ডিজিটাল পেমেন্ট নেবে ফুচকাওয়ালাও!

অর্থনীতি

29 September, 2021, 11:10 pm
Last modified: 30 September, 2021, 11:31 am
বাংলা কিউআর ভিত্তিক ‘স্ক্যান টু পে’ পরিষেবা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যার মাধ্যমে ডিজিটাল আর্থিক কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত হবে দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।

ধরুন, আপনি একটি পর্যটন স্পটে আছেন। সেখানে ফুচকা খাওয়ার পর দেখলেন আপনার মানিব্যাগে খুচরা টাকা নেই। আছে শুধু ৫০০ বা ১০০০ টাকার নোট। ফুচকাওয়ালাও আপনাকে ভাংতি দিতে পারছেন না।

এই সমস্যার সমাধান অনায়াসেই হয়ে যাবে, যদি দোকানে বাংলা কিউআর ভিত্তিক 'স্ক্যান টু পে' পরিষেবা থাকে। এই পরিষেবার ব্যবহার করে আপনি সহজেই স্মার্টফোনভিত্তিক ব্যাংক বা এমএফএস অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দোকানদারকে টাকা পরিশোধ করতে পারবেন।

বাংলা কুইক রেসপন্স (কিউআর) হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিজাইন করা একটা ইন্টারঅপারেবল কোডভিত্তিক পেমেন্ট পরিষেবা। যার মাধ্যমে সহজেই স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে বিল পরিশোধ করা যাবে। ফলে 'লেস ক্যাশ সোসাইটি হওয়ার পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ব্যাংক বা এমএফএস (মোবাইল ফাইন্যানশিয়াল সার্ভিস) অ্যাকাউন্টে ক্ষুদ্র বিক্রেতাদের ব্যক্তিগত রিটেইল অ্যাকাউন্ট থাকলে তারা এই ডিজিটাল পেমেন্ট পদ্ধতির জন্য বিনামূল্যে বাংলাকিউআর ইউনিক কোড পাবেন। 

ব্যবসায়ীর জন্য এই কিউআরের মাধ্যমে পেমেন্ট নিতে স্মার্টফোনেরও দরকার পড়বে না। তবে পেমেন্ট করার জন্য গ্রাহকদের ইন্টারনেট সংযোগসহ স্মার্টফোন অ্যাপ থাকতে হবে।

বিশেষ করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দেশের আর্থিক খাতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশগুলোর আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে ত্বরান্বিত করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগ সম্প্রতি এই ইন্টারঅপারেবল কিউআর নিয়ে এসেছে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, সবগুলো ব্যাংক ও এমএফএস-কে এই লেনদেন চ্যানেলের অধীনে নিয়ে আসার জোর প্রচেষ্টা চলছে। যাতে একটি মাত্র কিউআর কোড ব্যবহার করে যে কোন ব্যাংক সেবা ভিত্তিক অ্যাপসের মাধ্যমে লেনদেন আরো সহজ হয়।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র এবং নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এটি মাইক্রো মার্চেন্ট অঙ্গনে ডিজিটাল ব্যবসার মাত্রাকে গতিশীল করবে। এই অঙ্গনের বেশিরভাগই আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে আছে। আমরা এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে তাদের আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে আনার চেষ্টা করছি।'

তিনি আরও বলেন, "আমরা শুধু পেমেন্ট ব্যবস্থা নিয়েই কাজ করছি না। দেশব্যাপী ডিজিটাল সেবার মাধ্যমে অন্যান্য ব্যাংকিং কার্যক্রম সহজ করতে এবং গ্রামীণ পর্যায়ে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রতিনিয়ত নতুন সেবা নিয়ে আসছি।"

এই সেবা ব্যবহারের পর মার্চেন্ট ডিসকাউন্ট রেটের (এমডিআর) মূল্য যেন গ্রাহককে দিতে না হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য অধিগ্রহণকারীদের কঠোরভাবে পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেবা প্রদানকারীদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রক্রিয়াকৃত লেনদেনের জন্য ফি ও চার্জ তাদের নিজস্ব নীতিমালার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এই সেবার চার্জ কাঠামো সহজীকরণে আগ্রহী। এজন্য এই কিউআর ব্যবহারকারীর সুবিধার্থে চার্জ কাঠামোতে রদবদল আনতে সংশ্লিষ্টদের উৎসাহ দিচ্ছে। এবং বিষয়টি এখনও আলোচনাধীন আছে।

এর আগে, চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংক খুচরা পর্যায়ে নিরাপদ, সাশ্রয়ী এবং দক্ষ পেমেন্ট ও সেটেলমেন্ট ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মো. মেজবাউল হক স্বাক্ষরিত 'বাংলা কিউআর' সম্পর্কিত একটি নির্দেশিকা প্রকাশ করে।

নির্দেশিকা অনুযায়ী, স্থিতিশীল 'বাংলা কিউআর'ভিত্তিক লেনদেনের ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি দৈনিক ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত লেনদেন করতে পারবেন। যেখানে ব্যাংক হিসাব, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, এমএফএস অ্যাকাউন্ট এবং ই-ওয়ালেট অ্যাকাউন্টসহ বিভিন্ন পেমেন্ট সিস্টেম ব্যবহার করে লেনদেন করা যাবে।

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নিয়ে কাজ করছে এমন সংগঠন এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. মো. মাসুদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এটা একটা খুব ভালো উদ্যোগ। উদ্যোগটি আলোর মুখ দেখলে দেশের আর্থিক খাত উপকৃত হবে। 

"তবে এই অন্তর্ভুক্তির জন্য স্টেকহোল্ডারদের প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগ করতে হবে। বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে শুরুতে ব্যাংকগুলো কোন চার্জ ছাড়া সেবা দিলে মার্চেন্টরা এই পদ্ধতি ব্যবহারে আগ্রহী হবে।"

তিনি আরও বলেন, "এছাড়া এই পেমেন্ট পদ্ধতি জনপ্রিয় করতে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানকেও নিয়মিত নজরদারি করতে হবে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যাতে কোনভাবে আর্থিক জটিলতার মধ্যে না পড়ে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।"

ইতোমধ্যে ৮-১০টি প্রতিষ্ঠান বাংলা কিউআর ইস্যু করার জন্য জন্য কাজ করছে। এছাড়া ৪-৫টি প্রতিষ্ঠান মাঠ পর্যায়ে মার্চেন্ট একাউন্ট খোলার জন্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে যাচ্ছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ও পূবালী ব্যাংক লিমিটেড ইতোমধ্যে বাংলাকিউআরের পাইলট প্রকল্প সম্পন্ন করেছে। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড ও ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডও স্কাই ব্যাংকিং অ্যাপে এই কিউআর যুক্ত করেছে।

এ প্রসঙ্গে পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী শফিউল আলম খান চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এই বৈপ্লবিক উদ্যোগে বাংলাদেশ ব্যাংককে সহযোগিতা করতে পেরে আমরা আনন্দিত। ভবিষ্যতের জীবনধারা সহজীকরণে আমরা সবসময় নতুন প্রযুক্তিকে স্বাগত জানাই।"

বিকাশের কর্পোরেট কমিউনিকেশনসের প্রধান শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বলেন, "বিকাশ গ্রাহকদের সুবিধার জন্য ইতোমধ্যেই কিউআর কোড চালু করেছে। এখন আমরা গ্রাহকদের সুবিধার জন্য বাংলা কিউআর কোডের সাথে মিল আনতে প্রযুক্তিগত একীভূতকরণ নিয়ে কাজ করছি।"

পেমেন্ট গেটওয়ে অ্যাগ্রেগেটর এসএসএলকমার্জ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে বিভিন্ন ব্যাংক ও কার্ড নেটওয়ার্ক অংশীদারদের সাথে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে বাংলাকিউআরের জন্য পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি ব্যবসায়ীর অ্যাকাউন্ট খুলেছে।

সম্প্রতি এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে এসএসএলকমার্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, "এই কিউআর পেমেন্ট পরিষেবার মাধ্যমে সারা দেশের লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা, সাপ্লায়ার, পরিবেশক এবং কারখানা মালিক সরাসরি উপকৃত হবেন।"

মাস্টারকার্ড বাংলাদেশও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের মতো ব্যাংকগুলোর সহযোগিতায় পেমেন্ট প্রদানের জন্য বাংলাকিউআরে অ্যাকসেস দিচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে বাংলাকিউআর অ্যাকসেস দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলতে রাজি করানো কঠিন হবে। কারণ তারা এ ধরনের সেবায় অভ্যস্ত নন। এছাড়াও আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেলের আসলে কর দিতে হতে পারে এমন ভয়ে অনেকে আসতে চাইবেন না।

অন্যদিকে, এই পরিষেবার আওতায় আনতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ভবিষ্যতে ব্যাংক ঋণের অন্যান্য ব্যাংকিং সুবিধা প্রাপ্তি সহজ হবে এমন নিশ্চয়তা দেয়া গেলে তারা আশ্বস্ত হবে। সেবার আওতায় আসতে চাইবে। 

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ভবিষ্যতে নিশ্চিতভাবেই ব্যাংকিং ব্যবস্থা আরও নতুন নতুন সেবা নিয়ে আসবে। সময়ের ব্যবধানে তখন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বাংলাকিউআর আইডির বিপরীতে ঋণে সুযোগ পাবেন কি না, তা বলা যাবে।

তবে স্টেকহোল্ডাররাও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া আশা করছেন। কারণ দেশের বেশিরভাগ মানুষেরই স্মার্টফোন আছে। এছাড়াও কোভিডের কারণে লোকে এখন ডিজিটাল পেমেন্ট পদ্ধতিতে লেনদেন করতেই বেশি পছন্দ করেন। 

এ পরিস্থিতিতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই যুগে দেশে ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থায় বাংলাকিউআর 'গেম-চেঞ্জারের' ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্ট অনেকে। বিশেষজ্ঞরা দ্রুততম সময়ে এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠানগুলোকে একসাথে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন। 

পূবালী ব্যাংকের ডিজিএম ও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ডিভিশনের প্রধান ইন্দ্র মোহন সূত্রধর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, প্রযুক্তিগতভাবে এই পদ্ধতিটি প্রায় জটিলতামুক্ত এবং গ্রাহক সহজেই অ্যাপের মাধ্যমে এটি ব্যবহার করতে পারবেন।

"সুতরাং, ভবিষ্যতে কার্ড বহন করার প্রয়োজন থাকবে না। স্রেফ একটা স্মার্টফোন সাথে থাকলেই চলবে। এছাড়া এমন প্রযুক্তিবান্ধব সেবা ব্যাংকিং ব্যবস্থায় খরচ কমাতে সাহায্য করবে।"
 
তিনি আরও বলেন, "পূবালী ব্যাংকের স্কাই ব্যাংকিং অ্যাপে এই সিস্টেমটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ১৫ দিনের মধ্যে বৃহত্তর পরিসরে কাজ শুরু করার লক্ষ্য নিয়ে আগাচ্ছি আমরা।"

বাংলা কিউআরের দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, কিছু ব্যাংক, পেমেন্ট স্কিম, এমএফএস, পিএসপি ও পিএসও ইতোমধ্যেই ক্লোজ-লুপ কিউআর কোডভিত্তিক পেমেন্টের সুবিধার জন্য তাদের নিজস্ব মান এবং অবকাঠামো প্রস্তুত করেছে। তবে এটি সামগ্রিক পেমেন্ট সিস্টেমের সার্বিক সক্ষমতা নির্দেশ করে না। 

এই প্রেক্ষিতে, বাংলাদেশ ব্যাংক স্টেকহোল্ডারদের সাথে পরামর্শ করে ওপেন-লুপ ইন্টারঅপারেবল কিউআর কোডভিত্তিক পেমেন্টের জন্য এই একটি জাতীয় কিউআর কোড স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের নির্দেশনায় আরো বলেছে, যারা ইতোমধ্যে প্রোপ্রাইটারি স্ট্যান্ডার্ড কিউআর কোড চালু করেছে, তাদেরকে এটা বদলে এ বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে 'বাংলা কিউআর' চালু করতে হবে।

এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, গাইডলাইন ঠিক করার পর ব্যাংক ও এমএফএসগুলো কোভিড পরিস্থিতির কারণে দ্রুত আগাতে পারেনি। মূলত, আগস্ট থেকে ব্যবসায়ী পর্যায়ে বাংলা কিউআর আইডি খোলা শুরু হয়েছে। তাই আমরা এখনই কোন সময়সীমা নিয়ে ভাবছি না। সবকিছু ভালোভাবে আগাচ্ছে। আশা করছি, ব্যাংক ও এমএফএসগুলো দ্রুত বাংলা কিউআর চালু করবে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সংখ্যা কত, সে বিষয়ে কোনো সরকারি তথ্য নেই। সর্বশেষ জরিপ হয়েছিল ২০১৩ সালে। সেই জরিপ অনুসারে, এসএমই'র সংখ্যা—কুটির ও অতিক্ষুদ্র উদ্যোগ বাদে—৭৯ লাখ। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এখন এই সংখ্যা কোটি ছাড়িয়েছে।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.