করোনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিসিকে কমেছে উৎপাদন, ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি

অর্থনীতি

আজিজুল সঞ্চয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
11 August, 2020, 01:40 pm
Last modified: 11 August, 2020, 01:48 pm
বাজারে পণ্যের চাহিদা তুলনামূলকভাবে কমে যাওয়া এবং প্রয়োজনীয় কাঁচামাল যথাসময়ে না আসায় উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে জানিয়েছেন কারখানা মালিকরা। কিছু কিছু কারখানার উৎপাদন একেবারেই বন্ধ রাখা হয়েছে।

প্রায় ২২ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিসিক শিল্পনগরী। তেল, সাবান ও ওষুধসহ বিভিন্ন পণ্যের কারখানা রয়েছে এই শিল্প নগরীতে। কিন্তু মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে বাজারে পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়া আর শ্রমিক সংকটে অর্ধেকে নেমে এসেছে কারখানাগুলোর উৎপাদন। 

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত অন্তত ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন এই শিল্প নগরীর ব্যবসায়ীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৮৫-৮৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার নন্দনপুর এলাকায় ২১ দশমিক ৯৮ একর জায়াগা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বিসিক শিল্পনগরী। এ নগরীর অনুমোদিত বিভিন্ন পণ্যের ৭২টি কারখানার মধ্যে বর্তমানে ৬০টি সচল রয়েছে। 

শিল্প নগরীতে থাকা প্রতিষ্ঠানের ধরণ

এর মধ্যে দুইটি ওষুধ, চারটি সিলিকেট, তিনটি সাবান, চারটি মেটাল, পাঁচটি সিলভার, দুইটি পাইপ, দুইটি তারকাটা, চারটি সেমাই, তিনটি বেকারি, চারটি মুড়ি, চারটি তেল ও আটটি আটা-ময়দাসহ বিভিন্ন কারখানা রয়েছে। এ সব কারখানাগুলোতে কাজ করেন প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক।

তবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকেই কারখানাগুলোতে শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। বর্তমানে বিসিক শিল্পনগরীর সবকটি কারখানা মিলিয়ে তিন হাজারের মতো শ্রমিক কাজ করছেন। বাকি শ্রমিকরা করোনাভাইরাসের কারণে নিয়মিত কাজে আসছেন না। এ ছাড়া বাজারে পণ্যের চাহিদা তুলনামূলকভাবে কমে যাওয়া এবং প্রয়োজনীয় কাঁচামাল যথাসময়ে না আসায় উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে জানিয়েছেন কারখানা মালিকরা। কিছু কিছু কারখানার উৎপাদন একেবারেই বন্ধ রাখা হয়েছে।

শ্রমিক সংকট

গত ৬ আগস্ট সরেজমিনে বিসিক শিল্পনগরীর বেশ কয়েকটি কারখানা ঘুরে শ্রমিক স্বল্পতার বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে। করোনাভাইরাসের কারণে কারখানার স্থায়ী শ্রমিকদের বেশিরভাগই নিয়মিত কাজে আসছেন না। এতে স্বাভাবিক উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। তবে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকদের বাড়তি কিছু সুবিধা দেওয়ায় তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। স্থায়ী শ্রমিকরা নিয়মিত কাজে না আসলেও তাদের বেতন ঠিকই পরিশোধ করতে হচ্ছে মালিকদের।

আমানত ফ্লাওয়ার মিলের শ্রমিক সর্দার শাহীন আলম জানান, তাদের কারখানায় স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে ৪৫ জন শ্রমিক কাজ করেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে এখন গড়ে প্রতিদিন ২০-২৫ জন শ্রমিক কাজ করছেন। 

''তবে মালিক ঠিকই সব শ্রমিকের বেতন পরিশোধ করছেন। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর আগে দৈনিক ৪৫ টন আটা-ময়দা ও ৩০ টন ভূষি উৎপাদন হতো। এখন দৈনিক ১৫ টন আটা-ময়দা ও ১০ টন ভূষি উৎপাদন হচ্ছে কারখানায়'', বললেন শাহীন আলম।

আরমান কেমিক্যালের শ্রমিক ওমর ফারুক জানান, করোনাভাইরাসের কারণে কারখানার সব শ্রমিকরা নিয়মিত কাজ করছেন না। তবে যারা ঝুঁকি নিয়ে এখন কাজ করছেন, তাদেরকে মালিক পক্ষ বাড়তি সুবিধা হিসেবে বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ করছেন।

পরিবহন সংকটে পণ্য পরিবহনে জটিলতা

আরমান কেমিক্যালের ব্যবস্থাপক মো. রুবেল জানান, করোনাভাইরাসের কারণে শ্রমিক সংকটের পাশাপাশি পরিবহন সংকটও তীব্র আকার ধারণ করে। পরিবহনের ভাড়া বেশি হওয়ায় যথাসময়ে কাঁচামাল আনা যাচ্ছে না। এ ছাড়া ঠিকমতো পণ্য ডেলিভারি করতে না পারাও উৎপাদন কমার একটি কারণ। এখন গড়ে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত পণ্য উৎপাদন হচ্ছে।

ভাই ভাই ফুড ইন্ড্রাস্ট্রিজের সত্ত্বাধিকারী আবদুর রহমান ফাহিম জানান, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর আগে বাজারে চাহিদা থাকায় প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১০টন মুড়ি উৎপাদন হতো তার কারখানায়। এখন সারা মাসেও ১০ টন মুড়ি চালাতে পারছেন না বাজারে। ফলে বাধ্য হয়ে এখন উৎপাদন বন্ধ রেখে শ্রমিকদের বসিয়ে বেতন দিচ্ছেন।

লকডাউনে কাঁচামাল সরবরাহে ভোগান্তি

বিসিক শিল্পনগরী মালিক সমিতি বলছে, গত মার্চ মাসের শেষদিক থেকে করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়তে থাকে ব্যবসায়িক কার্যক্রমে। খাদ্যপণ্য ছাড়া বাকি সব কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা কমেছে বাজারে। এ ছাড়া টানা লকডাউনের কারণে প্রয়োজনীয় কাঁচামালও আনতে পারেননি কারখানা মালিকরা। 

এ ছাড়া পরিবহন সংকটের কারণে দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে কাঁচামাল পরিবহন করতে হয়েছে। উৎপাদিত পণ্যও ঠিকমতো ডেলিভারি করা যাচ্ছে না। পরিস্থিতি আগের চেয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হলেও ব্যবসার মন্দাভাব এখনও রয়ে গেছে। সবকিছু মিলিয়ে প্রতিদিন শিল্পনগরীতে অন্তত এক কোটি টাকার ব্যবসায়ীক ক্ষতি হচ্ছে। এ অবস্থায় আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য কম সুদে এবং সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা দেওয়ার দাবি কারখানা মালিকদের।

সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ ও প্রণোদনা দাবি

ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিসিক শিল্পনগরী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন বলেন, শ্রমিকরা ঠিকমতো কাজে আসছে না। উৎপাদনও আগের তুলানায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। 

''এখন পর্যন্ত ২০০ কোটি টাকার ব্যবসায়ীক ক্ষতি হয়েছে আমাদের। এখনও প্রতিদিন গড়ে এক কোটি টাকা করে ক্ষতি হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে দেউলিয়া হয়ে পথে বসতে হবে''

''ব্যাংক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের চার শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়ার কথা থাকলেও আমরা এখন পর্যন্ত সেই সুবিধা পাচ্ছি না। বিসিক কর্তৃপক্ষও আমাদের কোনো সহযোগিতা করছে না'', বললেন জামাল উদ্দিন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিসিক শিল্পনগরীর সহকারী মহাব্যবস্থাপক বিল্লাল হোসেন ভূঁইয়া বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে প্রথম প্রথম শ্রমিকরা কাজে আসতে চাননি। পাশাপাশি পণ্যের চাহিদা কমার কারণে উৎপাদন কমে যায়। তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বভাবিক হয়ে আসছে।

''ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমরা কথা বলে আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি নিরূপণ করছি। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা প্রস্তুতের কাজও চলছে। এই তালিকাটি সব ব্যাংকগুলোতে দিয়ে দেওয়া হবে। এর ফলে ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আর কোনো সমস্যা হবে না'', যোগ করেন তিনি। 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.