চীন বিপুল ব্যয় করছে, না সুদের মহাজনী?

অর্থনীতি

টিবিএস ডেস্ক
30 September, 2021, 08:45 pm
Last modified: 30 September, 2021, 08:49 pm
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া রাজ্যের উইলিয়াম অ্যান্ড মেরি ইউনিভার্সিটিতে অবস্থিত এইড-ডেটা রিসার্চ ল্যাবের তথ্যমতে, গত ১৮ বছরের সময়কালে ১৬৫টি দেশের ১২,৪২৭টি অবকাঠামো প্রকল্পে মঞ্জুরি বা ঋণ হিসেবে ৮৪ হাজার ৩০০ কোটি ডলার দিয়েছে চীন। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য অর্থনৈতিক শক্তির চেয়ে কমপক্ষে দ্বিগুণ উন্নয়ন সহযোগিতা দেয় চীন।  চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বেশিরভাগ ঋণ দিচ্ছে, যাতে অধিক সুদের কারণে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। 
  
চীনের ঋণদানের বিপুলতাও হতবাক করে দেওয়ার মতো। অথচ মাত্র তিন-চার দশক আগেও বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল দেশটি, সে দৃশ্যপট এখন সম্পূর্ণ বদলে গেছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া রাজ্যের উইলিয়াম অ্যান্ড মেরি ইউনিভার্সিটিতে অবস্থিত এইড-ডেটা রিসার্চ ল্যাবের তথ্যমতে, গত ১৮ বছরের সময়কালে ১৬৫টি দেশের ১২,৪২৭টি অবকাঠামো প্রকল্পে মঞ্জুরি বা ঋণ হিসেবে ৮৪ হাজার ৩০০ কোটি ডলার দিয়েছে চীন। 

বেশিরভাগ অর্থই দেওয়া হয়েছে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড কৌশল বাস্তবায়নে। ২০১৩ সাল থেকে শুরু হওয়া এ মহাকর্মযজ্ঞে অবকাঠামো নির্মাণে দক্ষতা ও পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের কারণে নতুন বৈশ্বিক বাণিজ্যপথগুলো তৈরিতে চীনই এগিয়ে রয়েছে। 

ঋণের পাহাড়সম বোঝা:

তবে সমালোচকদের আশঙ্কা, উচ্চ সুদের চীনা অর্থায়নের এসব প্রকল্প অনেক দেশের জনতার অগোচরেই তাদের কাঁধে পর্বতপ্রমাণ ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে।  

এখন চীনা কর্মকর্তারাও এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছেন। 

এইডডাটার গবেষকরা চার বছর ধরে অনুসন্ধান করেছেন - চীনের দেয়া ঋণ সারা বিশ্বে কোথায় কোথায় যাচ্ছে এবং তা কীভাবে খরচ করা হচ্ছে। তারা বলছেন, চীন সরকারের মন্ত্রণালয়গুলো নিয়মিত তাদের কাছ থেকে তথ্য নিচ্ছেন যে তাদের অর্থ বিদেশে কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

চীন আর লাওসের সংযোগকারী ইউমো রেললাইন প্রকল্পের কাজ চলছে। ছবি: বিবিসি

একটি দৃষ্টান্ত: লাওস-চীন রেললাইন প্রকল্প

দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে চীনা রাজনীতিকরা ভূবেষ্টিত দক্ষিণপশ্চিম চীনের সঙ্গে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সংযোগ প্রতিষ্ঠার কথা ভেবেছেন। 

তবে বাদ সাধেন প্রকৌশলীরা, তারা সাফ জানিয়ে দেন খরচ অসাধ্য হতে পারে। 

তারা বলেছিলেন, অনেকস্থানে খাঁড়া পাহাড়ের গা বেয়ে রেললাইন স্থাপন করা দরকার, ফলে বেশকিছু ব্যয়বহুল রেলসেতু ও সুড়ঙ্গ নির্মাণ করতে হবে। তাছাড়া, অবকাঠামো ঋণ নেওয়া দেশগুলো এই ব্যয় শোধ করতে পারবে কিনা- তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। 

যেমন বলা যায়, লাওসের কথা- আঞ্চলিকভাবে অন্যতম এ দরিদ্র দেশের এত বিপুল ব্যয়ের, সামান্য অংশ শোধ করার ক্ষমতাও নেই।  

কিন্তু, পরিস্থিতি বদলে যায় দৃশ্যপটে চীনের উচ্চাভিলাষী ব্যাংকারদের আগমনে। রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর সমর্থনে রাষ্ট্রীয় ঋণ-দাতাদের একটি কনসোর্টিয়াম এ প্রকল্পে সহায়তা দিয়েছে। মোট ৫৯০ কোটি ডলারের সেই রেললাইন এখন চালু হবার পথে। ডিসেম্বর মাসেই এতে ট্রেন চলাচল শুরু হবার কথা।

তবে বিপুল এই লগ্নীর একটি ছোট্ট অংশ লাওসকে দিতে হচ্ছে, সে জন্য দেশটিকে চীনের একটি ব্যাংক থেকে ৪৮ কোটি ডলার ঋণ নিতে হয়েছে। ঋণের জামানত ধরা হয়েছে, লাওসের পটাশ খনিগুলো, যা স্বল্প আয়ের দেশটির অন্যতম রাজস্ব উৎস। 

এব্যাপারে হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যাপক ওয়ানজিং কেলি চেন মন্তব্য করেন, "চীনের এক্সিম ব্যাংক (লাওসকে) যে ঋণ দিয়েছে, তা যত দ্রুত সম্ভব এই প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের ব্যগ্রতা প্রকাশ করেছে।"  

রেলপথের সিংহভাগের মালিকানা পাবে চীন নিয়ন্ত্রিত একটি রেলওয়ে গ্রুপ। তারপরও, অস্পষ্ট এক চুক্তির আওতায় রেলওয়ে দেনাগ্রস্ত হলে- সে দায়ভার বহন করবে লাওস সরকার। এ ধরনের ভারসাম্যহীন চুক্তি করায় আন্তর্জাতিক ঋণদাতারা লাওসের ক্রেডিট রেটিং বা ঋণমান প্রায় 'রদ্দির' কাতারে নামিয়ে এনেছে।  

এর আগে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে দেউলিয়াত্বের প্রান্তে পৌঁছে যায় লাওস সরকার। চীনা ঋণদাতাদের চাপ কমাতে এসময় দেশটি ৬০ কোটি ডলার মূল্যের একটি বৈদ্যুতিক গ্রিড চীনের কাছে বিক্রি করে, যা ছিল দেশটির অন্যতম বড় এক সম্পদ। আর রেলপথের কাজ শুরু হওয়ার আগেই এসব কিছু ঘটে যায়। 

লাওস রেলওয়ের মতো বহু ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্পে অর্থায়ন করলেও, অনেক স্বল্প ও মধ্য আয়ের দেশের কাছে সহজে ঋণ পাওয়ার জন্য চীনই প্রথম গন্তব্যস্থল বলে জানিয়েছে এইড-ডেটা'র গবেষণা। 

গবেষক ব্র্যাড পার্কস বলেছেন, "প্রতিবছর চীনের বৈদেশিক অর্থায়ন প্রতিশ্রুতি গড়ে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি ডলার। সে তুলনায়, এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের গড় খরচ মাত্র ৩ হাজার ৭০০ কোটি ডলার।" 

উন্নয়ন প্রকল্প অর্থায়নে চীন সকল দেশকে পেছনে ফেলেছে। কিন্তু, যেভাবে দেশটি এ পর্যায়ে পৌঁছেছে তা 'অস্বাভাবিক' বলে এইড-ডেটা উল্লেখ করে। 

অতীতে, বিশেষত আফ্রিকার দেশগুলোকে দেনার জালে জড়ানোর জন্য দায়ী পশ্চিমা দেশগুলো। কিন্তু, চীন ভিন্নভাবে ঋণ দিচ্ছে। উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে চুক্তির আওতায় ঋণ দেওয়ার বদলে, সিংহভাগ অর্থই চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ইস্যুকৃত ঋণ হিসেবে দেওয়া হচ্ছে।  

এ ধরনের ঋণদানের সবচেয়ে বড় সমস্যা- সরকারি দেনার আনুষ্ঠানিক হিসাবে এটি উঠে আসে না। কারণ, বেশিরভাগ চুক্তির ক্ষেত্রেই চীনের কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থাগুলোর নাম উল্লেখ করে না- চুক্তিকারী চীনা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। চুক্তির গোপনীয়তার শর্তাবলীর অধীনে বেশিরভাগ সময় ঋণ গ্রহণকারী সরকারও রুদ্ধদুয়ার আলোচনায় তাদের প্রতিনিধিরা সুনির্দিষ্টভাবে কোন শর্তে সম্মতি দিয়েছে তাও জানতে পারে না।  

এধরনের আনুষ্ঠানিক হিসাবের বাইরে থাকা ৩৮ হাজার ৫০০০ কোটি ডলারের দেনার হিসাব করেছে এইড-ডেটা। 

আবার রাষ্ট্রীয়ভাবে দেওয়া চীনের অনেক উন্নয়ন ঋণেও ব্যতিক্রমী সব জামানতের দাবি থাকে। প্রাকৃতিক সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে পাওয়া অর্থ থেকে দেনা শোধ করা হোক- ঋণগ্রহীতা সরকারের ওপর চীনা দাতাদের এমন শর্ত দিন দিন বাড়ছে। 

যেমন ভেনিজুয়েলাকে দেওয়া একটি ঋণচুক্তির আওতায় শর্ত ছিল, তেল বিক্রির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা চীন নিয়ন্ত্রিত একটি ব্যাংক একাউন্টে সরাসরি জমা দিতে হবে। সরকার কোন কারণে দেনার কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে, চীনা আর্থিক সংস্থাটি সঙ্গে সঙ্গে একাউন্টে থাকাএকই পরিমাণ অর্থ কেটে রাখবে।   

ব্রাড পার্কসের মতে, সত্যিকার অর্থে এটি শুনতে রুটি-রুজি যোগান দেওয়ার মতোই শোনায়, কিন্তু এরমাধ্যমে ঋণগ্রহীতাকে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এখানে ঋণদাতার মর্জিই শেষকথা।

এর মাধ্যমে তারা একটি সরল বার্তাও দিচ্ছে, "অন্য সবার আগে তোমাকে আগে আমাদের ঋণ শোধ করতে হবে, কারণ একমাত্র আমরাই মূল্যবান সম্পদ জামানত নিয়েছি।"

পার্কস আরও বলেন, অথচ প্রাকৃতিক সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অতি-গরীব কিছু দেশের একমাত্র আয় উৎস, যা এখন বিদেশী শক্তি নিয়ন্ত্রিত অফশোর ব্যাংক একাউন্টে জমা থাকছে। 

এইড-ডেটার গবেষণায় জড়িত থাকা জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক অ্যানা গেলপার্ন- চীন কী চাতুর্য অবলম্বন করছে কিনা- সে প্রশ্ন রাখেন। 

তিনি বলেন, "আমাদের গবেষণার উপসংহার হলো; তারা অনেক বেশি চাপ প্রয়োগে বিশ্বাসী এবং চুক্তির শর্তাবলী তৈরিতে অত্যন্ত দক্ষ। তারা শুধু নিজেদের স্বার্থ রক্ষার কাজই করছে।

তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, ঋণগৃহীতা হিসেবে একটি দেশকে সামলানো খুবই ঝক্কির বিষয়। দেনা শোধে ব্যর্থ হলে দেশটির সরকার বন্দরের মতো একটি স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর করবে- এমন চিন্তা করাও বাস্তবসম্মত নয়। কিন্তু, শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। 

গণচীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ছবি: ইপিএ

ঋণদানের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা:

ঋণদানে চীনের অগ্রগ্রামী অবস্থান ঠেকাতে খুব শিগগির ব্যয় বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে জি-৭ জোট। গত জুনের বৈঠকে এমন সিদ্ধান্তও হয়। ঘোষিত অঙ্গীকার অনুসারে, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দিক থেকে টেকসই বৈশ্বিক অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়ন করবে জি-৭।

তবে জি-৭ এর এ পরিকল্পনা হয়তো অনেক দেরি করে ফেলেছে। 

 ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো এবং চীনে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক বাণিজ্য প্রতিনিধি ডেভিড ডলার বলছেন, "পশ্চিমা বিশ্বের উদ্যোগ চীনের কার্যক্রমে কোন আঁচড় কাটে পারবে কিনা- তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।"  

তার মতে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবকাঠামোর প্রয়োজন মেটানোর মত অর্থ এসব উদ্যোগে নেই, তাছাড়া পশ্চিমা সরকারি অর্থায়নের প্রক্রিয়ায় অনেক আমলাতান্ত্রিকতা এবং বিলম্ব হয়ে থাকে।

এইডডাটার গবেষকরা বলছেন, চীনের বেল্ট এ্যান্ড রোড প্রকল্প (বিআরআই) নিজেও কিছু সমস্যার সম্মুখীন।

তাদের মতে, বিআরআইএর প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে দুর্নীতি, শ্রম কেলেংকারি বা পরিবেশগত সমস্যা দেখা দেবার সম্ভাবনাও চীনের অন্য চুক্তিগুলোর তুলনায় বেশি।

গবেষকরা বলছে, বিআরআই প্রকল্পকে চালু রাখতে হলে বেজিংকে ঋণগ্রহীতার উদ্বেগগুলো বিবেচনায় নিতেই হবে।


সূত্র: বিবিসি 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.