করোনায় নতুন করে দারিদ্র্য সীমার নিচে দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ

অর্থনীতি

টিবিএস রিপোর্ট
21 April, 2021, 08:40 pm
Last modified: 22 April, 2021, 12:09 pm
স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় শহরাঞ্চলে দৈনিক মাথাপিছু উপার্জন ১৪ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হতদরিদ্র এবং মাঝারি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপার্জন করোনা পূর্ব সময়ের চেয়ে সাবলীল অবস্থায় ফিরলেও, নতুন করে দরিদ্র শ্রেণীতে যুক্ত হওয়া প্রায় দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ এখনও মহামারির প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে চলেছে। গত বছর আয় এবং কর্মসংস্থানের পুনরুদ্ধার সত্ত্বেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। গত মঙ্গলবার (২০ মে) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।

অর্থনীতির আংশিক এবং ক্ষণস্থায়ী পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি করোনা পূর্ব সময় অর্থাৎ, গত বছরের ফেব্রুয়ারির তুলনায় এ বছর গ্রামীণ অঞ্চলে দৈনিক উপার্জন ২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় শহরাঞ্চলে দৈনিক মাথাপিছু উপার্জন ১৪ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার(পিপিআরসি) পরিচালিত এক যৌথ সমীক্ষায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।

ছয় হাজার ৯৯টি পরিবারের উপর জরিপের মাধ্যমে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। "পোভার্টি ডায়নামিকস অ্যান্ড হাউজহোল্ড রিয়েলিটিজ" শীর্ষক গবেষণাটিতে উঠে আসা বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করেন পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান ও বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন।

মঙ্গলবার সকালে অনুষ্ঠিত এক ভার্চুয়াল সভায় প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়।

হোসেন জিল্লুর রহমান জানান, করোনার প্রথম ঢেউ চলাকালে সঞ্চিত অর্থ কমে যাওয়াসহ ঋণের বিশাল বোঝা নিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠী তাদের স্থিতীশীল অবস্থা হারিয়েছে। সেই সাথে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াও ছিল ক্ষণস্থায়ী ও আংশিক। দ্বিতীয় ঢেউ এমন এক সময় আঘাত হেনেছে যখন দরিদ্র জনগোষ্ঠী লড়াই করে টিকে থাকার মতো অবস্থায় নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।

মহামারির কারণে উপার্জন কমে যাওয়ায় গ্রামীণ অঞ্চলের মানুষ তাদের সঞ্চয়ের ২৪ শতাংশ হারিয়েছে। অন্যদিকে, শহরাঞ্চলে সঞ্চিত অর্থ হ্রাসের পরিমাণ ১১ শতাংশ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এছাড়া, ঋণগ্রহীতা পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। শহরাঞ্চলে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৮৬ শতাংশ। অন্যদিকে, গ্রামাঞ্চলে এই হার ৭৬ শতাংশ।

এ বছর মার্চ মাসে অতি দরিদ্র পরিবারগুলোর গড় ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৪৯৯ টাকা। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে যা ছিল ২২ হাজার ৪২৯ টাকা। মার্চ অবধি অতি দরিদ্র পরিবারগুলোর গড় ঋণের বোঝা ৮৯ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে, মাঝারি দরিদ্র পরিবারে গড় ঋণ বৃদ্ধির পরিমাণ ৯৮ শতাংশ। দরিদ্র নয় কিন্তু আর্থিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলোতে এই হার ৮৬ শতাংশ।

আর্থিক সহনশীলতা কমে যাওয়ায় দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী আরেকটি উপার্জন ধাক্কার সম্মুখীন হতে পারবে না বলে মন্তব্য করেন হোসেন জিল্লুর রহমান। নতুন উপার্জন ধাক্কা এড়াতে তিনি সরকারকে "সুচিন্তিত লকডাউন" আরোপের আহ্বান জানান।

এছাড়া, তিনি নতুন দরিদ্র গোষ্ঠী এবং শহরাঞ্চলের জন্য বিশেষায়িত একটি নতুন দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচী গ্রহণের প্রস্তাব রাখেন।

করোনা পূর্ব সময়ে যারা কাজ করতেন তাদের ১৭ শতাংশই গত বছর জুনে কর্মসংস্থানহীন হয়ে পড়ে বলে জানান ড. ইমরান মতিন।

কর্মসংস্থানের পুনরুদ্ধার সত্ত্বেও তাদের মাত্র ৪৯ শতাংশ পূর্বের কাজে ফিরে গেছেন। বাকি ৪১ শতাংশ নতুন পেশা খুঁজে নিয়েছেন। গত বছর, কর্মসংস্থান হারানো মানুষদের প্রায় ১০ শতাংশ কোনো ধরনের আয়ের সংস্থান খুঁজে পেতে ব্যর্থ হন।

এছাড়া, দক্ষ শ্রমিক (১৪%), বেতনভুক্ত কর্মচারী (১৩%) এবং গৃহকর্মীদের (৩২%) মাঝে কর্মসংস্থানহীনতার হার উচ্চ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

মহামারির কারণে পরিবহন শ্রমিকদের উপার্জন ১৫ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে, বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন শ্রমিকদের মাঝে এই হার ২২ শতাংশ। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং রিকশা চালকদের উপার্জন হ্রাসের হার যথাক্রমে ১৬ শতাংশ এবং ১৯ শতাংশ।

আয়ের পুনরুদ্ধারে পিছিয়ে থাকার পাশাপাশি শহরের মানুষ ব্যয়ের পুনরুদ্ধারের দিক থেকেও পিছিয়ে আছে বলে জানায় এই প্রতিবেদন।

প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, গত বছরের ফেব্রুয়ারির তুলনায় এ বছর মার্চে গ্রামীণ অঞ্চলে খাবারের পিছে মাথাপিছু ব্যয় ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও, শহরে এই ব্যয় ১৭ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে।

গবেষণায় অংশ নেওয়া শহরের প্রায় ৫২ শতাংশ পরিবারে গত এক সপ্তাহের খাদ্য তালিকায় মাংস ছিল না। এছাড়া, ঐ এক সপ্তাহে ৭২ শতাংশ পরিবার দুধ এবং ৪০ শতাংশ পরিবার ফলমূল গ্রহণ করা থেকে বিরত ছিল।

খাদ্যের বাইরে অন্যান্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে শহরের বস্তিবাসী প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছে। গত এক বছরে এসব পরিবারের খাদ্য ব্যতীত অন্যান্য পণ্যের পিছে গড় খরচের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

বস্তি এলাকায় গত এক বছরের ভাড়ার পরিমাণ ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে, স্বাস্থ্যখাতে ৮১ শতাংশ, পরিবহন ও যাতায়াতে ১০৪ শতাংশ এবং ইউটিলিটিতে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে।

করোনা সংকটকালীন ঝুঁকির তিনটি চলকের মধ্যে খাদ্য ব্যতীত অন্যান্য পণ্যের পিছে ব্যয় বৃদ্ধিকে অন্যতম হিসেবে চিহ্নিত করেন হোসেন জিল্লুর রহমান।

তিনি আরও জানান, পছন্দ অনুযায়ী কর্মসংস্থান বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। "দক্ষতা নির্ভর নয় এমন খাতগুলোকে কেন্দ্র করে পেশাগত পুনরুদ্ধার অর্জিত হয়েছে। শহর এবং গ্রাম উভয় স্থানেই প্রায় ৪১ শতাংশ মানুষকে কম দক্ষতাপূর্ণ খাতে অগ্রসর হতে হয়েছে।"

শ্রমবাজারে নারীদের কর্মহীনতা বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। নারীদের উপার্জনের উপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোতে পুরুষদের তুলনায় কর্মসংস্থানহীনতার হার পাঁচ গুণ বেশি। এছাড়া, শ্রম বাজারে নারীরা কর্মসংস্থানের পুনরুদ্ধারে অধিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি আরও জানান, মহামারির এক বছর পর মার্চ মাসে এসেও দরিদ্র জনগোষ্ঠী সামাজিক নিরাপত্তা সহায়তা থেকে প্রায় বঞ্চিতই থেকে গেছে।

প্রতিবেদনের উল্লেখ করে তিনি বলেন, দরিদ্র পরিবারগুলোর ১৩ শতাংশ বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়দের সহায়তার উপর নির্ভর করছে। মার্চে মাত্র ২ শতাংশ পরিবার সরকারি সহায়তা লাভ করে। গত বছর জুনে এই হার ছিল ৯ শতাংশ। অন্যান্য সংস্থা থেকে প্রাপ্ত সহায়তার পরিমাণও সম্প্রতি কমে গেছে।

২২ শতাংশ মানুষ গত বছর ফেব্রুয়ারিরে দরিদ্র না হলেও, মহামারির বিরূপ প্রভাবের কারণে গত বছর এপ্রিল নাগাদ দারিদ্রসীমার নিচে পতিত হন। নতুন দারিদ্র্যের হার গত বছর জুনে ২১ দশমিক ২৪ শতাংশ পর্যন্ত কমে। অন্যদিকে, গত মার্চ মাসে তা ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত নেমে আসে।

হোসেন জিল্লুর রহমান জানান ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ করোনার কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়ে যায়।

গত বছর এপ্রিলে নতুন করে দরিদ্র শ্রেণিতে যুক্ত হওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল তিন কোটি ৬৫ লাখ। তবে, প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, গত বছরই নতুন দরিদ্র শ্রেণির এক কোটি ২০ লাখ মানুষ পুনরুদ্ধার লাভ করে।

বিষয়টি ব্যখ্যা করে জিল্লুর রহমান জানান, এই জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ দারিদ্র্যসীমার সামান্য উপরে বসবাস করে। তাদেরকে ঝুঁকিপূর্ণ মধ্যবিত্ত বলা হয়ে থাকে। এই শ্রেণির পেশাজীবীদের মধ্যে আছে অনিয়মিত খাতের গাড়িচালক, নিরাপত্তা কর্মী, পরিবহন কর্মী, রেস্টুরেন্ট কর্মচারী, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, স্বনিযুক্ত কর্মজীবী এবং নির্ধারিত বেতনভোগী কর্মচারীরা।

তিনি জানান, এই মানুষগুলো নির্দিষ্ট আয়ের উপর জীবিকা নির্বাহ করে অভ্যস্ত এবং তাদের জীবনযাপনের গতিপ্রকৃতিও নির্ধারিত। মহামারির কারণে উপার্জন কমে যাওয়ায় তারা দারিদ্র্যে পতিত হন।

উপার্জন পুনরুদ্ধার করতে নতুন দরিদ্র শ্রেণি সবথেকে বেশি প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছে। শহরে তাদের সংখ্যা বেশি। আর তাই, ভবিষ্যতে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচীতে শহরাঞ্চল এবং নতুন দরিদ্রদের উপর অধিক মনোযোগ দেওয়া উচিত হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

গত বছরের মহামারি ধাক্কা থেকে তারা কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছিল। তখন তাদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার মতো সক্ষমতাও ছিল। কিন্তু এবার, দরিদ্র এই জনগোষ্ঠীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের সাথে মানিয়ে নেওয়ার মতো সামর্থ্য অত্যন্ত সীমিত।

এছাড়া, সঞ্চয়ের পরিমাণ উল্লেখজনকহারে কমে গেছে। ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণে পরিণত হয়েছে। করোনার প্রথম ঢেউ চলাকালে পরিবারগুলোর উপার্জন ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। "আমরা এখন এই ধাক্কা কীভাবে সামলে দেই, তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করে," বলেন হোসেন জিল্লুর।

সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচীর আওতায় কেবলমাত্র নামমাত্র অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিল। মানুষের আর্থিক সক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় বর্তমানে এই বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানো অপরিহার্য।

সীমিত আকারের পরিবর্তে বিস্তৃত পরিসরে কর্মসূচী গ্রহণের পরামর্শও দেন তিনি।

অ্যাকশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, শহরে ঘরভাড়া এবং খাদ্য ব্যয় বহন করতে ব্যর্থ হওয়ায় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালে বিপুল সংখ্যক মানুষ গ্রামে চলে গেছে।

নতুন করে গ্রামে চলে যাওয়া মানুষদের আর্থিক সহনশীলতা বাড়াতে সরকারকে পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেন ফারাহ কবির। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.