ই-কমার্স: অর্ডারের ৭ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ না করলে জরিমানা
পণ্যের অর্ডার দেওয়ার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা ক্রেতার হাতে পৌঁছে দেওয়া, তাতে ব্যর্থ হলে অগ্রিম নেওয়া পণ্যমূল্য জরিমানাসহ ফেরত দেওয়া, খারাপ পণ্য সরবরাহকে ফৌজদারি আইনের আওতায় প্রতারণা হিসেবে গণ্য করাসহ বিভিন্ন বিধান রেখে ই-কমার্স ব্যবসার জন্য নীতিমালা হচ্ছে।
নীতিমালার একটি খসড়াও ইতোমধ্যে তৈরি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। খসড়াটি চূড়ান্ত করতে আগামী সপ্তাহে এই খাতের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বৈঠক করবে।
তবে এই নীতিমালা শুধু ওয়েবসাইটভিত্তিক প্রাতিষ্ঠানিক ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর জন্য। ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেন্দ্রিক ছোট ছোট ই-কমার্স উদ্যোগের জন্য পরে আলাদা একটি নীতিমালা করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
দেশে ওয়েবসাইটভিত্তিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এখন প্রায় ২ হাজার। ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেন্দ্রিক উদ্যোগ রয়েছে ৫০ হাজারেরও বেশি।
ই-কমার্স খাতে সৃষ্ট নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণ এবং ক্রেতা স্বার্থ সংরক্ষণের মাধ্যমে খাতটির বিকাশ সহজীকরণ করতে নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সুস্পষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে ই-কমার্সে ক্রেতাদের আস্থা ফেরাতে পারলে আগামি এক বছরের মধ্যে এই খাতে ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সম্ভব হবে বলে মনে করছে মন্ত্রণালয়।
খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, অনলাইনে কোনো পণ্যের অর্ডার দেওয়ার সর্বোচ্চ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সেটি ক্রেতার কাছে পাঠানোর জন্য ডেলিভারিম্যানের কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য থাকবে ই-কমার্স কোম্পানিগুলো।
ক্রেতা-বিক্রেতার অবস্থান একই জেলায় হলে ডেলিভারিম্যান সাতদিনের মধ্যে পণ্য ক্রেতার হাতে পৌঁছে দেবেন। ক্রেতা অন্য জেলার হলে পণ্যটি তার হাতে পৌঁছাতে সর্বোচ্চ ১০ দিন সময় পাবেন ডেলিভারিম্যান।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হলে ক্রেতার কাছ থেকে নেওয়া অগ্রিম নেওয়া মূল্য ফেরত দেওয়ার পাশাপাশি আর্থিক জরিমানা গুণতে হবে সংশ্লিষ্ট ই-কমার্স কোম্পানিকে।
নীতিমালার খসড়ায় এছাড়াও বলা হয়েছে, কোনো পণ্য কোম্পানির স্টকে না থাকলে সেই পণ্যের অর্ডার নেওয়া যাবে না। অনলাইনে প্রদর্শিত পণ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক সঠিক স্পেসিফিকেশন উল্লেখ থাকতে হবে, যাতে ক্রেতারা পণ্যের গুণগত মান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন।
ভালো মানের পণ্যের ছবি ও স্পেসিফিকেশন দেখিয়ে খারাপ পণ্য ডেলিভারি করলে প্রতারণা হিসেবে গণ্য করা হবে। এজন্য ফৌজদারী আইনের ৪২০ ধারা অনুযায়ী কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে মামলা করতে পারবেন ক্রেতারা।
উদ্যোক্তা, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মতামত নিয়ে খসড়া নীতিমালাটি চূড়ান্ত করার পর দ্রুতই তা অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও কেন্দ্রীয় ই-কমার্স সেলের প্রধান মো. হাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, ক্রেতার আস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে ই-কমার্স খাতের বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখতেই নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে। চূড়ান্ত নীতিমালা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হবে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে। এজন্য অধিদপ্তরের আইনও সংশোধন করা হবে।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ তমাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটি নীতিমালা তৈরি করছে। তবে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো আমাদেরকে দেওয়া হয়নি। আমরা ই-ক্যাবের পক্ষ থেকে আগেই বিভিন্ন সুপারিশসহ লিখিত একটি প্রস্তাবনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি।'
ই-ক্যাব ক্যাশ অন ডেলিভারি সিস্টেমের পরিবর্তে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড এবং মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে অগ্রিম মূল্য পরিশোধ ব্যবস্থার প্রস্তাব করেছে।
এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে ই-ক্যাব কর্মকর্তারা বলেন, ক্যাশ অন ডেলিভারিতে ই-কমার্স কোম্পানিগুলো সরাসরি ক্রেতার কাছ থেকে পণ্যমূল্য পায় না। ডেলিভারিম্যান থেকে পণ্যমূল্য পেতে দু-একদিন সময় লেগে যায়।
আবার ক্রেতা কোনো পণ্য গ্রহণ না করলে ই-কমার্স কোম্পানিকে ডাবল ডেলিভারি চার্জ গুণতে হয়, যার পুরোটাই লোকসান। ক্রেতা কার্ডের মাধ্যমে অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করলে এই সমস্যা থাকবে না।
এজন্য ক্রেতা ও ই-কমার্স কোম্পানির মধ্যবর্তী একটি সংস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়ে ই-ক্যাব বলেছে, অগ্রিম পরিশোধ করা মূল্য ওই সংস্থার একাউন্টে জমা হবে। ক্রেতা পণ্য ডেলিভারি পাওয়ার পর তার সন্তুষ্টির তথ্য জানালে ওই সংস্থা ই-কমার্স কোম্পানির একাউন্টে মূল্য স্থানান্তর করবে। ক্রেতা ওই পণ্য নিতে অনাগ্রহ দেখালে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটি ক্রেতাকে অর্থ ফেরত দেবে।
বিদেশে এ ধরনের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে বলে ই-ক্যাবের প্রস্তাবে বলা হয়।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ই-কমার্স সেলের প্রধান মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ক্যাশ অন ডেলিভারি প্রথা হঠাৎ করে বন্ধ করা যাবে না। আর ক্রেতার আস্থা না থাকলে তারা অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করে পণ্যের অর্ডারও দেবেন না।
তিনি বলেন, ই-ভ্যালির মতো কিছু প্রতিষ্ঠানে ক্যাশব্যাক ও ডিসকাউন্ট রেটে পণ্য কেনার লোভে অনেকে অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করে ঝামেলায় পড়েছেন। ক্যাশ অন ডেলিভারিতে পণ্য ডেলিভারির ক্ষেত্রে এই সমস্যা নেই। ই-কমার্স নিয়ে যত অভিযোগ আসে, তার বড় অংশই অগ্রিম মূল্য পরিশোধের পর পণ্যের ডেলিভারি না দেওয়া নিয়ে।
হাফিজুল রহমান বলেন, ই-কমার্সে আরও একটি সমস্যা, ভালো মানের পণ্যের ছবি দেখিয়ে নিম্নমানের পণ্য ডেলিভারি দেওয়া। সাইটের ছবিতে যে পণ্য দেখানো হয়, তার চেয়ে খারাপ পণ্য ডেলিভারি দেওয়ারও বহু অভিযোগ রয়েছে।
এ ধরনের প্রতারণা ঠেকাতে খসড়া নীতিমালায় ওয়েবসাইটে পণ্যের ছবির সঙ্গে যতটা সম্ভব সর্বোচ্চ স্পেসিফিকেশন যুক্ত করার বিধান রাখা হয়েছে। ছবিতে দেখানো পণ্যের সঙ্গে ডেলিভারি দেওয়া পণ্যের অমিল পাওয়া গেলে তা ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা হিসেবে গণ্য করা হবে এবং ফৌজদারি আইনে তা হবে দণ্ডনীয় অপরাধ।
ই-ক্যাবের চেয়ারম্যান সদরুদ্দীন ইমরানও স্বীকার করেন, অগ্রিম মূল্য নিয়ে পণ্য ডেলিভারি না করা এবং ভালো পণ্য দেখিয়ে খারাপ পণ্য ডেলিভারির অভিযোগ রয়েছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে। এজন্য ক্রেতা স্বার্থ সংরক্ষণ ও ই-কমার্স খাতের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য একটি ফ্রেমওয়ার্ক থাকা দরকার বলে তিনি মনে করেন।
খসড়া নীতিমালায় পণ্য ডেলিভারির ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার প্রস্তাবের সঙ্গে একমত ই-ক্যাবও। তবে সংস্থাটি মনে করে, সব কোম্পানি বা পণ্যের জন্য একই সময়সীমা বেঁধে দেওয়া যৌক্তিক হবে না।
ই-ক্যাবের চেয়ারম্যান সদরুদ্দীন ইমরান এ প্রসঙ্গে বলেন, ডেলিভারি টাইম পণ্যভিত্তিক নির্ধারিত হওয়া উচিত। সব পণ্যের জন্য একই সময় বেঁধে দিলে হবে না। বাল্ক আইটেম সাত দিনের মধ্যে সরবরাহ করা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, অনেক পণ্য এসেম্বল করে ডেলিভারি দিতে হয়। গ্রোসারি পণ্য এক বা দুই দিনের মধ্যে ডেলিভারি দেওয়া সম্ভব; কিন্তু একটি মোটরসাইকেল সাতদিনে সরবরাহ করা সম্ভব নাও হতে পারে।
তিনি বলেন, 'ছোট কোম্পানির কাস্টমার কম, বড়গুলোর বেশি। কাস্টমারের সংখ্যা অনুযায়ী ডেলিভারিম্যানের সংখ্যা নির্ধারণ করে দিতে আমরা মন্ত্রণালয়কে প্রস্তাব দিয়েছি। এটি নিশ্চিত করা গেলে ক্রেতাদের পণ্য পেতে ভোগান্তি অনেক কম হবে।'
পণ্যের স্টক ছাড়া অর্ডার নেওয়া না গেলে দারাজ, ই-ভ্যালীসহ ই-কমার্স প্লাটফর্ম হিসেবে ব্যবসারত কোম্পানিগুলো বিপদে পড়বে বলে মনে করছে ই-ক্যাব।