ওপেক্স গ্রুপের কাঁচপুরের কারখানাগুলো কেন বন্ধ হলো? খাত সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে দেশের অন্যতম বৃহৎ পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠান ওপেক্স গ্রুপের কাঁচপুরের সকল কারখানা। ৪০ হাজারের বেশি শ্রমিকের রুটি-রুজির উৎস এবং ৩০০ মিলিয়ন ডলারের সরাসরি রপ্তানিসহ যাদের বার্ষিক টার্নওভার ছিল ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ওপর, সেই ওপেক্স গ্রুপ নারায়নগঞ্জের কাঁচপুরে অবস্থিত সকল গার্মেন্টস ইউনিট বন্ধ ঘোষণা করেছে।
কারখানাটি নিয়ে এক সময় বাংলাদেশের পোশাকখাত সংশ্লিষ্টরা গর্ব করতেন। ওপেক্সের হাত ধরে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ব্র্যান্ড। গত ১৮ অক্টোবর কারখানা কর্তৃপক্ষ এক নোটিশের মাধ্যমে শ্রম আইনের ২৮(ক) ধারা অনুযায়ী, কাঁচপুরের সকল গার্মেন্টস ইউনিট বন্ধ ঘোষণা করে। ওই ঘোষণায় আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা হবে বলেও জানানো হয়।
অবশ্য একই মালিকের টেক্সটাইল কারখানা এবং রাজধানীর মিরপুরসহ অন্য এলাকায় অবস্থিত কারখানাগুলো এখন পর্যন্ত বন্ধের ঘোষণা আসেনি। তবে খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ওইসব কারখানাও কতদিন চলবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির দাবি, এটি ছিল এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ পোশাক টেক্সটাইল কারখানা। তবে বাংলাদেশে ৯০ এর দশকে যখন কারখানাটি প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এটিই ছিল সবচেয়ে বড় পোশাক কারখানা। পরবর্তীতে সংকটের কারণে ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসা পোশাক কারখানাটিতে সর্বশেষ শ্রমিক ছিল ১৩ হাজারের মতো, যারা এখন কর্মহীন হলেন।
দেশের গার্মেন্টস খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওপেক্স গ্রুপের কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা এই খাতে বড় ধরনের ঝাঁকুনি তৈরি করেছে। পোশাক খাতের মালিকদের মধ্যে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে।
বাংলাদেশ গারমেন্ট ম্যানুফেকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং পোশাক উদ্যোক্তা আনিসুর রহমান সিনহার মালিকানাধীন বিশাল এ শিল্প কেন বন্ধ হয়ে গেল? পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য কী শিক্ষা রয়েছে এতে?
এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে পোশাকখাতের সাত উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। মোটাদাগে যেসব সমস্যা বেরিয়ে এসেছে তা হলো, সব বিনিয়োগ এক স্থানে নিয়ে আসা এবং মাত্রাতিরিক্ত সক্ষমতা তৈরি করা।
এছাড়া ছোট বড় কারণে শ্রম অসন্তোষ, শ্রম আইনের বাইরে কর্মীদের বাড়তি সুবিধাপ্রদান, নিজের উত্তরাধিকারের হাতে ব্যবসা হস্তান্তর করতে না পারা, অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের কারখানা পরিদর্শনে সৃষ্ট সমস্যা ও এর জেরে কিছু ক্রেতা চলে যাওয়া এবং সর্বশেষ করোনার সময় ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় বিপদে পড়ে ওপেক্স।
মাসে অন্তত এক কোটি পিসের অর্ডার থাকতে আসত। তবে, অর্ডার অসুক বা না আসুক, মাসে বেতন ভাতা বাবদ প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয় করতে হতো।
দিনে দিনে ব্যাংকে দায় বাড়তে থাকে আনিসুর রহমান সিনহার। গ্যাস-বিদ্যুৎসহ সরকারের পরিষেবা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছেও কোটি কোটি টাকা বকেয়া পড়তে থাকে। ফলে বন্ধুরাও সরে যায় তার কাছ থেকে। সর্বশেষ বকেয়া পরিশোধ না করায় কয়েক মাস আগে কাঁচপুরের কারখানার গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ।
গত প্রায় এক মাস আগে নতুন নোটিশে বন্ধ হওয়া এসব কারখানার শ্রমিকরা তিন থেকে সাত মাসের পাওনা পরিশোধের দাবিতে রাজধানীর বিজয়নগরে শ্রম ভবনের সামনে অনশন কর্মসূচী পালন করেন।
কারখানাটির দেনা পরিশোধে সংগঠনটির পক্ষ থেকে কারখানা মালিককে গত সেপ্টেম্বরে তিন কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয় বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান বিজিএমইএ'র ভাইস প্রেসিডেন্ট শহীদুল্লাহ আজীম।
নানামুখী সংকটে পড়ে দায়দেনায় জর্জরিত হওয়া কারখানাটি শেষ পর্যন্ত কতদিন টিকে থাকে– তা নিয়ে তখন আলোচনা চলছিল বলে জানান তিনি।
এসব বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে আনিসুর রহমান সিনহার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
ঘটনার পরম্পরা
৯০ এর দশক থেকে পোশাক খাতে একের পর এক সাফল্য দেখতে শুরু করে ওপেক্স গ্রুপ। দিনে দিনে বড় হতে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। ২০০০ সালের শুরুর দিকে এসে কারখানাটি বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়। ২০১০ সালের আগ পর্যন্ত কারখানাটি বলতে গেলে শীর্ষ পর্যায়েই ছিল। আদমজী ইপিজেড, মিরপুর ও নারায়নগঞ্জের অন্য একটি এলাকায় কারখানা থাকলেও কাঁচপুর ব্রিজ সংলগ্ন ওপেক্স গ্রুপের কারখানাগুলোতে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কাজ করতেন।
আনিসুর রহমান সিনহা একে একে এখানেই স্পিনিং ও উইভিংয়ে বিনিয়োগ ঢালতে থাকেন। অর্থাৎ, কটন আমদানির পর সুতা ও কাপড় এবং তৈরি পোশাক উৎপাদন কেবল একই জায়গাতেই থাকবে।
সিনহার ঘনিষ্ঠ বিজিএমইএ'র একজন নেতা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডর্ডকে বলেন, "শ্রমনির্ভর ও মূলধননির্ভর বিনিয়োগ এক জায়গায় নিয়ে আসা ছিল তার অন্যতম বড় ভুল। তাত্ত্বিক বিচারে এটি ঠিক থাকলেও, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বাস্তবতায় তা সঠিক ছিল না। ফলে পান থেকে চুন খসলেই শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে যেত এবং দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে বন্ধ করে দিত। এসব কারণে বন্ধ থাকত তার টেক্সটাইল ইউনিটও।"
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই তাজরিন ও রানা প্লাজার ঘটনার পর দেশে কারখানা পরিদর্শন শুরু করে ইউরোপ ও আমেরিকার বায়ারদের জোট অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স। তাদের সঙ্গে মতপার্থক্যের জেরে তার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসা না করার জন্য বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। বড় দুই-একজন ক্রেতা শুরুতে ব্যবসা বন্ধ করার পর অন্যরাও তাদের অনুসরণ করতে শুরু করে।
এখানেই ওপেক্স গ্রুপ বড় ধাক্কাটি খায়। বিপুল কাজের সক্ষমতা থাকলেও সেই অনুযায়ী অর্ডার থাকত না। অথচ মাসে বেতনভাতাসহ অন্যান্য ব্যয় মিলিয়ে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হতো। ফলে বাড়তে থাকে ব্যংকের দায়দেনা।
আবার বয়স ৮০'র কোঠায় চলে আসা আনিসুর রহমান সিনহার ব্যবসা পরিচালনার জন্য সক্রিয় উত্তরাধিকারী নেই। তার একমাত্র কন্যা লন্ডনে থাকেন। মাঝে মাঝে দেশে এসে ব্যবসা দেখাশোনা করলেও মানিয়ে নিতে পারেননি। অর্থাৎ ব্যবসা চালানোর জন্য আনিসুর রহমান সিনহা দ্বিতীয় প্রজন্ম তৈরি করতে পারেননি, যা দেশের অন্যান্য বড় পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা অনেকটা সফলভাবে করতে পেরেছিলেন।
তার অপর ভাই আরিফুর রহমান সিনহা মেডলার অ্যাপারেলস লিমিটেডের মালিক এবং বিদ্যুত খাতেও তার বিনিয়োগ রয়েছে। তিনি নিজেই নিজের ব্যবসা দেখভাল করেন।
দিনে দিনে দায়দেনা বাড়তে থাকায় সাম্রাজ্য ছোট হয়ে আসে আনিসুর রহমান সিনহার। সর্বশেষ গত বছর শুরু হওয়া করোনা মহামারি ও এর জেরে কারখানা বন্ধ থাকা, ক্রয়াদেশ বাতিল হওয়া ওপেক্স গ্রুপকে সবচেয়ে বড় বিপদে ফেলে দেয়, যা থেকে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেও কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়নি। ১০ থেকে ১২টি ব্যাংকের সঙ্গে ব্যবসা থাকলেও ঝুঁকি কমাতে একে একে সরে যেতে থাকে 'সুসময়ের বন্ধুরা'।
বিপুল ক্রয়াদেশের এমন সময়েও কেন টিকতে পারল না
করোনা ভাইরাসের ধাক্কা সমলে গত কয়েক মাস ধরে দেশের সব কারখানায় অর্ডার বাড়ছে। অনেক কারখানা অর্ডার নিতেও পারছে না। আবার কোনো কোনো কারখানাকে সাব কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে কাজ করিয়ে নিতে হচ্ছে।
কারখানাগুলোর জেগে ওঠার এই সময়ে কেন ওপেক্স গ্রুপের কারখানাগুলো বন্ধ হচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে বিজিএমইএ'র সাবেক সহসভাপতি ও তাইজিং গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মাহমুদ হাসান খান বাবু দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "অর্ডার থাকলেও ব্যাংক যদি ব্যাক টু ব্যাক এলসি ওপেন না করে, তাহলে ওই অর্ডারের কাজ করবে কীভাবে? ব্যাংকগুলো সাহায্য করছিল না।"
এরপরই আসে কারখানা বন্ধের নোটিশ। ওপেক্স গ্রুপের পরিচালক কমান্ডার বনিজ আলী স্বাক্ষরিত ওই নোটিশে বলা হয়, "ওপেক্স গ্রুপের স্বত্বাধিকারী ২০১২ সাল থেকে কাঁচপুরের সব গার্মেন্টস কারখানা আর্থিক ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও ঋণ করে এবং জমিজমা বিক্রি করে সবার বেতনভাতা ও অন্যান্য খরচ প্রদান করে কারখানা চালু রেখেছিলেন। কিন্তু করোনা অতিমারি, অর্ডারের অভাব, শ্রমিকদের বিশৃঙ্খলা ও কাজে অনীহা, নিম্নদক্ষতা ও সময়ে সময়ে কারখানার কার্যক্রম বন্ধ রাখার কারণে বর্তমানে আর কারখানাগুলো চালানো সম্ভব হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার নিরাপত্তার স্বার্থে কাঁচপুর শাখার সব গার্মেন্টস ইউনিট ও ওয়াশ প্লান্ট বন্ধ ঘোষণা করা হলো।"
শ্রমিকদের পাওনার কী হবে
কারখানা কর্তৃপক্ষের ওই নোটিশে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে বেতন পরিশোধের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপত মোহাম্মদ হাতেম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "তিনি তার সম্পত্তি বিক্রি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। হবিগঞ্জ, নারায়নগঞ্জের কাঞ্চনসহ আরো কিছু জায়গায় জমি আছে বলেও জানতাম।"
শহীদুল্লাহ আজীম বলেন, "শ্রমিকরা যেন দ্রুত তাদের পাওনা পায়, সেজন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।"
উদ্যোক্তাদের জন্য কী শিক্ষা
বিজিএমইএ'র একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মাত্রাতিরিক্ত সক্ষমতা নিজের জন্য এবং খাতের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে। আমার এত বেশি খাওয়ার চেষ্টা করা ঠিক হবে না, যা পরবর্তীতে বদহজম হতে পারে।"
অপর একজন সাবেক সহসভাপতি বলেন, "সক্ষমতা সামর্থ্যের মধ্যে রাখার পাশাপাশি মূলধন ও শ্রমনির্ভর বিনিয়োগ একই জায়গায় করার সিদ্ধান্তটি ভুল প্রমাণিত হলো, অন্তত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। কারখানাটির অবস্থান কোথায়, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিজের অবর্তমানে ব্যবসা কে পরিচালনা করবে, তা তৈরি করতে না পারলে ব্যবসা অনেক বড় করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।"