উচ্চ শিক্ষার অর্থনীতি আরও বাজে রূপ নিচ্ছে

অর্থনীতি

নোয়াহ স্মিথ, ব্লুমবার্গ 
26 June, 2021, 03:20 pm
Last modified: 26 June, 2021, 05:28 pm
প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেন সবচেয়ে বড় যে অবদান রাখতে পারেন তা হলো; উচ্চ মূল্য দেওয়া আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী প্রবাহ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ। কিন্তু, এনিয়ে বেশি আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না; কারণ সিংহভাগ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী চীন থেকেই আসতো। আর দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্বের ফলে চীনা শিক্ষার্থীদের ওপর গুপ্তচর বৃত্তির সন্দেহ বাড়ছে। মার্কিন ক্যাম্পাস সমূহে তার ফলে চীনা শিক্ষার্থীর পরিমাণও কমছে।

মানসম্মত উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থার সুবিধা নিয়ে এগিয়ে রয়েছে উন্নত দেশগুলো। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরাও তাই উন্নত বিশ্বমুখী উচ্চ শিক্ষার সন্ধানে। কিন্তু, এই শিক্ষা ব্যবস্থার আর্থিক পরিমণ্ডলেই পরিবর্তনের গতি যোগ করেছে মহামারি। 

যেমন; যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশে দীর্ঘদিন ধরেই উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা এক আমূল পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছিল। মহামারি পরবর্তীকালে আন্ডারগ্রাজুয়েট শিক্ষার চাহিদা কমায়, এখন দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দীর্ঘমেয়াদী তহবিল সঙ্কটে পড়েছে। দীর্ঘমেয়াদী হওয়ার কারণ, পুরো বিশ্বের সামগ্রিক অর্থনীতিতে মহামারির আঘাত; যার ফলে সহসাই মহামারি পূর্ব সময়ের মতো শিক্ষার্থীর ঢল যে দেখা যাবে না- তা সহজেই অনুমান করা যায়। ফলে খরচ মেটাতে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এখন নতুন উপায় সন্ধান খুঁজে বের করতে হবে, আর তা সম্ভব না হলে প্রাতিষ্ঠানিক বিলুপ্তির ঝুঁকিই প্রবল। 

মহামারি শুরুর সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আসন্ন সংকট নিয়ে দেওয়া হয় অনেক আভাস। কিন্তু, ওই সময়ে মার্কিন সরকারের বৃহৎ প্রণোদনার চেষ্টা থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিকল্প উপায় নিয়ে উদ্যমী হয়নি। তাই উচ্চ শিক্ষা খাতে বিপর্যয় নিয়ে করা আশঙ্কা দিনশেষে দুঃখজনকভাবে বাস্তবে রূপ নিতে চলেছে।     

২০২০ সালে উচ্চ শিক্ষা খাতে সাড়ে ৬ লাখ নিয়োগ কমে, যা আগের চাইতে ১৩ শতাংশ কম। অচিরেই যে উদ্ধারের আশা নেই তার প্রমাণও স্পষ্ট। যেমন; বসন্তকালীন সেমিস্টারে শিক্ষার্থী ভর্তির হতাশাজনক সংখ্যা প্রমাণ করছে- মহামারি কালে সংখ্যাটির যে ব্যাপক পতন হয়েছে, সহসাই তা পুনরুদ্ধার হবে না। গেল বছরের তুলনায় এবছরে আন্ডারগ্রাজুয়েট শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ৪.৯ শতাংশ। উচ্চ শিক্ষার সব খাত প্রভাবিত হলেও, সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয় ২ বছর মেয়াদী শিক্ষাক্রমের সরকারি কলেজগুলো; 

স্নাতক পূর্ববর্তী শিক্ষার্থী ভর্তি কমে আসা বা সমান সমান থাকার এই হার আসলে মহামারির কয়েক বছর আগে থেকেই দৃশ্যমান হচ্ছিল। ফলে গত পাঁচ বছরে ৫০টির বেশি কলেজ হয় বন্ধ হয়ে গেছে, নাহয় একীভূত হয়েছে। সম্প্রতি হারিয়ে যাওয়া এমন একটি প্রসিদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের মিলস কলেজ।   

কেন এমন হচ্ছে? - সে প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে উচ্চ শিক্ষার অর্থায়ন ব্যবস্থার মধ্যে। শিক্ষার প্রসারে গত ৫০ বছর ধরে সরকারি নিশ্চয়তা সহকারে এবং ভর্তুকির মাধ্যমে অনেক 'ছাত্র ঋণ' দেওয়া হয়েছে। এতে কলেজ ফি দিতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়তেই উৎসাহিত হয়। তবে ২০১৫ সালে অর্থনীতিবিদ ডেভিড ও. লুকা, টেইলার নাডল্ড ও কারেন শেন- তাদের এক গবেষণা নিবন্ধে দেখান, সরকারি ঋণ সহায়তার সুযোগ নিয়ে কলেজগুলো তাদের টিউশন ফি অনাবশ্যকভাবে বৃদ্ধি করেছে। ফলাফল; কলেজগুলোয় শিক্ষা ব্যয় বহুগুণে বৃদ্ধি এবং স্নাতক শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে বিপুল দেনার বোঝা।  

কয়েক দশক ধরে ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলা 'ছাত্র ঋণ' এমন এক প্রক্রিয়া যা চিরতরে দূর হবে না। স্নাতক হয়ে কর্মজীবনে প্রবেশের পরও অনেক তরুণ কীভাবে বহু বছর দেনার চাপে পারিবারিক জীবন শুরু করতে পারছেন না- এমন দুর্ভোগের অনেক বাস্তব কাহিনী আজ আমাদের জানা। দেনার ফাঁদে নষ্ট হয়েছে উজ্জ্বল কিছু সম্ভাবনা। অথচ দীর্ঘদিন ধরে কলেজ ডিগ্রীর প্রলোভনই মানুষকে ঋণ নিতে এবং কলেজের আরও বাড়তি ফি পরিশোধ চালিয়ে যাওয়ার শিকারে পরিণত করেছে। কিন্তু, সব কিছুর যেমন সীমা থাকে ঠিক তেমনি এই ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ সীমা এসে গেছে। এর আরেক কারণ, কলেজ শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ আয় গত কয়েক বছর ধরেই স্থির পর্যায়ে রয়েছে; যার অর্থ কলেজে অংশগ্রহণের লাভ শিক্ষামূল্যের সঙ্গে সঙ্গতিহীন হয়ে পড়েছে।    

তার ওপর আবার অতীতের বিশ্ব মন্দা কলেজে সরকারি তহবিল যোগানে বড় রকমের আঘাত হানে। অর্থের অভাবে অনেক রাজ্যই উচ্চ শিক্ষায় ব্যয় কমায়, বিশ্ব মন্দা পরবর্তীকালে এই তহবিল দানের প্রক্রিয়া আংশিক পুনরুদ্ধার লাভ করেছিল। ফলে তখন থেকেই স্বচ্ছল থাকতে টিউশন ফির ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি হয় কলেজগুলোর। সরকারি অর্থায়নের ঘাটতি পূরণে তারা বেশি ফি দেওয়া আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ভর্তি বাড়ায়। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল ২০১৬ সালেই। তারপর ডোনাল্ড ট্রাম্পের বর্ণবিদ্বেষী নীতি ও ভিসা ব্যবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টায় এ সংখ্যাটি পতনের পেছনে নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।   

গুরূত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো; এ বাস্তবতায় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কী পদক্ষেপ নিতে পারে? জো বাইডেন প্রশাসনের করোনাভাইরাস সহায়তা প্যাকেজ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক দুর্গতি আংশিক লাঘব করেছে বটে, কিন্তু তার সঙ্গে এটাও পরিষ্কার যে; এটি শিক্ষা খাতের সহায়তায় কেন্দ্রীয় সরকারের স্থায়ী দায়িত্বগ্রহণ নয়। কমিউনিটি কলেজ পর্যায়ে বরাদ্দ বাড়িয়ে সেখানে শিক্ষাগ্রহণ অবৈতনিক করার পদক্ষেপ প্রেসিডেন্ট বাইডেন হয়তো নিতে পারেন। এমনকি নিচু সাড়ির র‍্যাঙ্কিংয়ে থাকা ক্যাল স্টেট ও সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্কের মতো প্রতিষ্ঠানেও তহবিল যোগানের উদ্যোগ নিয়ে- তিনি হয়তো সামগ্রিক মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে শিক্ষিত করার গুরুদায়িত্ব রাষ্ট্রকে দিতে পারেন। 

তবে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেন সবচেয়ে বড় যে অবদান রাখতে পারেন তা হলো; উচ্চ মূল্য দেওয়া আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী প্রবাহ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ। কিন্তু, এনিয়ে বেশি আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না; কারণ সিংহভাগ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী চীন থেকেই আসতো। আর দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্বের ফলে চীনা শিক্ষার্থীদের ওপর গুপ্তচর বৃত্তির সন্দেহ বাড়ছে। মার্কিন ক্যাম্পাস সমূহে তার ফলে চীনা শিক্ষার্থীর পরিমাণও কমছে।
 
যার অর্থ দাঁড়ায় উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের সামনে তাদের ব্যয় কমানো এবং নতুন তহবিলের উৎস যোগাড়ের কোনো বিকল্প নেই। প্রশ্ন হলো; শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোন ধরনের ব্যয় কমাবে? এক্ষেত্রে প্রশাসনিক ব্যয় কমানোকে বর্তমানে সবচেয়ে স্পষ্ট লক্ষ্য বলে মনে হচ্ছে।

এই ব্যয় কমার অর্থ; ছাত্রাবাসের সুযোগ-সুবিধা কমবে, ভাটা পড়বে ছাত্র জীবনের শিক্ষা বহির্ভূত নানা কর্মকাণ্ড আয়োজনেও। কিন্তু, তা নিয়ে খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা নয়, কারণ বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষার্থীদের অভিজাত ক্লাব সদস্যদের মতো সমাদর না করলেও, আর্থিকভাবে স্বচ্ছল তরুণ শিক্ষার্থীরা রোমাঞ্চকর জীবনযাপনের নানান উপায় নিজেরাই খুঁজে বের করতে সক্ষম। 

তবে দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হলো; প্রশাসনিক ব্যয় কমলে তাতে করে মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ ও গবেষণা উভয় খাতই নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হবে। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে হয়তো দেখা যাবে, বিশেষজ্ঞ শিক্ষকের বদলে ক্লাস গ্রহণে শিক্ষা সহকারী, মেয়াদ ছাড়া নিয়োগকৃত শিক্ষক ও স্নাতক শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি। শিক্ষাদানের ক্ষয়িষ্ণু এ মান এর উন্নতি কামনাকারী বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের কারোরই কাম্য নয়। তবে এর ফলে শিক্ষাগত নির্দেশনার দিকটি হয়তো খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

বরং গবেষণায় বরাদ্দ কমাটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। যুক্তরাষ্ট্রে বেশিরভাগ গবেষক ভালো অংকের গবেষণা অনুদান পেলেও; তাদের বেতনভাতা ও গবেষণা সহযোগী নানা অবকাঠামো নির্মাণের খরচ দেয় বিশ্ববিদ্যালয়। টিউশন ফি কমলে এসব খরচেরও লাগাম টেনে ধরতে হবে। এমনটি হলে উদ্ভাবনের যে শূন্যতা দেখা দেবে তাতে করে যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক অর্থনীতি-ই প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাতে থাকবে। তাই আশা করা যায়, জাতীয় নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির স্বার্থে কেন্দ্রীয় সরকার বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় ল্যাবরেটরি পর্যায়ে তহবিল সাহায্যের পরিমাণ বাড়াবে।  

সরকারের বাইরে নতুন তহবিল উৎস হতে পারে দাতব্য অনুদান। সম্প্রতি বিলিয়নিয়ার ম্যাকেঞ্জি স্কট সামাজিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ের কলেজগুলোয় ২৭৩ কোটি ডলার দানের ঘোষণা দেন। আশা করা যায়, অন্যান্য অতি-ধনীরাও তার পদাঙ্ক অনুসরণে এগিয়ে আসবেন। আইভি লীগের মতো অভিজাত আয়োজনের চাইতে শিক্ষা গবেষণায় ধনীদের অনুদান বহুগুণে সমাজ ও রাষ্ট্রের উপকার করবে।  

যেভাবেই হোক, উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের আমূল সংস্কার এড়ানোর আর উপায় নেই। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের ওপর ক্রমাগত বেশি অর্থদানের বোঝা চাপিয়ে এসেছে। নিরুপায় ছাত্ররাও ক্ষোভ চেপে রেখে এই মূল্যদানে বাধ্য হয়েছে। সেই যুগ এখন গত। এ বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে আগামীদিনের পরিকল্পনা করাই এখন একমাত্র পথ। 

  • লেখক: ব্লুমবার্গের মতামত কলামিস্ট নোয়াহ স্মিথ যুক্তরাষ্ট্রের স্টোনি ব্রুক ইউনিভার্সিটির অর্থায়ন বিভাগের অধ্যাপক। 
  • সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত 
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.