কাঁচা চামড়ায় লাভের গুড় আড়তদারের ঘরেই!

অর্থনীতি

24 July, 2021, 12:55 pm
Last modified: 24 July, 2021, 01:10 pm
আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধি ও চাহিদা থাকায় এবার চামড়ার দাম বাড়িয়ে নির্ধারণ করে সরকার।
  • বিশৃঙ্খলা কম হলেও এবার চামড়ার দাম বেড়েছে
  • প্রতি বর্গফুটে সরকার দাম বাড়ালেও কথা রাখেনি আড়তদাররা
  • চামড়া নিয়ে তেমন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটলেও যথাযথ দাম পায়নি মৌসুমী ব্যবসায়ীরা
  • প্রতিটি গরুর চামড়া গড়ে বিক্রি হয়েছে ৪০০-৬০০ টাকায়
  • খাসির চামড়া ২০-৩০ টাকা য়, দাম কম হওয়ায় ফেলে দিয়েছেন কেউ কেউ
  • ঈদে ঢাকায় চামড়া সংগৃহীত হয় প্রায় ৫ লাখ, ঈদের দিন ও পরদিন মিলে সংগ্রহ প্রায় দুই লাখ
  • ঈদের তৃতীয় দিন পর্যন্ত চামড়া সংগৃহীত হয়েছে ১.৫০-১.৭০ লাখ, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ কম 

কাঁচা চামড়া নিয়ে এবার বড় কোনো বিশৃঙ্খলা না হলেও সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের সুফল পায়নি মৌসুমী ব্যবসায়ীরা। তবে সরকার চামড়ার দাম বাড়িয়ে নির্ধারণ করায় এবার আগের বছরের চেয়ে চামড়ার দাম এবার কিছুটা বেড়েছে।

তবে এই দাম বৃদ্ধি আশানুরূপ নয়, বলছেন মৌসুমী ব্যবসায়ীরা।

গত বছর অপেক্ষাকৃত কম দামে চামড়া কেনাবেচা, বিক্রি করতে না পেরে ফেলে দেওয়া কিংবা মাটিতে পুঁতে ফেলার ঘটনা ঘটলেও এবার তেমনটি হয়নি।

আড়তদাররা বলছেন, আগের বছরের চেয়ে এবার 'বেশি' দামে চামড়া কেনা হয়েছে। সব মিলিয়ে বিগত দুই বছরের তুলনায় এবারের বাজার ভালো ছিল।

এদিকে লবণের বাজার হাঠৎ করেই তেঁতে উঠে। হঠাৎ করে বস্তাপ্রতি লবণের দাম ৫০০ টাকা থেকে ৭০০ বা ১০০০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়।

রাজধানীর কাঁচা চামড়ার কয়েকটি আড়ত ঘুরে দেখা যায়, এবার গরুর চামড়া গড়ে বিক্রি হয়েছে ৪০০-৬০০ টাকা। বড় গরুর চামড়া ৭০০-৮০০ টাকা আর অপেক্ষাকৃত ছোট বা মাঝারি আকারের গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ৩০০-৪০০ টাকা।

খাসির চামড়ার দাম পাননি মৌসুমী ব্যবসায়ী বা এতিমখানার চামড়া সংগ্রহকারীরা। এবার খাসির চামড়া বিক্রি হয়েছে ২০-৩০ টাকায়।

ঈদের দিন বিকালে ৫০ টাকা করে বিক্রি হলেও বেলা গড়ার পরপর দাম কমতে থাকে। স্থানীয়রা জানায়, দাম না পাওয়ায় ক্ষুদ্ধ হয়ে কয়েকজন খাসির চামড়া ফেলে দিয়েছে।

বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আফতাব উদ্দিন দাবি করেছেন, "সরকার দাম বৃদ্ধি করার কারণে এবার মৌসুমী ব্যবসায়ী ও ফড়িয়া এবং এতিমখানা চামড়ার ভালো দাম পেয়েছে। বিগত দুই বছরের চেয়ে এবার চামড়ার বাজার ভালো। গরুর চামড়া আকারভেদে ৫০০-১১০০ টাকায় কেনা হয়েছে।"

উল্লেখ্য, ঢাকায় এবার গরু-মহিষের প্রতি বর্গফুট লবণজাত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৪০-৪৫ টাকা, যা গতবছর ছিল ৩৫-৪০ টাকা। আর ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম ধরা হয় ৩৩-৩৭ টাকা, যা আগের বছর ছিল ২৮-৩২ টাকা।

সারাদেশে লবণযুক্ত খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৫ থেকে ১৭ টাকা, আর বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

নির্ধারিত দামের চেয়ে কম মূল্যে চামড়া ক্রয়

আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধি ও চাহিদা থাকায় চামড়ার দাম বাড়িয়ে নির্ধারণ করেছে সরকার। এবার প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া বাড়ানো হয়েছে ৫ টাকা।

সেই হিসাবে আগের বছরের তুলনায় আড়তদারেরা প্রতিটি চামড়া ১০০-২০০ টাকা বেশি দামে কিনলেও, সরকার নির্ধারিত দামের তুলনায় কম।

চট্টগ্রামের চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ মুসলিম টিবিএসকে জানান, একটি বড় আকারের গরুর চামড়া ৩৫-৪০ বর্গফুট, মাঝারি আকারের চামড়া গড়ে ২৫-৩০ ফুট আর ছোট আকারের গরুর চামড়া হয় ১৬-২০ ফুট।

আড়তদারেরা জানান, একটি চামড়া সংরক্ষণ করতে ৮-১০ কেজি লবণ প্রয়োজন হয়। সেই হিসাবে প্রতিটি কাঁচা চামড়ায় সংরক্ষণে বাড়তি ২০০ টাকা খরচ হবে।

ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, একটি বড় গরুর চামড়া গড়ে ৩০ বর্গফুট ধরা হলে দাম পড়ে ১২০০-১৩৫০ টাকা।

আর মাঝারি গরুর চামড়ার গড়ে ২৫ বর্গফুটে সর্বনিম্ন ১০০০-১১২৫ টাকা আর ছোট গরুর চামড়া গড়ে ২০ বর্গফুট ধরা হলে সর্বনিম্ন ৮০০-৯০০ টাকা দাম হয়। তবে রাজধানীর আড়তদাররা মৌসুমী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এই চামড়া গড়ে ৪০০-৬০০ টাকায় কিনেছেন।

ব্যবসায়ীরা জানান, মৌসুমী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা চামড়া লবণজাত করে ট্যানারী মালিকদের কাছে বিক্রি করবেন আড়তদাররা।

প্রতিবছর কোরবানির সময় চামড়া কিনে আড়তে বিক্রি করেন সেলিম মোল্লা। তিনি একজন মৌসুমী ব্যবসায়ী। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার সময় প্রায় অর্ধশতাধিক চামড়া নিয়ে আসেন পোস্তায়। ৮০০ টাকা করে চামড়া বিক্রির জন্য কয়েকটি আড়তে ঘুরলেও বিক্রি করতে পেরেছেন ৬০০ টাকা করে।

তিনি টিবিএসকে বলেন, এবার দাম ভালো পাবার আশা করেছিলাম কিন্তু আশানুরূপ পাইনি। আড়তদাররা কম দামে চামড়া কিনছেন।"

কম দামে মৌসুমী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চামড়া কেনার বিষয়ে আফতাব উদ্দিন বলেন, "এবার ভালো দাম দিয়েই চামড়া কেনা হয়েছে। সরকার নির্ধারিত দামের খুব বেশি হেরফের হবে না। ঢাকায় বড় গরুর ক্ষেত্রে গড়ে ২২ বর্গফুট ভালো চামড়া পাওয়া যায়। আর ঢাকার বাইরে সেটা দাঁড়ায় ১৮ বর্গফুট। সেই হিসেবে যে দামে চামড়া কেনা হয়েছে, তা কোনমতেই কম নয়।" 

আড়তে কম এসেছে কাঁচা চামড়া

রাজধানীতে কাঁচা চামড়ার প্রধান আড়ত লালবাগের পোস্তা। কোরবানির ঈদ আসলেই সরগরম হয় পুরান ঢাকার এই স্থানটি।

ঈদের দিন দুপুর থেকেই কাঁচা চামড়া আসতে থাকায় জমজমাট হয়ে উঠে পোস্তা। ঢাকার অলিগলি থেকে সংগৃহীত চামড়াবাহী রিক্সা, ভ্যান ও ট্রাকের গন্তব্য পোস্তা। আর আড়তদাররাও এই চামড়া কিনে লবণ মাখিয়ে সংরক্ষণ করে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবার পোস্তায় কাঁচা চামড়া এসেছে কম। এই বিষয়ে তাদের ব্যাখ্যা হচ্ছে, আগের বছরের চেয়ে এবার গরু কোরবানি কমেছে। এছাড়াও গরম বেশি হওয়ায় যেখানে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে, সেখানেই সংরক্ষণ করতে বলায় কম এসেছে।

বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব মতে, ঢাকায় চামড়া সংগ্রহ হয় প্রায় পাঁচ লাখ। ঈদের দিন ও পরদিন মিলে প্রায় দুই লাখের মতো চামড়া পোস্তার আড়তদারদের হাতে আসে। শীতকালে এই চামড়া আসে প্রায় তিন লাখ।

এবার ঈদের তৃতীয় দিন মিলে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত রাজধানীর পোস্তায় কাঁচা চামড়া এসেছে প্রায় ১.৫০-১.৭০ লাখ। আশপাশে অবৈধভাবে অস্থায়ী আড়ত গড়ে উঠায় চামড়া কম সংগ্রহ হয়েছে বলে মনে করছেন সংগঠনটির নেতারা।

বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব টিপু সুলতান টিবিএসকে বলেন, "ঢাকার ভিতরে কাঁচা চামড়া সংগ্রহের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল, তা অর্জিত হয়নি। এবার অন্তত ২০-২৫ শতাংশ কম হয়েছে। তবে এবার চামড়ার বাজার ভালো গেছে। মৌসুমী ব্যবসায়ীরা কিছুটা দাম পেয়েছে। প্রতিটি চামড়া আগের বছরের চেয়ে ১০০-২০০ টাকা বেশিতে কেনা হয়েছে।"

তিনি আরো বলেন, "করোনা ভাইরাসের কারণে এবার কোরবানি কিছুটা কমেছে। তাই চাহিদা অনুযায়ী চামড়া আসেনি"।

লবণের দাম ঠেকাতে অভিযান

এদিকে লবণের কারসাজি ঠেকাতে মাঠে নামেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

রাজধানীর পোস্তা এলাকায় উপ-সচিব মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ারের নেতৃত্বে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়।

হঠাৎ করে লবণের দাম বাড়ানোর কারণে কয়েকটি লবণের দোকান সিলগালা করা হয়।

মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার সাংবাদিকদের বলেন, "বিক্রির ভাউচার দেখে লবণের দাম বেশি রাখার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় আর্থিক জরিমানার পাশাপাশি দোকান সিলগালা করা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় লবণের বাজার মনিটরিং করার জন্য সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছে।"

চট্টগ্রামের বাজার আড়তদারদের নিয়ন্ত্রণেই, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম চামড়া

দুই বছর প্রত্যাশিত দাম না পেয়ে এবার চট্টগ্রামে কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া সংগ্রহে মৌসুমি সংগ্রহকারীদের তৎপরতা ছিল কম।

গত কয়েক বছরের মতো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি না হলেও চট্টগ্রামে চামড়া সংগ্রহ কমেছে। চার লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এসেছে সাড়ে তিন লাখ।

প্রতিবছর চট্টগ্রাম নগরের পাড়া-মহল্লা থেকে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করতো মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তবে বিগত বছরে বিশৃঙ্খলার কারণে তারা আগ্রহ দেখাননি, ফলে আড়তদারদের প্রতিনিধিরাই চামড়া সংগ্রহ করেছে।

কাঁচা চামড়ার বাজারের ওপর প্রায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন আড়তদার ও তাদের প্রতিনিধিরা। চামড়ার দর অস্বাভাবিক কম হওয়ায় কেউ কেউ বিক্রি না করে মাটিতে পুঁতে ফেলেছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

চট্টগ্রামের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সেতু ভূষণ দাশ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "প্রতিবার চট্টগ্রামে প্রায় পাঁচ লাখ পশু কোরবানি হলেও এবার হয়েছে সাড়ে চার লাখ, যা গতবছরের চেয়ে পাঁচ শতাংশের মতো কম। এর ফলে চামড়ার পরিমাণও কমেছে। আবার আড়তদারদের জোটবদ্ধ কারসাজির কারণে চামড়ার দর ছিল কম।"

ফাইল ছবি/টিবিএস

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর মোবারক আলী বলেন, "চট্টগ্রামে এবার গতবছরের মতো সড়কে চামড়া ফেলে দেওয়ার পরিস্থিতি দেখা যায়নি। শুধুমাত্র বৃহস্পতিবার ভোরে আতুরার ডিপো এলাকায় বিক্রি করতে না পেরে চামড়া ফেলে যাওয়ার খবর পেয়ে তা সংগ্রহ করে নগরের জামেয়া আহমদিয়া সুন্নীয়া আলিয়া মাদরাসা ও ষোলশহর মাদরাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।"

চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ মুসলিম উদ্দিন বলেন, "এখন পর্যন্ত আড়তে আমরা দেড় লাখের কিছু বেশি চামড়া পেয়েছি। বিভিন্ন মাদরাসায় এবং অনেকে ব্যক্তিগতভাবে ৫০ হাজারের মতো চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করছেন। এছাড়া গ্রামে আরও লাখখানেক চামড়া আছে। সব মিলিয়ে আমরা এবার সাড়ে তিন লাখের মতো চামড়া সংগ্রহ করতে পারব বলে আশা করছি। কোরবানি কম হওয়ায় প্রায় ৫০ হাজার চামড়া সংগ্রহ কম হয়েছে।"

বুধবার রাতে নগরের আতুরার ডিপো এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, হাটহাজারী-মুরাদপুর সড়কে চামড়ার স্তূপ। আড়তে চামড়া পরিষ্কার করে লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করে রাখছেন শ্রমিকরা। আড়তদাররা ব্যস্ত চামড়া কেনায়।

নগরের চান্দগাঁও এলাকার মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মোনাফ বলেন, ‌"প্রতিটি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় ৪০টি চামড়া ক্রয় করেছিলাম। সকালে ৪০০ টাকা করে ২৫টি চামড়া বিক্রি করেছি। কিন্তু বিকেলে আড়তদারেরা ১৮০ থেকে ২০০ টাকার চেয়ে বেশি দাম দেননি।" 
 
 

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.