দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে হবিগঞ্জের ‘গৃহিনী’ গুঁড়া মসলা     

অর্থনীতি

শোয়েব চৌধুরী
27 July, 2021, 10:35 am
Last modified: 27 July, 2021, 02:15 pm
আল বারাকা কনজুমার প্রডাক্টসের স্বত্বাধিকারী আলহাজ্ব শামসুল হুদার দাবি, সাশ্রয়ী মূল্যে ভাল গুঁড়া মশলা তৈরী করেন বলেই হবিগঞ্জ জেলাসহ পাশ্ববর্তী জেলাতেও তাদের 'গৃহিনী' মশলার কদর দিন দিন বাড়ছে।

হবিগঞ্জের ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান হেলাল সিলেটের জকিগঞ্জে যাবেন শ্বশুরবাড়িতে। মিষ্টি, বিস্কুট বা ফল নিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি শ্বশুরবাড়ির জন্য কিনেছেন গুঁড়া মশলা। তাও আবার হবিগঞ্জ থেকে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক জকিগঞ্জে কি মশলা পাওয়া যায়না? পাওয়া যায়। কিন্তু তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের পছন্দ হবিগঞ্জের মশলা। তাই যখনই সেখানে যান অন্যান্য জিনিসের সাথে 'গৃহিনী' মশলা নিতে ভুল করেন না। শুধু হেলালই নন, হবিগঞ্জের অনেক গৃহবধু বিভিন্ন উৎসব পার্বণে তাদের আত্মীয়- স্বজন ও প্রিয়জনকে 'গৃহিনী' গুঁড়া মসলা পাঠিয়ে থাকেন।

আল বারাকা কনজুমার প্রডাক্টসের স্বত্বাধিকারী আলহাজ্ব শামসুল হুদার দাবি, সাশ্রয়ী মূল্যে ভাল গুঁড়া মশলা তৈরী করেন বলেই হবিগঞ্জ জেলাসহ পাশ্ববর্তী জেলাতেও তাদের 'গৃহিনী' মশলার কদর দিন দিন বাড়ছে।

প্রবাস ছেড়ে ব্যবসা

হবিগঞ্জ শহরের জালালাবাদ এলাকার বাসিন্দা শামসুল হুদা (৪৮)। শিক্ষক মাওলানা মরহুম আব্দুল কদ্দুছ ও গৃহবধু সজিলা বেগমের ৩ ছেলে ২ কন্যার মধ্যে তিনি সবার বড়। বাল্যকাল থেকেই তার স্বপ্ন ছিল একজন সফল ব্যবসায়ী হওয়ার। 

হবিগঞ্জ বৃন্দাবন সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর  ১৯৯৬ সালের ১৫ জানুয়ারি পাড়ি দেন সৌদি আরবে। 'আল ফিফা' নামে একটি সুপার মার্কেটে ম্যানেজার হিসেবে চাকুরী পান। কিন্তু মন পড়ে থাকে দেশের দিকে। একই সাথে শৈশবের ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্নও তার পিছু ছাড়েনি।

২০০৫ সালে দেশে ফিরেন শামসুল হুদা। বিয়েসহ নানা কাজে ব্যয় হয়ে যায় বিদেশে উপার্জিত অর্থ। কী ব্যবসা করবেন, এ চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।

প্রথমে কয়েকজন বন্ধুর পরামর্শে নেমে পড়েন ধান-চালের ব্যবসায়। পিতার ৫ শতক জমি ১৫ লাখ টাকায় বিক্রি করে নেমে পড়েন ওই ব্যবসায়। একই সাথে নিজ এলাকায় বসান একটি মশলার কল। প্রথম বছরেই চাল ব্যবসায় লোকসানে পড়েন। পূঁজি নেমে আসে ৪ লাখে। এর পেছনে মূল কারণ ছিল বাকিতে বিক্রি করা। ছোট ভাই শিব্বির আহমেদ তখন সৌদিতে থাকেন। তার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে আবারো ধান-চালের ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকেন। ভাবলেন,শুধু ধান চাল নয়, অন্য ধরনের ব্যবসাও করতে হবে।

নিজের উৎপাদিত মসলা পণ্যের পাশে আল বারাকা কনজুমার প্রডাক্টসের স্বত্বাধিকারী আলহাজ্ব শামসুল হুদা

সততা ও নিষ্ঠার ফল

ওই সময়ে হবিগঞ্জ জেলা সদরসহ বিভিন্ন স্থানে খোলাবাজারে ইটের গুঁড়া মিশিয়ে  গুঁড়া মরিচ বিক্রির অভিযোগ উঠে। কিছু ব্যবসায়ী জেলও কাটেন। যার কারণে ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষেরা কলের সামনে দাঁড়িয়ে মরিচ ভাংগাতেন।

ব্যবসায়ী শামসুল হুদা বলেন, তার সততা ও নিষ্ঠা দেখে কিছু ব্যবসায়ী আমার  প্রতি আস্থাশীল হয়ে উঠেন। শত শত কেজি মরিচ তার কলে ভাংগাতে থাকেন। এমনকি পাশ্ববর্তী জেলা মৌলভীবাজার থেকেও ব্যবসায়ীরা তার কলে মশলা ভাংগাতে আসতে থাকেন। এভাবে চলে ১২ বছর।তিনিও  বাড়াতে থাকেন মশলার কলের (মেশিন) সংখ্যা।

যাত্রা শুরু গৃহিনী'র

নিজের আত্মবিশ্বাস ও  ব্যবসায়ীদের আস্থাকে পুঁজি করে একটি ক্ষুদ্রশিল্প গড়ার দিকে মনোনিবেশ করেন শামসুল হুদা। ২০১৬ সালে 'রান্নায় আদি স্বাদ' স্লোগান নিয়ে প্লাস্টিকের বয়ামে গুঁড়া মরিচ, হলুদ, ধনিয়া, জিরা পুরোদমে বাজারজাত শুরু করেন। নাম দেন 'গৃহিনী'।  প্রথমে একজন কর্মচারি নিয়ে নিজেই দোকান ও বাসাবাড়ি থেকে অর্ডার নেয়া ও  ডেলিভারির কাজ করতেন। ব্যবসায়ীদের তিনি এভাবে নিশ্চয়তা দেন যে, গৃহিনী গুঁড়া মশলা যদি ভাল না হয় তবে নিজ খরচে তা ফেরত নেয়া হবে, বাজারের অন্যান্য গুঁড়া মশলার চেয়ে মূল্যও কম থাকবে।

ট্রেডমার্ক, বিএসটিআই, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ ব্যবসা সংক্রান্ত সকল সনদ রয়েছে আল বারাকা কনজুমার প্রোডাক্ট কোম্পানির। 

গুণগতমান ও পুঁজির দিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বিজ্ঞাপন বা প্রচার-প্রচারণা থেকে অনেকাংশেই দূরে ছিলেন শামসুল হুদা। তিনি বলেন, মূলত গৃহবধুরাই ছিলেন তার পণ্যের প্রচারক। স্কুল ও কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীদের মা, খালা, চাচীদের আড্ডায়  মুখে মুখে তার পণ্যের প্রচার হয়েছে বেশী।  

অপপ্রচারকে কানে না নিয়ে পণ্যের মানোন্নয়ন

দেশের স্বনামধন্য বিভিন্ন কনজুমারস প্রোডাক্টের ডিলার ও  বিক্রয় প্রতিনিধিরা  'গৃহিনী' পন্য স্বাস্থ্য সম্মত নয়, বাজারে বেশিদিন ঠিকবে না ইত্যাদি বলে ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের কাছে নানা অপপ্রচার করেছেন। এরপরেও তিনি মনে করেন  বাজারজাতকরণে প্রথমবস্থায় যতটুকু দুর্ভোগ পোহানোর কথা  সেক্ষেত্রে ততটা বেগ পেতে হয়নি।

এর কারণ হচ্ছে সব ব্যবসায়ীকে নিজে না চিনলেও হবিগঞ্জ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি হিসেবে অধিকাংশ ব্যবসায়ীরাই তাকে চেনেন। ফলে মুখ রক্ষার খাতিরেও অনেকে তার পণ্য রেখেছেন। অপপ্রচারকে কানে না নিয়ে বরং পণ্যের মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে আরো সজাগ থেকেছেন জানান ব্যবসায়ী এই নেতা। তার দাবি ইতোমধ্যে দেশের একটি বড় কোম্পানীর গুঁড়া মশলা বিক্রি  হবিগঞ্জ জেলায় হ্রাস পেয়েছে। বিক্রি কমে যাওযায় ওই কোম্পানীর হবিগঞ্জের ডিলারশীপ বাতিল হয়েছে। বর্তমানে যিনি ডিলারশীপ নিয়েছেন তাকে বিশেষ কমিশন দেয়া হচ্ছে। তারপরেও তারা  এগোতে পারছেন না। বর্তমানে গুঁড়া মসলার পাশাপাশি বোতলে কালিজিরা তেল, ইসবগুলের ভুষি, গরম মসলা ও কালিজিরা মিনি প্যাক চালু করা হয়েছে।

তাকে থরে থরে সাজানো গৃহিনীর মরিচের মসলা

জেলা পেরিয়ে বিভাগে সম্প্রসারণ

হবিগঞ্জ জেলা পেরিয়ে আল বারাকার পণ্যকে সিলেট বিভাগের বাকি ৩টি জেলায় সম্প্রসারণের কাজ এগিয়ে চলছে জানিয়ে শামসুল হুদা বলেন, "মানুষ চায় সাশ্রয়ী মূল্যে ভাল মানের পণ্য। সেক্ষেত্রে আমরা বাজারের উন্নতজাতের শুকনো মরিচ, হলুদ, জিরা , ধনিয়া ক্রয় করে থাকি। কারণ কাঁচামাল ভাল না হলে গুড়া মসলার রং, স্বাদ কোনটাই ভাল হয় না। পলিব্যাগের পরিবর্তে প্লাস্টিকের বয়াম থাকায় মশলা সংরক্ষণের জন্য আলাদা কৌটা বা পাত্র কিনতে হয় না। গৃহিনীরাও এই ব্যবস্থাকে পছন্দ করছেন। এছাড়া অন্যান্য কোম্পানীগুলোর গুঁড়া মশলা রঙিন পলি বা কাগজে মোড়ানো থাকে। ফলে এর রং কি তা খোলার আগে বুঝা যায় না। গৃহিনীর মসলা প্লাষ্টিকের বয়ামে থাকায় তা সহজে ক্রেতাদের আকর্ষণ করে। এ পর্যন্ত ৬টি মশলা গুঁড়ার মেশিনসহ প্রায় অর্ধকোটি টাকারও বেশী মূল্যের যন্ত্রপাতি দিয়ে কারখানা চলছে। সামনে আল বারাকা কনজুমার প্রডাক্টস রেডিমিক্স মাংসের মসলা, বিরিয়ানী মসলা, নিজেদের ঘানিতে ভাংগানো সরিষা তেল ইত্যাদিও বাজারে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে"।

তিনি জানান, "জেলার সর্বত্র ছোট-বড় সব দোকানেই আমাদের মসলা পাওয়া যায়। ২ জন বিক্রয় প্রতিনিধির মাধ্যমে ২টি ভ্যানে প্রতিদিন এক থেকে দেড় লাখ টাকার  পণ্য দোকান-পাটে ডেলিভারি দেয়া হয়। যার মাধ্যমে মাসে আয় দাঁড়ায় প্রায় ৩০ লাখ টাকা। কারখানার শ্রমিক ও প্যাকেজিং বিভাগের কর্মচারীদের বেতনসহ অন্যান্য খাত মিলে প্রতিমাসে প্রায় ৪/৫লাখ টাকা ব্যয় হয়ে থাকে"।

শামসুল হুদা বলেন, "বাজারজাতকরণের প্রথমদিনেই আমি লাভের মুখ দেখেছি। সেদিনই মনে হয়েছে সৃষ্টিকর্তা আমাকে ভাল ব্যবসায়ের দিকেই ধাবিত করেছেন"। ব্যবসার পুঁজি বাড়ানোর জন্য ছোট ভাই শিব্বিরসহ আরো তিনজনকে অংশীদার করেছেন। তবে ব্যবসাটি তিনি ও সৌদি ফেরত তার ছোটভাই শিব্বির আহমেদই দেখাশোনা করছেন।

ব্যাংক ঋণের ব্যাপারে জানতে চাইলে শামসুল হুদা বলেন, "আমাদের ব্যবসার অগ্রগতি দেখে একটি বেসরকারি ব্যাংক ৩ কোটি টাকা ঋণ দিতে চেয়েছিল, নেইনি। ব্যাংক ঋণ মানেই সুদ। ইসলাম ধর্ম যেখানে সুদকে হারাম বলছে ,সেখানে 'ঋণ নিয়ে ঘি খাওয়া' আমাদের পছন্দ নয়, তাই গ্রহণ করিনি"।

তিনি আরও জানান,  লন্ডন, আমেরিকা, কানাডা ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসী কিছু ক্রেতা রয়েছেন যারা দেশে আসলে পরবর্তীতে আসার পূর্ব পর্যন্ত যতটুকু প্রয়োজন সে পরিমাণ মসলা নিয়ে যান। তার আশা একদিন গৃহিনী গুঁড়া মশলা দেশের সর্বত্র এমনকি বিদেশের মাটিতেও পাওয়া যাবে।

গৃহবধু ও ব্যবসায়ীদের কথা

মসলা নিয়ে কথা হয় পুরাণ মুন্সেফী আবাসিক এলাকার গৃহবধু তানিয়া ফেরদৌস তরফদারের সাথে। তিনি বলেন, "বাজারে অনেক ধরনের গুঁড়া মশলা পাওয়া যায়। সব কোম্পানীর মসলা ব্যবহার করেছি। কিন্তু গৃহিনী গুঁড়া মসলার গন্ধ ও স্বাদ অনন্য। মসলা হচ্ছে তরকারি ভাল করার প্রধান উপকরণ। যত কষ্ট করেই রান্না করা হোক না কেন, মসলার কারনে তা খাওয়ার অনুপযোগী হতে পারে"। 

আরেকজন গৃহবধু শামিমা বলেন, "গৃহিনী গুঁড়া মসলা সহজে মিশে যায়। এর রং ও স্বাদ অন্য কোম্পানীর মসলা থেকে অনেক ভাল"।

সাহাদত স্টোরের মালিক সেলিম মিয়া বলেন, "দেশের অন্যান্য কোম্পানীর  চেয়ে গৃহিনী মসলা বিক্রি বেশী হয়। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত তাদের পণ্যের মান বজায় রাখায় সারা জেলাতেই এর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে"। 

  
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.