চীন না, আগে বাংলাদেশকে পেছনে ফেলতে হবে ভারতের

অর্থনীতি

অ্যান্ডি মুখার্জি
19 October, 2020, 06:50 pm
Last modified: 20 October, 2020, 08:43 am
১৯৯০ এর দশকে মুক্তবাজার ব্যবস্থায় প্রবেশ করার পর থেকেই স্থানীয় উৎপাদন অর্থনীতিকে দিনে দিনে চীনের মতো দ্রুত সম্প্রসারণের লক্ষ্য নিয়েছিল ভারত। টানা তিন দশক ধরে সেই লক্ষ্য অর্জনে আপ্রাণ চেষ্টার পর- বাংলাদেশের পেছনে চলে যাওয়াটা তাই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভারতের মর্যাদা কমিয়েছে। 

চলতি সপ্তাহেই ভারতে কোভিড-১৯ অতিমারি সৃষ্ট মন্দা আরও হতাশার বার্তা দেয়। গণমাধ্যমের আলোচিত সংবাদ ছিল, চলতি ২০২০ অর্থবছরে প্রতিবেশী বাংলাদেশের চাইতেও কম গড় পণ্য ও সেবা উৎপাদন প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস।  

এব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু এক টুইট বার্তায় বলেন, ''উদীয়মান একটি অর্থনীতি ভালো করছে তা অবশ্যই শুভ সংবাদ। কিন্তু, পাঁচ বছর ধরে কমপক্ষে ২৫% এগিয়ে থাকার পর এখন ভারতের অর্থনীতি যে বাংলাদেশের পেছনে অবস্থান করছে, সেটাই বিস্ময়কর।''

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তাদের পূর্বাভাসের সর্বশেষ সংশোধনী ঘোষণার পর, ভারত ও বাংলাদেশের অর্থনীতির হালচিত্র সম্পর্কে তিনি এমন কথা বলেছেন।

১৯৯০ এর দশকে মুক্তবাজার ব্যবস্থায় প্রবেশ করার পর থেকেই স্থানীয় উৎপাদন অর্থনীতিকে দিনে দিনে চীনের মতো দ্রুত সম্প্রসারণের লক্ষ্য নিয়েছিল ভারত। টানা তিন দশক ধরে সেই লক্ষ্য অর্জনে আপ্রাণ চেষ্টার পর- বাংলাদেশের পেছনে চলে যাওয়াটা তাই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভারতের মর্যাদা কমিয়েছে। 

পশ্চিমা দেশগুলো চীনের উত্থান রুখতে চায়। চীনকে ঠেকাতে একটি বলিষ্ঠ সহযোগী দেশ চাইছে। ভারতের নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশের কাতারে পড়ে না থাকার উপরই পশ্চিমাদের সহযোগী হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে।

করোনাভাইরাস মহামারি অবশ্যই দায়ি, কিন্তু তারপরও পর্যবেক্ষকরা প্রশ্ন তুলছেন, ভুলটা আসলে কোথায় বা কিভাবে হয়েছে? 

মধ্য জুনে বাংলাদেশে নতুন সংক্রমণের হার সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে যায়। কিন্তু, ভারতের সংক্রমণ হার কেবলমাত্র পড়তির দিকে আসছে। বিশ্বে একদিনে সবচেয়ে বেশি কোভিড-১৯ সংক্রমণ সংখ্যা এর আগে ভারতেই রেকর্ড করা হয়। 

সাড়ে ১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশে মহামারিতে ৫,৬০০টি'র কম প্রাণহানি হয়েছে। আর ভারতের জনসংখ্যা এর আটগুণ। কিন্তু, মৃতের সংখ্যা ছিল ২০গুণ বেশি। 

সবচেয়ে খারাপ ঘটনা হচ্ছে; রোগ বিস্তার ঠেকাতে দেশজুড়ে অর্থনীতিকে লকডাউনের আওতায় আনা হলেও- তা ভাইরাসের বিস্তার রোধ করতে পারেনি। বরং মোট উৎপাদনের ১০.৩% হারিয়ে গেছে। আইএমএফ জানায়, বিশ্ব অর্থনীতি সার্বিক যে ক্ষতির মুখে পড়বে এটা তার চাইতেও আড়াইগুণ বেশি। 

রাজস্ব ঘাটতির দরুণ বাজেট বরাদ্দে কৃপণতা, অপর্যাপ্ত মূলধনের আর্থিক খাত এবং গত কয়েক বছর ধরে চলে আসা বিনিয়োগের ঘাটতি কোভিড পরবর্তী সময়ে ভারতে নতুন চাহিদা সৃষ্টির সহায়ক হবে না। কিন্তু, শুধুই কী মহামারি দায়ি? 

সবচেয়ে খারাপ খবর হলো, মহামারি না আসলেও একসময় বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিযোগীতায় হারতেই হতো। গবেষণায় এর কারণ ব্যাখ্যা করেছেন অর্থনীতিবিদ সৌমিত্র চ্যাটার্জি ও পেনিসিলভেনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আরবিন্দ শুভ্রামনিয়াম। দ্বিতীয় জন ভারত সরকারের মূখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টাও ছিলেন। 

তাদের নিবন্ধের শিরোনাম ছিল; 'ভারতের রপ্তানি ভিত্তিক প্রবৃদ্ধি, গতি-প্রকৃতি এবং ব্যতিক্রম।'

ব্যতিক্রম হিসেবে তারা ভারতকে উদাহরণ হিসেবে দেন। তবে, বাংলাদেশকে তারা ব্যতিক্রম বলেননি। বরং বলেছেন, বাংলাদেশ ভালো করার কারণ ইতোপূর্বের 'এশিয়ান টাইগার' হয়ে ওঠা দ্রুত প্রবৃদ্ধির দেশগুলোকে অনুকরণ করছে।   

বাংলাদেশের বেশিরভাগ রপ্তানি পণ্য বাস্তবতা সহযোগী, যা কর্মক্ষম তরুণ জনগোষ্ঠী কাজে লাগিয়ে তুলনামূলক কম দক্ষতা দরকার হয় এমন পণ্য উৎপাদন এবং রপ্তানির ভালো উদাহরণ। বাংলাদেশের চাইতে অনেক বেশি এগিয়ে রয়েছে ভিয়েতনাম। কিন্তু, উভয় দেশই চীনের অতীত অর্থনীতিকে অনুসরণ করছে। 

আজকের অবস্থানে আসার আগে চীন দীর্ঘ কয়েক দশক সস্তা শ্রমকে কাজে লাগিয়ে কম দক্ষতা দরকার এমন পণ্য উৎপাদন এবং তা বিশ্ব বাজারে বিক্রি করে এবং উচ্চ- প্রবৃদ্ধির রেকর্ড ধরে রাখে। 

ভারত অবশ্য আরেক পথে হাঁটে। শত কোটির বেশি জনসংখ্যার সুবিধা নিয়ে কম দক্ষতা ভিত্তিক শিল্প বিকাশে মনোযোগ দেওয়া হয়নি। 

''বিশ্ববাজারে পোশাক এবং বস্ত্রবয়ন শিল্প ১৪ হাজার কোটি ডলার আয়তনের। এটি ভারতের সামগ্রিক অর্থনীতির ৫ শতাংশ এবং এই কম দক্ষতার শ্রমঘন শিল্পের উৎপাদনে ভারত অনেক পিছিয়ে পড়েছে,'' গবেষকদ্বয় উল্লেখ করেন। 

তথ্যচিত্র: ব্লুমবার্গ

এখানে শিল্প সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির দিকেও নজর দেওয়া দরকার। ২০১৯ সালে প্রায় ১২ হাজার কোটি ডলারের সফটওয়্যার রপ্তানি করে ভারত। ওই সময় যদি তা অর্ধেকে নেমে আসতো, মুহূর্তে তা নিয়ে গণমাধ্যম এবং সরকারের নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে তুলকালাম কাণ্ড শুরু হতো। চলতো দলাদলি আর গালাগালির পালা। কিন্তু, ওই ক্ষতি হতো পোশাক শিল্পে নিজ সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে ভারত যে ৬ হাজার কোটি ডলার আয়ের সুযোগ হারাচ্ছে তার সমান। এই বাস্তব সম্ভাবনা নিয়ে গণমাধ্যম, সরকার বা বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীরা আলোচনার উৎসাহী নয়। 

ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা স্বীকার করতেই চান না যে, জুতা বা পোশাক তৈরির ছোট ছোট কারখানা নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা লাখো মানুষের কর্মসংস্থান করতো এবং তা থেকে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করাও সম্ভব ছিল। সরকারি সহায়তার অভাব থাকা সত্ত্বেও এমন যেসব কারখানা ছিল, লকডাউনে তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিংহভাগই চিরতরে বন্ধ হতে বাধ্য হয়েছে। 

গ্রাম থেকে কাজের সন্ধানে আসা অদক্ষ জনগোষ্ঠীর বড় অংশকে কাজ দিতে পারতো এসব কারখানা। উচ্চ দক্ষতা এবং প্রশিক্ষণের কাজে শিক্ষাগত যোগ্যতাও অনেক বেশি দরকার হয়, যা এক্ষেত্রে প্রয়োজন নেই। তবে শ্রমঘন শিল্পে কাজ করতে করতেই দক্ষতা অর্জনের সুবিধা পান শ্রমিকেরা। ব্যবহারিক জ্ঞানের এই অভিজ্ঞতা অনেক সময় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমেও তৈরি করা যায় না।

বাংলাদেশ এই সস্তা শিল্পেই দক্ষ শ্রমিক তৈরি করেছে। আছে নারীর বিপুল উপস্থিতি। কর্মক্ষম প্রতি পাঁচজন নারীর মধ্যে দুই জনই দেশটির শ্রম বাজারে যুক্ত। যা ভারতীয় নারীদের ২১ শতাংশ অংশগ্রহণ হারের চাইতে অনেক বেশি।

সবচেয়ে বড় বিপদ হলো; রাজনীতিবিদেরা নিজেদের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করে উল্টো তথাকথিত 'স্বনির্ভর' এবং বিশ্ব বাণিজ্য থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উদ্যোগ নিতে পারেন। 'বাংলাদেশের চাইতে দারিদ্র্য রাষ্ট্রের' শিরোপা পড়ার চাইতে আমদানিতে বাধা সৃষ্টি এবং স্থানীয় বাজার চাহিদা পূরণ করার মতো পণ্য উৎপাদনে তারা গুরুত্ব দেওয়া শুরু করতে পারেন। এভাবেই কর্মসংস্থান তৈরি করা যাবে, এমন চিন্তাই আসবে তাদের মাথায়।

অভিজ্ঞরা জানেন, এটা নতুন কিছু নয়। সেই ১৯৬০ এবং ৭০'-এর দশকের স্ব-নির্ভরতার দর্শণ এবং সেই অর্থনীতিতে ফেরার চেষ্টামাত্র।

নিরাশার এসব কথা ব্যাখ্যা করেছেন চ্যাটার্জি ও শুভ্রামনিয়াম তাদের গবেষণায়। প্রচলিত বিশ্বাসে ভারত রপ্তানি ভিত্তিক প্রবৃদ্ধির আদর্শ উদাহরণ এবং ভিয়েতনাম ও চীন ছাড়া অন্যদের চাইতে ভালো করছে। কিন্তু তা যে সঠিক নয়, গবেষকদ্বয় সেটাই ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন। 

ভারতীয় অর্থনীতির ভরপুর গ্লাসটি অর্ধেক ভরা, বাকি অর্ধেক গুজব আর এমন বিশ্বাসের বুদ্বুদ।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অবশ্যই ভারতের পক্ষে গেছে। কিন্তু, সেই রপ্তানি অর্থনীতির কাঠামো বা ধাঁচটা ভুল ধরনের। বিশেষ করে, প্রতিবেশী বাংলাদেশ এ ধরনের বিশেষায়িত দক্ষতা ভিত্তিক শিল্প এড়িয়ে বিকাশের পথ বেঁছে নেওয়ায় বড় ধরনের মন্দার ঝুঁকি এড়িয়ে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সহায়তা পাচ্ছে বলে জানান চ্যাটার্জি ও শুভ্রামনিয়াম।  

ভারতের বড় রপ্তানি আয় আসে কম্পিউটার সফটওয়্যার তৈরির মতো উচ্চ-দক্ষতা নির্ভর শিল্প ও সেবা থেকে। সিংহভাগ ভারতীয় নাগরিক এমন দক্ষতা অর্জনের সুযোগই পান না। তাছাড়া 'বিশ্বের কারখানা' খ্যাত চীন এখন নিজে ক্ষুদ্র ও শ্রমঘন শিল্প থেকে বের হয়ে আসছে। সেই জায়গাটা অন্য দেশকে নেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। অন্যদিকে, দখল বাড়াচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে। 

আর এখানেই আছে ভারতের জন্য অপার সম্ভাবনা। এখনই যদি সস্তা এবং বিপুল কর্মী সংখ্যা কাজে লাগানোর মতো শিল্প বিকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে ভারতীয় অর্থনীতিতে মহামারি পরবর্তী উত্থান অনেকটা সহজ হবে। এবং প্রবৃদ্ধির স্থির বিকাশও ধরে রাখা যাবে। 

ভারতে প্রতিবছর ৮০ লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হওয়া প্রয়োজন। মহামারির পর এটাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অদক্ষ শ্রম নির্ভর শিল্প সেখানেও সাহায্য করতে পারবে। 

  • লেখক: অ্যান্ডি মুখার্জি ব্লুমবার্গের মতামত কলাম লেখক। তিনি শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং আর্থিক সেবাখাত নিয়ে বিশ্লেষণ করেন। ইতোপূর্বে তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ব্রেকিংভিউজেও কলাম লিখতেন।
  • সূত্র: ব্লুমবার্গ
  • অনুবাদ: নূর মাজিদ 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.