চার প্রকল্প বাস্তবায়ন না করেই নতুন আবাসন গড়তে চায় সিডিএ

অর্থনীতি

26 May, 2021, 04:00 pm
Last modified: 26 May, 2021, 04:07 pm
গত ৬০ বছরে সর্বমোট ১৩টি আবাসিক এলাকা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ),এর মধ্যে চারটি প্রকল্প এখনো বাস্তবায়ন করতে পারেনি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। এই অবস্থাতেই ১৬৭টি আবাসিক ও ১৮টি বাণিজ্যিক প্লট নিয়ে বায়েজিদ হাউজিং নামে আরও একটি নতুন আবাসন প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েছে সিডিএ।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রথম আবাসন প্রকল্প কর্ণফুলী আবাসিকে ক্ষতিগ্রস্থ কোটায় প্লট গ্রহীতা ইয়াছিন চৌধুরী। পরিকল্পিত আবাসিক এলাকায় নিজের ঠিকানা গড়তে ছেড়ে দিয়েছিলেন বাপ-দাদার ভিটা। কিন্তু প্রকল্প এলাকায় পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ যাবতীয় পরিসেবা নিশ্চিত না হওয়ায় বাড়ি বানানো সম্ভব হয়নি বরাদ্দপ্রাপ্ত জমিতে। ফলে দুই যুগের বেশি সময় ধরে চট্টগ্রাম নগরীর ফিরিঙ্গী বাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকছেন তিনি। 

ইয়াছিন চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "পরিকল্পিত আবাসিক এলাকায় বসবাসের স্বপ্নে নিজের জমি ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু সিডিএ সব ধরণের নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার কথা বললেও এখনো পানীয় জলের ব্যবস্থাও করতে পারে নি। ফলে বরাদ্দপ্রাপ্ত প্লটে আর ঘর বানানো হয় নি।"

সত্তরোর্ধ্ব এই প্লট গ্রহীতা আক্ষেপ করে বলেন, "জীবনের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। হয়তো স্বপ্নের বাড়ি দেখে যেতো পারবো না।"

শুধু ইয়াছিন চৌধুরী নন, গত ৬০ বছরে সর্বমোট ১৩টি আবাসিক এলাকা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। এসবের মধ্যে অনন্যা আবাসিক ১ ও ২ সহ চারটি প্রকল্প এখনো বাস্তবায়ন করতে পারেনি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। প্রায় পরিত্যক্ত হওয়ার উপক্রম সিডিএর সলিমপুর এবং কর্ণফুলী আবাসিক প্রকল্প। এই অবস্থাতেই ১৬৭টি আবাসিক ও ১৮টি বাণিজ্যিক প্লট নিয়ে বায়েজিদ হাউজিং নামে আরও একটি নতুন আবাসন প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।

সিডিএ সূত্র জানা যায়, বায়েজিদ বোস্তামী লিংক রোড সংলগ্ন মোট ১৯.৬৫ একর জমিতে  'বায়েজিদ হাউজিং' নামের প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় তিন, চার ও পাঁচ কাঠার আবাসিক প্লট রয়েছে ১৬৭টি। এছাড়াও বাণিজ্যিক প্লট থাকছে ১৮টি। এ আবাসন প্রকল্পের প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫৭ কোটি ৮২ লাখ ৫২ হাজার টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ২০২১ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের মধ্যেকার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের প্রতি কাঠা জমির পরিমান হবে ৩০- ৩৫ লাখ টাকা। সিডিএ'র নিজস্ব ৩ একর জায়গার বাইরে সংস্থাটি আরও ১৭.৬৫ একর জায়গা অধিগ্রহণ করবে। ভূমি অধিগ্রহণ হলেই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। 

চারটি প্রকল্প অসম্পূর্ণ রেখে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নতুন আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের এ উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন চট্টগ্রামের সচেতন নাগরিক সমাজ ও অবাস্তবায়িত প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্থরা। তারা বলছেন, পূর্বে নেওয়া প্রকল্পগুলোর দুই-তৃতীয়াংশ প্লট যেখানে খালি পরে আছে, তখন বায়েজিদ লিংক রোডের মত পাহাড়ি এলাকায় আবাসিক এলাকা গড়ার পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত নয়। এছাড়া ওই এলাকায় আবাসিক এলাকা হলে আশপাশের পাহাড়গুলো উজার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আগের প্রকল্পগুলোই বাস্তবায়ন হয়নি, অকার্যকর হয়ে পরে আছে। কিন্তু, অবাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোর সমস্যা চিহ্নিত না করে আবার নতুন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে,"

"প্রকল্প অবাস্তবায়িত রেখে নতুন প্রকল্পে হাত না দিলে জনগনের অর্থ কর্মকর্তাদের পকেটে যাবে কি করে? বায়েজিদে পুরোটাই পাহাড়ি এলাকা, সেখানে আবাসন প্রকল্প করার অর্থ হলো আশপাশের পাহাড় গুলোকে ধ্বংসের মুখে ফেলে দেওয়া।" যোগ করেন তিনি। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিডিএ'র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, "সিডিএর মাস্টারপ্ল্যানে উল্লেখ আছে, প্রতি বছর ৫০ একর জায়গায় নিয়ে আবাসন প্রকল্পের পরিকল্পনা করতে হবে। কিন্তু গত ১০ বছরে সিডিএ কোনো আবাসন প্রকল্প গ্রহণ করেনি। এর আগে বেশ কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও সেগুলো ছিলো যাচাই-বাছাই ছাড়া। ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি ছিলো দুর্বল। তাই অনন্যাসহ কয়েকটি প্রকল্প এলাকায় মানুষ বাড়ি তৈরিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তবে বায়েজিদ হাউজিংয়ে আমরা বিস্তারিত স্টাডি করে প্রকল্পটি হাতে নিয়েছি।"

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরের আবাসন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ৬০ বছরে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ১৩ টি আবাসিক প্রকল্পে প্রায় ৬ হাজার ৬৬০টি প্লট বরাদ্দ দিয়েছে। বরাদ্দকৃত এসব প্লেটের দুই তৃতীয়াংশ প্লটেই কোনো বাড়িঘর নির্মিত হয়নি। একের পর এক প্লট হাতবদল হচ্ছে কেবল। মূল্য বৃদ্ধির অপেক্ষায় আছেন অনেকে। প্লট খালি থাকায় সিডিএ'র জনমুখী উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্যই এখনো অর্জিত হয়নি। এছাড়া, অপরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়ার ফলে সিডিএ'র সলিমপুর আবাসিক এলাকা এবং কর্ণফুলী আবাসিক এলাকা প্রায় পরিত্যক্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

কর্ণফুলী আবাসিকের প্লট বরাদ্দ প্রাপ্তদের একজন শফিক সিকদারের ছেলে এনামুল। তিনি বলেন, "বাবা নগরীর রেয়াজুদ্দিন বাজারে ব্যবসা করতেন। তার কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে ১৯৯৪ সালে ৩ কাঠা প্লট বরাদ্দ নিয়েছিলেন সিডিএ থেকে। ইচ্ছা ছিল নগরীর অদূরে একটি স্বপ্নের বাড়ি বানানোর। তাই আজ থেকে ২৬ বছর আগে আড়াই লাখ টাকা দিয়ে এই প্লট বরাদ্দ নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন বুকে রেখেই গত দুই বছর আগে বাবা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।"

আবাসন সমস্যা দূর করতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ১৯৬০-৬১ সালে সীতাকুণ্ডের সলিমপুর ইউনিয়নের পাহাড়ী এলাকায় গড়ে তোলে সিলিমপুর সিডিএ আবাসিক এলাকা। প্রায় ৩০ বছর পর ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরে কর্ণফুলী নদীর বামতীরে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয় 'কর্ণফুলী আবাসিক প্রকল্পের'। ২০০৭ সালে অক্সিজেন কুয়াইশ সংযোগ সড়কের পাশে অনন্যা আবাসিক-১ ও ২০১৬ সালে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয় অনন্যা-২ আবাসিক প্রকল্পের। কিন্তু একের পর এক প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও আলোর মুখ দেখেনি একটিও।

সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, "৭০ বছর আগের প্রকল্প সলিমপুর আবাসিক এলাকায় সম্প্রতি গ্যাস পৌঁছেছে। তাই বর্তমানে মানুষ ঘরবাড়ি করছে। অনন্যা আবাসিক এলাকার মাটির অবস্থা ভালো নয়, তাই আগ্রহীরা বাড়ি তৈরিতে এগিয়ে আসছেনা। পানীয় জলের অভাবে কর্ণফুলী আবাসিক প্রকল্পটিতে আবাসন গড়ে উঠেনি। এখন আমরা চেষ্টা করছি আনোয়ারা এলাকায় ওয়াসার নির্মাণাধীন ভান্ডারজুড়ি প্রকল্প থেকে এই প্রকল্পে পানি সরবরাহ করতে। আশা করছি ২০২১ সালের মধ্যে ভান্ডারজুড়ি প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এই আবাসিক এলাকায় পানি সরবরাহ করতে সমস্যা থাকবে না।"

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.