রতি ১-২ টাকা কমিয়েছি।'