ঝুঁকিতে ক্ষুদ্রঋণের ছোট প্রতিষ্ঠান

অর্থনীতি

23 June, 2021, 01:20 pm
Last modified: 23 June, 2021, 04:56 pm
ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে কিছু প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি না থাকায় অলস পড়ে থাকছে অনেক প্রতিষ্ঠানের টাকা।

ক্ষুদ্র ঋণের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক সক্ষমতা থাকায় সাময়িক সময়ের জন্য পরিস্থিতি সামালে নিতে পারলেও ঝুঁকিতে পড়েছে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো। ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে কিছু প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি না থাকায় অলস পড়ে থাকছে অনেক প্রতিষ্ঠানের টাকা।

উত্তরাঞ্চল-ভিত্তিক বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ এনজিও ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ'র (টিএমএসএস) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক হোসনে আরা বেগম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমাদের সাথে কাজ করতো এমন ৩২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তিন থেকে চারটি প্রতিষ্ঠান সরকারের নির্দেশনা মেনে সীমিত পরিসরে কাজ করছে। বাকীরা ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।" 

"এদিকে আমাদের মতো বড় প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সীমিত হওয়ার ফলে অলস টাকা পড়ে থাকছে। ১ হাজার কোটির মতো টাকা আমাদের হাতে আছে। গ্রাহকরা আগের ঋণ পরিশোধ না করায় তারাও টাকা চাইছে না। এমন না যে তাদের চাহিদা নেই। তবে টাকা চাওয়ার সুযোগটাও তাদের নেই। কারণ আমরা কম সুযোগ দেইনি।"

খুলনাঞ্চল ভিত্তিক এনজিও প্রতিষ্ঠান সুশীলন এর উপপরিচালক এবং প্রতিষ্ঠানটির মাইক্রো ক্রেডিট উইংয়ের ফোকাল পারসোন মোস্তফা আখতারুজ্জামান বলেন, "বড় এনজিও হলেও আমাদের মাইক্রো ক্রেডিট খুব বড় নয়। সবমিলিয়ে এর আকার ১৮ কোটির মতো হবে। সেখানে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমাদের লোকসান হয় ৯ লাখ টাকা।"

লোকসানের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, "২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ দিকে লকডাউনের মুখোমুখি হওয়ায় এই পরিস্থিতি হয়েছিল। এরমধ্যে গত একবছর কোন কার্যক্রমই চালাতে পারিনি। ২০২০-২১ অর্থ বছরের হিসাব শেষ হলে বলা যাবে কোন পরিস্থিতিতে আছি। তবে এবার ক্ষতির খাতা যে বেশ বড় হবে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।"

"ঋণের কিস্তি নেয়া বন্ধ রেখে একই সময়ে ব্যাংকের টাকা পরিশোধের বাধ্যবাধকতাকে সরকারের দ্বৈত নীতি হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, গত ডিসেম্বরে আমরা ব্যাংক থেকে নতুন করে দেড় কোটি টাকা লোন নিয়ে ঋণ দেয়া শুরু করি। এর আগে আমাদের ১২ কোটি টাকার আরো একটা লোন ছিল।"

"এখন প্রতি কোয়াটারে ৯০ লাখ থেকে এক কোটি টাকার লোনের কিস্তি আমাদের দিতে হচ্ছে। সেখানে কোন ছাড় পাচ্ছিনা। লোকসানের মধ্যে কর্মচারীদের বেতন ভাতা পরিশোধ করতে হচ্ছে। অথচ আমরা সেখানে মাঠ থেকে স্বইচ্ছায় আমাদের কিস্তি পরিশোধ করছে মাত্র ১০ জনে দু্ই জন।"

ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ'র (টিএমএসএস) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক হোসনে আরা বেগম বলেন, "এভাবে চলতে থাকলে বন্ধ হওয়া ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো আর ফিরতেও পারবে না। এদিকে অনেক গ্রহীতার ঋণের কিস্তি পরিশোধ করার সুযোগ থাকলে তারা সরকারের বাধ্যবাধকতার সুযোগ নিয়ে টাকা পরিশোধ করছে না। এটাও একটা বড় সমস্যা।"

তিনি বলেন, "গ্রামীন অর্থনীতি রক্ষায় সরকার আমাদের ঋণ দিতে বলেছেন। আমরা মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথোরিটি (এমআরআই) এর সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে কিস্তি আদায় করা থেকে বিরতও থাকছি। তবে সরকারের সাথে ক্ষুদ্র ঋণের প্রতিষ্ঠানগুলোর কমিউনিকেশন টু ওয়েতে হচ্ছে না বলে অধিযোগ করেন তিনি।"

"গ্রাহকদের কাছে আমাদের দুই হাজার কোটি টাকার মতো বকেয়া। করোনাকালের আগে প্রায় শতভাগ কিস্তি আদায় করা সম্ভব হতো। গ্রাহকরা পরিশোধ করে আবার ঋণ নিত। এখন পরিস্থিতি বদলেছে, আমার মনে হয় না ক্ষুদ্র ঋণের কোন প্রতিষ্ঠান করোনাকালে ৬০ শতাংশের উপরে কিস্তি আদায় করতে পেরেছে।"

পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. জসীম উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমাদের অধীনে যে দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠান আছে তাদেরকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি। যাতে তাদের ক্ষতি কিছুটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়। তবে এটাও ঠিক কার্যক্রম চালাতে না পারলে প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য যেমন সমস্যা। অন্যদিকে গ্রাহকরাও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। তাদের রিকভারি লোনও প্রয়োজন।"

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) এর গবেষণা পরিচালক ড. মনজুর হোসাইন বলেন, "আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি রক্ষা ও দারিদ্র বিমোচনের জন্য এসব প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। পরিস্থিতি বলছে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতা তারা ডিজার্ভ করে।"

"তাদেরকে ইন্টারেস্ট রেট কমিয়ে সহজ শর্ত দিয়ে ঋণ। কিংবা প্রয়োজন হলে সাবসিডি দিয়ে লোন দেয়া যেতে পারে। তবে সেখানে স্পষ্ট করতে হবে তারা প্রান্তিক মানুষের জন্য শর্ত কমাবে, কম সুদে ঋণ দেবে। এতে সরকারের কাজও সহজ হতো, বেনিফিশিয়ারি হতো উভয় পক্ষ।"

মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথোরিটি (এমআরআই) এবছরের ২ মে সীমিতভাবে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দিয়ে একটি সার্কুলার জারি করে। সেখানে স্বাস্থ্যবিধি ও সরকারি অন্যান্য নির্দেশনা মেনে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রম (নতুন ঋণ বিতরণ এবং রেমিটেন্স ও অন্যান্য সামাজিক উন্নয়নমূলক সেবা) অনুমতি দেয় প্রতিষ্ঠানটি। 

এই সার্কুলারে নতুন ঋণ বিতরণের ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও, কিস্তি আদায়ের ব্যাপারে আলাদাভাবে কিছু বলা হয়নি। তবে মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনার মধ্যেও নিয়মিতভাবে ঋণের কিস্তি আদায় করছিল প্রায় সব প্রতিষ্ঠান। কার্যক্রম সীমিত হলেও বন্ধ প্রতিষ্ঠানের তথ্য নেই তাদের কাছে। 

তবে দেশের ক্রমবর্ধমান করোনা সংক্রমণের মধ্যে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে কিস্তি না আদায় করার ব্যাপারে ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে জানানো হয়েছে। 

সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলার চেয়ারম্যান আতাউল হক দোলন বলেন, "করোনা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ায় জেলার করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ সংক্রান্ত পরার্মশ কমিটির সিদ্ধান্তে লকডাউন চলাকালীন সময়ে সকল এনজিওর কিস্তি আদায় স্থগিত করা হয়েছে।" 

পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এ ব্যাপারে নির্দেশনা আসবে বলে জানান তিনি

মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথোরিটি (এমআরআই) এর এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান মো. ফসিউল্লাহ বলেন, "গ্রামের মানুষের এখন টাকা দরকার। তারা ঘুরে দাঁড়াতে চায়। এজন্য সীমিত পরিসরে ঋণ বিতরণের অনুমতি দেয়া হয়েছে। তবে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখনো কিস্তি আদায়ের অনুমতি দেয়া হয়নি।"

এই অবস্থাকে উভয় সংকট হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "সরকারের সাথে আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছি। সেই প্রেক্ষিতে আপাতত ঋণ দেয়াটা চালু করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।"

মানুষের জীবন-জীবিকার সাথে গ্রামীণ অর্থনীতি বাঁচিয়ে রাখতে প্রতিষ্ঠানগুলোর কথাও সরকারের ভাবনায় আছে বলে জানান তিনি। 

সরকারের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে তিন কোটির বেশি মানুষ ক্ষুদ্র ঋণের গ্রহীতা। ঋণ গ্রহীতাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ঋণ আদায় করা যাচ্ছে না, আবার আদায় করা যাচ্ছে না বলে ঋণ বিতরণও কমে গেছে। ফলে যাদের ঋণের প্রয়োজন তারা ঋণ পাচ্ছে না।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.