গুরুত্বপূর্ণ, তারপরও নামমাত্র এডিপি বরাদ্দ

অর্থনীতি

27 May, 2021, 11:05 am
Last modified: 28 May, 2021, 12:12 am
সীমিত সম্পদের মধ্যে প্রকল্পের সংখ্যা আটকে রাখতে না পারার কারণে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানায় পরিকল্পনা কমিশন।

গত বছরের মে মাসে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত পল্লী সড়ক অবকাঠামো পুনর্বাসনে ৫৯০৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া ওই বছরের শেষের দিকে। চলতি অর্থবছরে এ প্রকল্পে ৭১ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। এ টাকায় ইতোমধ্যে প্রকল্পের দরপত্র প্রণয়নসহ প্রস্তুতিমূলক কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হবে আগামী অর্থবছরে। এ কারণে এ প্রকল্পে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল। কিন্ত ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) এ প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাত্র ১৭০ কোটি টাকা। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পটি ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্ত কিন্তু এভাবে বরাদ্দ পেলে ২০ বছরেও প্রকল্পের কাজ শেষ হবে না। সেই সঙ্গে প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়বে।

নরওয়েজিয়ান শরণার্থী কাউন্সিলের আন্তর্জাতিক অভ্যন্তরীণ স্থানচ্যুতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের (আইডিএমসি) জানায়, আম্পানের কারণে বাংলাদেশে ২.৫ মিলিয়ন মানুষ নতুন করে  বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এ অবস্থায় প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ শুরু হলে বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হতো। এছাড়া দারিদ্র্যের বিমোচনেও প্রকল্পটি ভূমিকা রাখতে পারতো বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এডিপিতে বড় বড় মেগা প্রকল্প চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ পেলেও আম্পানের এই প্রকল্পের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে আগামী অর্থবছরেরর এডিপিতে নামমাত্র বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন কাজে অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। 

সীমিত সম্পদের মধ্যে প্রকল্পের সংখ্যা আটকে রাখতে না পারার কারণে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান পরিকল্পনা কমিশন। এ ক্ষেত্রে বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো সরকারের মধ্য মেয়াদী বাজেট কাঠামো (এমটিবিএফ) মানছে না। এমটিবিএফে সরকার তিন অর্থবছরের জন্য সিলিং বেঁধে দেয়। কিন্ত এ সিলিংয়ের বরাদ্দের চেয়ে বেশি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে মন্ত্রী, এমপি, অথবা প্রভাবশালী আমলাদের কারণে অনেক বেশি প্রকল্প নেওয়া হয়। অনেক বেশি প্রকল্প হওয়ার  কারণে চলমান প্রকল্পে কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে তিন বছরের প্রকল্প শেষ করতে দ্বিগুণ বা তার চেয়ে বেশি সময় লাগছে। আবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ার কারণে ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে।

পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, ২০২১-২২ অর্থবছরে স্থানীয় সরকার বিভাগের অনুকূলে এমটিবিএফের সিলিং ৩৩৮৩২ কোটি টাকা। কিন্ত এ সংস্থার বিভিন্ন প্রকল্পের চাহিদা রয়েছে ৫০০০০ কোটি টাকারও বেশি। শুধু  এ বিভাগ নয়, যে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রকল্প বাস্তবায়নে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ বেশি, সেখানে প্রকল্পও অনেক বেশি। সরকার সুষম উন্নয়নের কথা বললেও এ ক্ষেত্রে তা মানা হয় না। যে এলাকার রাজনৈতিক নেতারা যত প্রভাবশালী, সেসব এলাকার প্রকল্পও বেশি।

পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের সদস্য এবং পরিকল্পনা বিভাগের সচিব জয়নুল বারী টিবিএসকে বলেন, কোনো প্রকল্পে কত বরাদ্দ পাবে তার অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। পরিকল্পনা কমিশন তা প্রকল্পে বন্টন করে দেয়। তবে শুধু এমটিবিএফ সিলিংয়ের চেয়ে বেশি প্রকল্প নেওয়ার কারণে বরাদ্দ কমছে তা নয়। অনেক সময় দেখা যায় কোন প্রকল্পে এ অর্থবছরে অর্থ ব্যয় হবে না, সেখানে কম বরাদ্দ দেওয়া হয়। অনেক সময় একক কোনো প্রকল্পে বেশি বরাদ্দ দিতে গিয়ে অন্যান্য প্রকল্পে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়। 

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফল পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন টিবিএসকে বলেন, যে এলাকায় প্রভাবশালীরা আছে, সেখানে প্রকল্প বেশি থাকে এবং বরাদ্দও বেশি পায়। এ কারণে অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পও অনুমোদন পায়।  সুষম উন্নয়নের জন্য প্রভাবমুক্তভাবে প্রকল্প নিতে হবে। বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে কোনো প্রকল্পে  অর্থনৈতিক সুফল পর্যালোচনা হয় না। এটা করা গেলে প্রকল্পের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা সহজ হতো।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলম বলেন, নানা চাপের কারণে নতুন নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়। আবার অনেক সময় পরিস্থিতির কারণেও নতুন প্রকল্প নিতে হয়। এ কারণে এমটিবিএফের বাইরে চলে যাচ্ছে প্রকল্প সংখ্যা। তবে অনেক বেশি প্রকল্প না নিয়ে চলমান প্রকল্পগুলোকে দ্রুত শেষ করার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে।

আগামী এডিপিতে বরাদ্দ বঞ্চিত আরেকটি প্রকল্প হলো - পল্লী সড়কে গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণ।  ৩৯২৭ কোটি টাকার ব্যয় ধরে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ ‍শুরু হয়, ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে। এ প্রকল্পে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১৫৫ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরাদ্দ বাড়িয়ে ২৪০ কোটি টাকা করা হয়। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৫০০ কোটি টাকা। 

সম্প্রতি প্রকল্পটির মেয়াদ আরও তিন বছর বাড়ানো হয়। একই সঙ্গে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ৬৪৫৭ কোটি টাকা করা হয়েছে। পর্যাপ্ত বরাদ্দ না পাওয়া এবং বছর ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করতে না পারাই প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির প্রধান কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ব্যয় বাড়লেও এ প্রকল্পে আগামী অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দ বাড়েনি। মাত্র ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, এ প্রকল্পে পুরোদমে বেশ কিছু প্যাকেজে কাজ চলছে। আগামী অর্থবছরে এ প্রকল্পে এক হাজার কোটি টাকাও ব্যয় করা সম্ভব। কিন্ত মাত্র ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ শুনলে ঠিকাদাররা কাজের গতি কমিয়ে দিবে। কারণ তারা কাজ করলেও বিল পাবে না। এ পরিস্থিতি এডিপিতে বিশেষ প্রয়োজনে থোক  থেকে বরাদ্দ আদায়ে পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগে তোজজোড় করা হচ্ছে।

এ ধরণের আরও বেশ কিছু প্রকল্প রয়েছে নতুন এডিপিতে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রকল্প হলো- অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পল্লী অবকাঠামো প্রকল্প, রুরাল কানেকটিভিটি ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট, উত্তরাঞ্চলের অতি দরিদ্রদের কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণ প্রকল্প। বিদ্যুৎ বিভাগ, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, নৌ-পরিবহন, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে এ ধরণের প্রকল্প রয়েছে।  
 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.