ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধে চীনের জয়, আর মূল্য পরিশোধ করেছে মার্কিন জনতা

অর্থনীতি

টিবিএস ডেস্ক
13 January, 2021, 09:20 am
Last modified: 15 January, 2021, 04:29 pm
বিশ্বসেরা দুই অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যে লড়াই ট্রাম্প শুরু না করলেও, তিনিই একে ঘোষিত যুদ্ধে রুপ দেন

"বাণিজ্যযুদ্ধ ভালো আর তাতে জেতাও সহজ" ২০১৮ সালে বিখ্যাত এ টুইট করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তখন তিনি সবে চীন থেকে আমদানি করা ৩৬ হাজার কোটি ডলারের পণ্যে শুল্কারোপ শুরু করেছিলেন। কিন্তু, তার মেয়াদের শেষ মুহূর্তে এসে দেখা যাচ্ছে, অন্যান্য বিষয়ের মতো এক্ষেত্রেও, দুটো হিসাবেই ভুল করেছেন ট্রাম্প।  

করোনাভাইরাস অতিমারী লাখ লাখ মার্কিন নাগরিককে সংক্রমিত করে অর্থনীতিকে পর্যদুস্ত করার আগেই যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত ধারাবাহিক শুল্কের ঝঞ্ঝা শক্তহাতেই সামাল দিয়েছে চীন। দেশটির বিরুদ্ধে যেসব পরিসংখ্যানের বরাত দিয়ে ট্রাম্প বানিজ্যযুদ্ধ শুরু করেন, সেগুলোই এখন এমন ইঙ্গিত দিচ্ছে।  

তাছাড়া, চীনা কর্তৃপক্ষ নিজ দেশে মহামারী নিয়ন্ত্রণে সফল হয়। অর্থনীতিও, সচল হয় অন্য দেশের আগে। এরপর বাড়তে থাকে চীনে উৎপাদিত চিকিৎসা ও সুরক্ষা সরঞ্জামের চাহিদা। আরও বাড়ে বিশ্বব্যাপী ঘরে থেকে কাজ করার প্রবণতায় সস্তায় উৎপাদিত ইলেকট্রনিক পন্যের চাহিদা। এসব পণ্যের বিপুল অংশ নিজ চাহিদা মেটাতেই বাধ্য হয়ে কিনেছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে দিনে দিনে বেড়েছে দেশটির সঙ্গে চীনের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত। 

অবশ্য, বিশ্বসেরা দুই অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যে লড়াই ট্রাম্প শুরু না করলেও, তিনিই একে ঘোষিত যুদ্ধে রুপ দেন। আরোপ করেন নজিরবিহীন অতিরিক্ত শুল্ক এবং নিষেধাজ্ঞা দেন চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের উপর। ট্রাম্পের প্রত্যাশা অনুসারে কঠোর এসব সিদ্ধান্ত দিনশেষে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যায়নি। তবে ট্রাম্পের সার্বিক ব্যর্থতা ও কিছু বিষয়ে সফলতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন তার উত্তরসূরি জো বাইডেন।  

ব্যর্থতার জন্য মার্কিন রাষ্ট্রপতির বিবেচনার অভাবকেই দায়ি করেছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। সিরাকোজ ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক ম্যারি লোভেলি বলেন, " বিশ্ব অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখার দিক থেকে চীন একটি অতিবৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ এক শক্তি। চাইলেই তাকে কাগজের পুতুলের মতো কেটে ফেলা সম্ভব নয়। ভুলটি ট্রাম্প প্রশাসন বুঝতে ব্যর্থ হয়।"  

বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি:

২০১৬ সালের নির্বাচনী বছরে চীনের সঙ্গে বিদ্যমান বাণিজ্যের ঘাটতি দূর করে পাল্টা যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্বৃত্তে ফেরানোর অঙ্গীকার করেছিলেন ট্রাম্প। এসময় দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলে মূলধারার অর্থনীতিবিদেরা যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, ট্রাম্প তাতে কান দেননি।  তারপর কেটে গেছে দুটি বছর। এই সময়ে চীনের সঙ্গে বানিজ্যের ঘাটতি পাল্লা দিয়ে বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। গতবছরের নভেম্বর নাগাদ যা ২৮৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়।  

উদ্বৃত্তের স্ফীতি

ট্রাম্প মেয়াদের শেষ সময়ে চীনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের রেকর্ড ঘাটতিতে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র 

বছরওয়ারি হিসাবে, ২০১৯ সালে অবশ্য ঘাটতি কিছুটা কমেছিল। এসময় অনেক মার্কিন কোম্পানি চীন ছেড়ে ভিয়েতনামমুখী হয়। তারপরও, ২০১৬ সালের চাইতেও বেশি ২৫৪ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি দেখা যায়। বাণিজ্যের পাল্লায় চীনের দিক ভারি হওয়ার কারণ, ওই সময় চীন পাল্টা মার্কিন পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্কারোপ করে। ২০২০ সালের শেষ কয়মাসে  এই ঘাটতি কিছুটা কাটিয়ে ওঠা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। 

একবছর আগে স্বাক্ষরিত প্রথম দফার বাণিজ্যচুক্তির আওতায় বিশেষ কিছু শ্রেণির ১৭২ বিলিয়ন ডলারের মার্কিন পণ্য আমদানির উচ্চাভিলাষী অঙ্গীকার করে চীন। কিন্তু, ২০২০ সালের নভেম্বর নাগাদ এই লক্ষ্যের মাত্র ৫১ শতাংশ পূরণ করে দেশটি। অবশ্য, বিশ্বমারীর কারণে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য উৎপাদনের স্থবিরতা এবং বোয়িং এর উড়োজাহাজ রপ্তানির ব্যর্থতা ছিল তার প্রধান কারণ। 

তাছাড়া, ধারাবাহিক ঘাটতি চীনের শিল্পায়িত উৎপাদন সক্ষমতার প্রতি মার্কিন কোম্পানিগুলোর নির্ভরতার দিকটাও তুলে ধরেছে। মহামারীতে তা যেন আরও স্পষ্ট হয়। চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং ঘরে থেকে কাজ করার মতো কম্পিউটার উৎপাদন বৃদ্ধিতে মহামারীর মধ্যেও উজ্জ্বল সফলতা দেখায় চীন। এসব পণ্যের বাড়তি চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উৎপাদনের মাত্রাও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করার একমাত্র নজির স্থাপন করেছে দেশটি। 

সচল চীনের রপ্তানি গতি:

২০০১ সালে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সদস্য হওয়ার পর থেকেই রকেট গতিতে বেড়েছে চীনা অর্থনীতি, ট্রাম্প বহুবার সেকথা উল্লেখ করেছেন। একারণে, তিনি চীনের উত্থানকে অন্যায্য বলে আখ্যায়িত করেন।  বাস্তবে অবশ্য দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ চীনকে রপ্তানি বাজার প্রসারের আরেকটি উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই যেন শুরু করা হয়।  ২০১৫ ও ২০১৬ সালে টানা দুই বছর সঙ্কোচনের পর ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বেড়েছে চীনা পণ্যের জাহাজিকরণ। ২০১৯ সালেও তার ব্যতিক্রম হয়নি, অথচ সেবছর যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি কমে যায়। 

যুক্তরাষ্ট্রমুখী বাজার নির্ভরতা কমাতে রপ্তানি উৎসে বৈচিত্র এনেছে চীন

সিংহভাগ চীনা পণ্যের রপ্তানি বাজার হওয়ার আসন ক্রমশ হারাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র 

২০১৯ সালে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দশটি দেশ একত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বদলে চীনের দ্বিতীয় বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার হয়ে ওঠে। এশিয়ার দিকে বাণিজ্যের এই পাল্লা ভারি হওয়ার প্রবণতা আগামীদিনেও অব্যাহত থাকবে, কারণ আগামী দশকে উন্নত দেশগুলোর চাইতেও দ্রুতগতিতে বাড়বে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার এসব দেশের অর্থনীতি। গত বছরের শেষদিকে স্বাক্ষরিত আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি- আরসেপ এই ব্যবস্থার ভিত্তি আরও দৃঢ় করবে। চুক্তিটির আওতায় জোটভুক্ত ১৫টি দেশ একে-অপরের পণ্যে শুল্কের মাত্রা ধারাবাহিকভাবে কমানোর অঙ্গীকার করেছে। 

ব্লুমবার্গ ইকোনমিক্স কী বলছে ... 
"চার বছরের বাণিজ্য সংঘাত সত্ত্বেও সামান্য প্রভাবিত হওয়ার ঘটনা চীনের উৎপাদন সক্ষমতা তুলে ধরেছে। তবে বাণিজ্যযুদ্ধ চীনা অর্থনীতির বিশেষ কিছু খাত যেমন প্রযুক্তিখাতের দুর্বলতা ও যুক্তরাষ্ট্র নির্ভরতাকে উন্মোচন করেছে" 
                                                                -- চ্যাং শু, ব্লুমবার্গের এশিয়া বিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ

মার্কিন কোম্পানিগুলো চীনেই রয়ে গেছে: 

ট্রাম্প বলেছিলেন, শুল্কের চাপ এড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো চীন থেকে তাদের উৎপাদন কেন্দ্র সরিয়ে নেবে। আর ২০১৯ সালের এক টুইটে, তিনি চীনে ব্যবসা করা সকল কোম্পানিকে 'অবিলম্বে চীনের বিকল্প উৎপাদন উৎস খোঁজার' নির্দেশ দেন। কিন্তু, তার নির্দেশ মেনে সব কোম্পানির চীন থেকে সরে আসার নজির খুব একটা দেখা যায়নি।

বরং, ২০১৬ সালে চীনে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি বিনিয়োগ যেখানে ছিল ১২.৯ বিলিয়ন ডলার, সেটা ২০১৯ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১৩.৩ বিলিয়ন ডলারে। রোডিয়াম গ্রুপের তথ্যসুত্রে একথা জানা যায়।

মার্কিন বিনিয়োগের গতি কমলেও তা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়নি:   

তথ্যচিত্র: ব্লুমবার্গ

গত বছরের সেপ্টেম্বরে সাংহাই- এর আশেপাশে অবস্থিত দুই শতাধিক মার্কিন উৎপাদক সংস্থার উপর এক জরিপ চালানো হয়। অংশগ্রহণকারী দুই- তৃতীয়াংশের বেশি প্রতিষ্ঠান জানিয়েছিল, চীন থেকে কারখানা সরিয়ে নেওয়ার কোনো ইচ্ছেই নেই তাদের।  

এই অনিচ্ছার পেছনে চীনের ক্রমবর্ধমান স্থানীয় বাজারের আকর্ষণকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করে কোম্পানিগুলো। সঙ্গে তারা শক্তিশালী উৎপাদন সহায়ক পরিবেশকেও উল্লেখ করে। পাশাপাশি তারা ব্যবসা সম্প্রসারণের ইঙ্গিতও দেয়। 

"ট্রাম্প প্রশাসন শুল্কের মাত্রা যতোই বাড়াক, তাতে মার্কিন কোম্পানিগুলোর চীনে বিনিয়োগ করার প্রবণতা বন্ধ করা বেশ কঠিন," বলছিলেন কার গিবস। তিনি সাংহাইয়ে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের বর্তমান প্রেসিডেন্ট। 

বাণিজ্যযুদ্ধের মাসুল দিয়েছে মার্কিন ভোক্তারা: 

ট্রাম্প নাছোড়বান্দার মতো দাবি করেন, সব শুল্ক নাকি চীন দিচ্ছে। কিন্তু, সেই ফাঁকি ধরতে পারেন অর্থনীতিবিদেরা। তারা হিসাব করে দেখেন, মার্কিন শুল্কের কারনে চীনা রপ্তানিকারকেরা পণ্যের দর কমাতে বাধ্য হয়নি। তার অর্থ হলো; আমদানিকারক মার্কিন কোম্পানি আর দেশটির ভোক্তারা অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধ করেছেন। 

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের এক গবেষণা সূত্রে জানা যায়, শুল্কের কারণে ২০১৮ সালেই মার্কিন ভোক্তাদের আয় হ্রাস পায় কমপক্ষে ১৬.৮ বিলিয়ন ডলার।

অন্যদিকে, শুল্কের আরেক লক্ষ্য, চীনা পণ্য আমদানি কমানো মার্কিন রপ্তানি হ্রাসে বুমেরাং এর মতো পাল্টা আঘাত হানে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পণ্য উৎপাদনের পারস্পরিক সহযোগিতা ও নির্ভরতার সম্পর্ক তা শুল্কের কারণে বিঘ্নিত হয়। চীন থেকে যন্ত্রাংশ ও অন্যান্য উপকরণ আমদানির করে তা সংযোজন ও রপ্তানি করে অনেক মার্কিন প্রতিষ্ঠান। কিন্তু, সেসব উপকরণে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই শুল্কারোপ করে বিশ্ববাজারে নিজ পণ্যের দাম বাড়াতে ভূমিকা রাখে। 

২০১৯ সালে মার্কিন রপ্তানিতে পতন 
শুধু চীনে রপ্তানি নয়, গোটা বিশ্বেই মার্কিন পণ্য জাহাজে পরিবহনের গতি ছিল স্তিমিত

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.