কারখানায় বিনিয়োগের পরিবেশ চান নোয়াখালীর প্রবাসীরা
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার বানুই গ্রামে বাড়িটি। মূল ফটক দিয়ে ঢুকতেই বাঁধানো পথ, দুপাশে বাগান। সেই পথ দিয়ে এগিয়ে গেলে টালি বসানো ছাদ আর লাল ইটে বানানো এক রাজকীয় প্রাসাদ, দেখে আপনার মনে হবে নোয়াখালী নয়, বরং ইতালি বা ইউরোপের অন্য কোন নগরীর ভিক্টোরীয় যুগের এক প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আপনি।
বাড়িটির মালিক তোফায়েল আহমেদ। আজ থেকে ২৫ বছর আগে জীবিকার সন্ধানে সৌদি আরবে যান তিনি।
শুধু এই বাড়িটিই নয়, নোয়াখালীতে এরকম আরও বাড়ি দেখতে পাবেন আপনি। মূলত জীবিকার প্রয়োজনে দেশের বাইরে পাড়ি জমান তারা, আর রেমিট্যান্স বিনিয়োগ করেন রিয়েল এস্টেটে।
নোয়াখালীর ৯ উপজেলার তিন লক্ষাধিক মানুষ পৃথিবীর ১৬৫টি দেশে পাড়ি জমিয়েছেন জীবিকার সন্ধানে।
এসব প্রবাসী প্রতি বছর দেশে রেমিটেন্স পাঠান অন্তত তিন হাজার কোটি টাকা, যা পরিবারের খরচ জোগানোর পাশাপাশি ব্যয় হয় বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ, প্লট-ফ্ল্যাট কেনার মতো কাজে।
এই অর্থ কল-কারখানায় বিনিয়োগ করা গেলে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি বেশি মুনাফা হতো বলে মনে করছেন নোয়াখালীর বেশ কয়েকজন প্রবাসী।
তাদের ভাষ্য, বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ পেলে তারা কষ্টার্জিত অর্থ বিনিয়োগ করতে চান দেশীয় শিল্পের বিকাশে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রবাসী আয়ের ৩৯ শতাংশই ব্যয় হয় পরিবারের খাদ্যের সংস্থানে। আরও ৩৯ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয় শিক্ষা, যাতায়াত, কাপড় কেনাসহ নানা ধরনের খাদ্য-বহির্ভূত পণ্যে।
বাকি ২২ শতাংশ অর্থের পাঁচ শতাংশ ব্যয় হয় টেলিভিশন, ফ্রিজ, মুঠোফোনসহ নানা ধরনের বিলাসপণ্য কিনতে। বাকি ১৭ শতাংশ ব্যয় হয় জমি বা ফ্ল্যাট কেনায়।
নোয়াখালীর প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল, বিশেষ করে আমিশাপাড়া, দেওটি, নোয়াখোলা, রামপুরসহ বিভিন্ন স্থানে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে তৈরি করা এমন অনেক বাড়ি আছে যেগুলোর মালিক বিদেশে থাকেন। তত্ত্বাবধায়ক বা নিরাপত্তাকর্মীরাই বাড়ি পাহারা দেন।
নোয়াখালীর প্রবাসীদের অর্থ প্লট-ফ্ল্যাট কেনাতেও খাটানো হচ্ছে।
জেলার ‘বাণিজ্যিক নগরী’ চৌমুহনী বাজারের সবচেয়ে বড় শপিং মল কাম রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্সের পরিচালক ফখরুল ইসলাম জানান, তাদের মার্কেট ও ফ্ল্যাটের অধিকাংশ ক্রেতাই প্রবাসী। জেলার প্লট-ফ্ল্যাট ও বড় শপিং মলগুলো গড়ে উঠেছে প্রবাসীদের লক্ষ্য করে।
নোয়াখালীর প্রবাসীরা এমন বাস্তবতার বদল চান। তবে কারখানায় বিনিয়োগে আস্থা পাচ্ছেন না তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোনাইমুড়ি উপজেলার যুক্তরাজ্য প্রবাসী শাহ আলম বলেন, ‘‘কল-কারখানা করার জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়, তারা ঘুষ আদায়ের জন্য প্রবাসীদের বেশি হয়রানি করে। প্রবাসীরা প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়ে হয়রানির শিকার হওয়ায় কোনো উৎপাদনশীল খাতে রেমিটেন্সের টাকা ব্যয় করতে চান না।’’
জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার মিরওয়ারিশপুর গ্রামের মাসুদুর রহমান বলেন, ‘‘মানুষের মধ্যে সততার অভাব, প্রশাসনিক হয়রানি, দুর্নীতি ও প্রতারণার কারণে প্রবাসীরা উৎপাদনশীল খাতে তাদের টাকা বিনিয়োগ করতে চান না।’’
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘‘মধ্যসত্বভোগীদের কারণে বাংলাদেশে ব্যবসা করা কঠিন। ব্যবসার চেয়ে বাড়ি ভাড়া বা দোকান ভাড়া বেশি নিরাপদ।’’
জেলার চাটখিল উপজেলার নোয়াখোলা গ্রামের ইব্রাহীম খলিল মানিক যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন ২৫ বছর ধরে। তিনি বলেন, রেমিটেন্সের শেষ সম্বলটুকু দেশে নিয়ে আসতে কোনো আপত্তি নেই যদি বিনিয়োগ সুরক্ষা দেওয়া হয়। তিনি নিজ এলাকায় কয়েকটি বহুতল ভবন ও মার্কেট নির্মাণ করেছেন। কিনেছেন দোকান, জমি ও ফ্ল্যাট। এসব করতে যত টাকা ব্যয় হয়েছে কোনো কল-কারখানা করতে এত টাকা লাগে না।
নোয়াখালী জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের সহকারী পরিচালক আবু ছালেক জানান, ২০০৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নোয়াখালী থেকে বিশ্বে বিভিন্ন দেশে ৩ লাখ ১৮ হাজার ৩২১ জন গমন করেন। এর আগের পরিসংখ্যান না থাকলেও তার ধারণা, সব মিলিয়ে প্রবাসী নোয়াখালীর সংখ্যা সাড়ে পাঁচ লাখের মতো হতে পারে।
সরকার সম্প্রতি রেমিটেন্সের ওপর দুই শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণা দেয়, যাতে নোয়াখালীতে বেড়েছে রেমিটেন্স প্রবাহ। চলতি বছরের ১০ মাসে জেলায় সোনালী ব্যাংকের ২৮ শাখায় প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন ২৭৬ কোটি ২ লাখ টাকা। গেল বছর এ পরিমাণ ছিল ১৪৫ কোটি টাকা।
জনতা ব্যাংকের ১৫ শাখায় এ বছর ১০ মাসে রেমিটেন্স এসেছে ২৮০ কোটি টাকা, যেটি ২০১৮ সালে ছিল ১৭৪ কোটি টাকা।
সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসা ইসলামী ব্যাংক তাদের ২১ শাখায় অক্টোবর পর্যন্ত রেমিটেন্স সংগ্রহ করেছে ২ হাজার ৬০১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে এ সংগ্রহের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৭৫৭ কোটি ২০ লাখ টাকা।