নতুন স্বাস্থ্যবিধি চালু হওয়ায় লোকসানের আশঙ্কায় ফ্যাশন খাত

অর্থনীতি

31 March, 2021, 05:00 pm
Last modified: 01 April, 2021, 02:58 am
ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে নতুন বিধি-নিষেধের ফলে উৎসবের পরিসর ছোট হয়ে আসবে, ফলে ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না।  

কোভিড-১৯ সংক্রমণ বৃদ্ধির পরিস্থিতিতে সরকার নতুন করে বিধি-নিষেধ আরোপ করায় বড় লোকসানের আশঙ্কায় পড়েছেন স্থানীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডের উদ্যক্তারা। 

করোনার কারণে এক বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দুই মাস আগে থেকে ইদ ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বড় প্রস্তুতি নিয়েছে পোশাক-জুতাসহ স্থানীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো। তবে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি নতুন করে শঙ্কায় ফেলেছে এ ব্যবসা খাতকে।   

ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে নতুন বিধি-নিষেধের ফলে উৎসবের পরিসর ছোট হয়ে আসবে, ফলে ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না।  

৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি এ বাজারের ৭৫ শতাংশই বিক্রি হয় পহেলা বৈশাখ ও ইদের সময়।

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের বান্টি গ্রামে প্রায় এক যুগ ধরে দেশীয় পোশাক বাটিক উৎপাদন ও বিপণন করছেন মো. বাচ্চু মিয়া। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে অন্তত ১০ লাখ টাকার ব্যবসা করেন তিনি। 

প্রায় ৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা সত্বেও করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে ব্যবসায় বড় লোকসান গুনেছে বাচ্চু মিয়ার মারিয়া বাটিক হাউজ। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর আগের বছরের লোকসান কাটিয়ে উঠতে এবার আরও বড় পরিসরে উৎপাদনে নেমেছেন তিনি। তবে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি শঙ্কায় ফেলেছে ঐতিহ্যবাহী পোশাকের এই ব্যবসায়ীকে। 

মো. বাচ্চু মিয়া দ্যা বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, "ধারদেনা করে এবার ৮ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছি। গত বছরের লোকসান পোষাতে বেশি বিনিয়োগ করতে হয়েছে। তবে নতুন করে সংক্রমণ বাড়ায় এখন ব্যাংক ঋণ, শ্রমিকদের বেতন, কারখানার ভাড়া ও নিজের পরিবার নিয়ে আবার দুঃশ্চিন্তায় পড়েছি।"  

মারিয়া বাটিক হাউজের মতোই অবস্থা আড়াই হাজারের ৮-১০ হাজার উদ্যোক্তার। হারানো পুঁজি পুনুরুদ্ধারের চেষ্টায় পুনরায় হারানোর শঙ্কায় আছেন তারা।   

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির পরিস্থিতিতে গত ২৯ মার্চ নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার। জারি করা প্রজ্ঞাপনে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অন্যান্য সকল ধরনের গণ জমায়েত বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

বিয়ে, জন্মদিনসহ সামাজিক অনুষ্ঠানে গণজমায়েত নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, এছাড়াও গণপরিবহনে ধারণ ক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 

সারাদেশে বিক্রিত স্থানীয় পোশাকের ৭০-৮০ শতাংশের যোগান দেয় ঢাকার কেরানীগঞ্জসহ বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী এলাকার উৎপাদকরা। নিম্ন ও মধ্যবিত্তের পোশাক উৎপাদনের কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত কেরানীগঞ্জের ব্যবসায়ীদের মূল পরিকল্পনা থাকে রোজার ইদকে ঘিরেই। উৎপাদিত পোশাকের ৭০ শতাংশ বিক্রি হয় ইদ-উল ফিতরে।

এখানকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইদের সময় দুই মাসের ব্যবসায় সব ক্ষতি পুষিয়ে একবছর চলার অবলম্বন পান তারা। করোনার কারণে গত বছর ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় কারখানা-শো রুমের ভাড়া, শ্রমিকদের বেতন, মেশিনারি ও কাঁচামাল ক্রয় এবং ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে বিপাকে পড়েছেন তারা। 

গত বছরের বিপদ কাটাতে এবার বেশি করে প্রস্তুতি নিয়েছেন। তবে আবার করোনার সংক্রমণ বিপাকে ফেলছে তাদের। 

কেরানীগঞ্জ জেলা পরিষদ মার্কেটে নিজের কারখানার জিন্সপ্যান্ট পাইকারি বিক্রি করেন গোলেনুর গার্মেন্টেসের মালিক মুক্তার দেওয়ান। ২০১৯ সালের ইদে আড়াই কোটি টাকার জিন্স প্যান্ট বিক্রি করলেও গত বছর তা ছিল মাত্র ২৫ লাখ টাকা। এবার ঈদের জন্য ৩ কোটি টাকার পোশাক বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা হাতে নেন তিনি। 

মোক্তার দেওয়ান দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, "গত বছর বিক্রি করতে না পারায় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ও মূলধন ভেঙ্গে শ্রমিকদের বেতন দিয়েছি, পরিবারের খরচ চালিয়েছি। অনেক কষ্টে কারখানার ও শো-রুমের ভাড়া পরিশোধ করে এবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি আবারও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে বেঁচে থাকার পথ থাকবে না।"  

মোক্তার দেওয়ানের মতোই এখানকার প্রায় ১০ হাজার ব্যবসায়ী ও ৫ হাজারের বেশি কারখানার কারখানা মালিকের কারখানা ও বিক্রয় কেন্দ্রে ব্যবসার গতি কমে এসেছে। 

স্থানীয় পোশাক উৎপাদনের বড় প্রতিষ্ঠান মুসলিম কালেকশনের স্বত্তাধিকারী ও কেরাণীগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজী মুসলিম ঢালী জানান, ব্যাংক ঋণ পরিশোধ ও গত বছরের লোকসান কাটাতে এবার স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি প্রস্তুতি নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এখানকার সব কারখানায় শ্রমিকরা রাত-দিন কাজ করছেন বলে জানান তিনি। 

বড় ব্র্যান্ডগুলোর প্রস্তুতি 

দেশী-দশ, ইয়েলো, সেইলর, জেন্টলপার্ক, ইনফিনিটিসহ দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলোর বিক্রিও বাড়ে ইদ ও পহেলা বৈশাখের সময়। গত বছরের তুলনায় এবারের প্রস্তুতি বেশি বলে জানিয়েছে প্রায় সবগুলো ব্র্যান্ড।  

দেশীদশের অন্যতম ব্র্যান্ড কে ক্রাফট। প্রতিষ্ঠানটির সারাদেশের ২৫টি শো-রুমে এখন পহেলা বৈশাখের পণ্যের সমাহার। 

কে ক্রাফটের বসুন্ধরা শাখার ম্যানেজার শাহজাহান ফিরোজ দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, এবার কালেকশন অন্যবারের চেয়ে বেশি। 

বিক্রি কিছুটা কম এবং করোনার সংক্রমন বৃদ্ধি পাওয়ায় শঙ্কা বেড়েছে বলে জানান তিনি। 

ইয়েলোর হেড অব রিটেইল অপারেশন হাদি চৌধুরী জানান, করোনার কারণে মানুষ গত এক বছর সেভাবে পোশাক-আশাকের পেছনে ব্যয় করেননি। তাই এবার প্রত্যাশা বেশি। 

"করোনার সংক্রমন ঠেকানো আমাদের হাতে নেই। তবে অবশ্যই বিক্রির ওপর এসব নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়বে,"বলেন তিনি।

রঙ বাংলাদেশের এলিফ্যান্ট রোড ব্র্যাঞ্চ প্রধান মনিরুল হক পারভেজ জানান, পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে অন্যান্য যে কোনো বছরের তুলনায় বেশি প্রস্তুতি নিয়েছেন তারা। 

গত বছরের মতো এবারও পহেলা বৈশাখ ও ইদ-উল ফিতরের উৎসব সীমিত হয়ে গেলে ফ্যাশন হাউসগুলো ৬-৭ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির মধ্যে পড়বে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ফ্যাশন ডিজাইনার অ্যসোসিয়েশনের সভাপতি ও অঞ্জনস শোরুমের স্বত্তাধিকারী শাহীন আহমেদ।

তিনি বলেন, পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এ বছর অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের লক্ষ্যমাত্রা তিন হাজার কোটি টাকা। 

"কিন্তু নতুন নিষেধাজ্ঞার কারণে ৫০ শতাংশ কর্মী কাজ করলে বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হবে না," বলেন তিনি।

"আসন্ন উৎসবগুলোর জন্য বড় ব্র্যান্ডগুলো প্রস্তুতি নিচ্ছে। কোভিড-১৯ সংক্রমণ বৃদ্ধিতে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তবে আমি আশা করছি পরিস্থিতি আগের মতো নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবে না," যোগ করেন তিনি। 

আড়ংয়ের একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, আড়ংয়ের বার্ষিক টার্নওভারের ১০ শতাংশ- প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা আসে পহেলা বৈশাখের সময়। 

এবছরের উৎসবের জন্য আড়ং সম্পূর্ণ প্রস্তুত বলে জানান তিনি।

"ইদ-উল ফিতরেই আড়ংয়ের বার্ষিক টার্নওভারের ৩০ শতাংশ আসে। এবছর এখন পর্যন্ত বিক্রি কম হচ্ছে," যোগ করেন তিনি। 

অনিশ্চয়তার মুখে নববর্ষের মেলা

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবছর পহেলা বৈশাখকে ঘিরে বাংলা একাডেমিতে ১০ দিনের মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

ওই মেলায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দেড় শতাধিক উদ্যোক্তা স্টল দিয়ে বসেন। ওই ১০ দিনে একজন উদ্যোক্তা ১০ লাখ টাকা পর্যন্তও মুনাফা করেন। কিন্তু গত বছরের মতো এবারও মেলা বাতিল হলে বড় ধরণের ক্ষতির মধ্যে পড়বেন বুটিক থেকে শুরু করে জামদানি শাড়ি, ফার্নিচার, জুতাসহ স্থানীয় ফ্যাশন সামগ্রী বিক্রি করা কয়েক লাখ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। 

এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের সাথে দেশে অত্যন্ত ২৫ লাখ মানুষের জীবিকা জড়িত। পহেলা বৈশাখে তাদের প্রস্তুতি সবচেয়ে বেশি থাকে। 

"প্রতিবছর পুরো দেশজুড়ে নববর্ষের মেলা হয়। তবে মহামারির কারণে মেলা আয়োজনের নিষেধাজ্ঞা এখনো উঠিয়ে নেওয়া হয়নি। আমরা মেলা আয়োজনের চেষ্টা করে যাচ্ছি," বলেন তিনি। 
 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.