ইভ্যালির মতো দুনিয়া কাঁপানো যত পঞ্জি স্কিম!
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি নিয়ে তুমুল চর্চা চলছে সারা দেশে। বিভিন্ন সময়ে অবিশ্বাস্য ছাড়ে পণ্য বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়ে বিপুল ক্রেতা টেনেছে প্রতিষ্ঠানটি। পণ্যের দাম হিসেবে সংগ্রহ করেছে বিপুল পরিমাণ অর্থ, কিন্তু সিংহভাগ গ্রাহককেই পণ্য সরবরাহ করেনি। বারবার শুধু আশ্বাসই দিয়ে গেছে। অবশেষে অর্থ আত্মসাতের মামলায় বৃহস্পতিবার গ্রেপ্তার হয়েছেন ইভ্যালির সিইও মো. রাসেল ও তার স্ত্রী শামীমা।
মাত্র আড়াই বছরে সাধারণ উদ্যোক্তা থেকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে গেছেন রাসেল। তার এ উত্থানের পেছনে রয়েছে অসংখ্য বঞ্চিত গ্রাহকের দীর্ঘশ্বাস।
রাসেল যে ব্যবসা মডেল অনুসরণ করেছেন, তার নাম পঞ্জি স্কিম। পঞ্জি স্কিমের ইতিহাস ও উল্লেখযোগ্য কিছু পঞ্জি স্কিম নিয়ে এই লেখা।
পঞ্জি স্কিম কী
অর্থনীতিতে বহুলপরিচিত এক শব্দ 'পঞ্জি স্কিম'। অল্প সময়ে বিনা পরিশ্রমে শর্টকাটে টাকা কামানোর প্রায় সব প্রতারণামূলক কাজই পঞ্জি স্কিম নামে পরিচিত। পঞ্জি স্কিমের উদ্দেশ্য একটাই—প্রথমে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করে তারপর তাদের বিনিয়োগের সর্বস্ব আত্মসাৎ করা।
মোদ্দা কথা, পঞ্জি স্কিম এক ধরনের অর্থনৈতিক প্রতারণা। এখানে বিনিয়োগকারীদের সামান্য বিনিয়োগের বিপরীতে বিশাল অংকের লভ্যাংশ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নতুন বিনিয়োগকারীদের থেকে আদায় করা টাকা থেকেই পুরনো বিনিয়োগকারীদের টাকা দেওয়া হয়। অর্থের প্রবাহ যতক্ষণ চলে, এই পঞ্জি চক্রও ততক্ষণ চলে।
পঞ্জি স্কিমে কোনো প্রকৃত পণ্য, সেবা বা ব্যবসায়িক কাঠামো থাকে না। পঞ্জি স্কিমের কাঠামো সাধারণত পিরামিড আকৃতির হয়। এ পিরামিডের একেবারে চূড়ায় থাকে মূল পরিকল্পনাকারী, অর্থাৎ স্কিমের হোতা। এরপর থাকে প্রাথমিক সদস্যরা। এই প্রাথমিক সদস্যরা নতুন সদস্য সংগ্রহ করেন। এভাবে পুরনো সদস্যের মাধ্যমে নতুন সদস্য সংগ্রহ চলতে থাকে। এই পিরামিডের যত নিচের দিকে নামবেন, এর আকার তত বাড়বে—অর্থাৎ সদস্য বাড়বে।
পঞ্জি স্কিমের ইতিহাস
পঞ্জি স্কিম নামটি এসেছে চার্লস পঞ্জি নামের এক ব্যক্তির নাম থেকে। ১৯২০-এর দশকের গোড়ার দিকে ডাক ব্যবস্থা ঘিরে এক প্রতারণার জাল বিছান ইটালিয়ান অভিবাসী চার্লস পঞ্জি।
ওই সময় বিভিন্ন দেশের ডাক বিভাগ চিঠিপত্র বিনিময়ের জন্য আন্তর্জাতিক কুপন ব্যবহার করত। এসব কুপনের স্থানীয় মুদ্রামান একই থাকলেও দেশভেদে মুদ্রার বিনিময়মূল্যের ওঠানামার কারণে বাইরের দেশেও এই মান ওঠানামা করত। এসব কুপনের বিনিময়ে ডাকটিকিট নেওয়ার সুযোগ ছিল। পরে একসময় দেশে দেশে ডাকটিকিটের দামও ওঠানামা করতে শুরু করে।
এসব কুপন কম দামে কেনার জন্য ইউরোপে কিছু এজেন্ট নিয়োগ দেন চার্লস পঞ্জি। মুদ্রার মান নেমে গেলেই কুপন কিনে রাখত তারা। সস্তায় কেনা এসব কুপনের সঙ্গে দামি ডাকটিকিট বিনিময় শুরু করেন পঞ্জি। এর ফলে বড় অঙ্কের লাভ পকেটে আসে তার। এখানে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী হতেন মুনাফার জন্য। সে সময় ব্যাংকে টাকা রাখলে বার্ষিক মুনাফা মিলত ৫ শতাংশ। সে জায়গায় পঞ্জির কোম্পানিতে আন্তর্জাতিক কুপন কিনলে ৪০-৫০ শতাংশ মুনাফা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়।
এতদিন আইনসম্মত উপায়ে ব্যবসা করলেও এবার বড় মতলব আঁটেন চার্লস পঞ্জি। 'সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি' নামের একটা প্রতিষ্ঠান খুলে বসেন তিনি। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের মুনাফার লোভ দেখালেন তিনি মানুষকে।
৪৫ দিনে ৫০ শতাংশ এবং ৯০ দিনে ১০০ শতাংশ মুনাফা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি বিনিয়োগকারীদের। প্রথম দিকে বিনিয়োগকারীদের মুনাফা ঠিকমতোই দেওয়া হতো। সেজন্য পঞ্জির ওপর বিশ্বাস এসে পড়ে সবার। কাজেই লোকে তার স্কিমে বিনিয়োগ করার জন্য হামলে পড়ে।
কিন্তু এই কোম্পানিতে পঞ্জির নিজের বিনিয়োগ ছিল একেবারেই কম। তিনি আসলে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নেওয়া টাকাই নানাভাবে ফের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন, যাতে তারা বিশ্বাস করেন যে এই স্কিমের মাধ্যমে সত্যিই ভালো মুনাফা করা যায়। অর্থাৎ চার্লস পঞ্জি আজকের বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নেওয়া টাকা গতকালের বিনিয়োগকারীদের ঋণ পরিশোধে ব্যবহার করতেন।
বছরখানেক নির্বিঘ্নে প্রতারণা চালিয়ে গেলেন পঞ্জি। আট মাসে নিজের পকেটে দেড় কোটি ডলার ঢোকান তিনি। কিন্তু এরপরই তার প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু হয়। তার জের ধরে তদন্তে নামে মার্কিন আইনরক্ষাবাহিনী। বের হয়ে আসে স্কিমটি একটা ফাঁপা বেলুন—এতে আসল কোনো বিনিয়োগ নেই। ১৯২০ সালের ১২ আগস্ট গ্রেপ্তার হন চার্লস পঞ্জি।
এই স্কিমের নামকরণ চার্লস পঞ্জির নামে করা হলেও এরকম প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের জনক কিন্তু তিনি নন। তার আগেও বেশ কয়েকজন এরকম প্রতারণা করেছেন। ১৮৭৯ সালে সারাহ হাউই প্রথম এ ধরনের স্কিম চালু করেন। নানা সময়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন উপায়ে পঞ্জি স্কিম চালানো হলেও সব পঞ্জি স্কিমেরই কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য থাকে। যেমন: ১. অল্প বিনিয়োগে বিশাল মুনাফার আশ্বাস, ২. আয়ের প্রবৃদ্ধি ও ব্যবসা বাড়ানোর পরিকল্পনার স্পষ্ট না করা, ৩. অতিরিক্ত ধারাবাহিক রিটার্ন, ৪. অনিবন্ধিত বিনিয়োগ ৫. প্রাথমিক বিনিয়োগকারীদের টাকা বিশাল মুনাফাসহ ফেরত দিয়ে তাদেরকে আরও বিনিয়োগে প্রলুব্ধ করা।
আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পঞ্জি স্কিমগুলো
এবার জেনে নেওয়া যাক আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পঞ্জি স্কিমগুলো সম্পর্কে।
মানিট্রন স্কিম—১৯৯১
আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ: ৮৬ কোটি ডলার
এই স্কিমের হোতা জাঁ-পিয়েরে ভ্যান রোসেম। ভ্যান রোসেম তার বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান মানিট্রনের মাধ্যমে এই স্কিম চালান। মানিট্রন দাবি করত তারা একটা কম্পিউটার মডেল ব্যবহার করে বাজারের অবস্থার কথা বলে দিতে পারে। অর্থনীতির ব্যাকগ্রাউন্ড কাজে লাগিয়ে ভ্যান রোসেম 'স্টক মার্কেট গুরু' হিসেবে সুনাম কুড়িয়ে নেন। ফলে বহু গ্রাহক বাগিয়ে নেন তিনি। তার গ্রাহকদের মধ্যে বেলজিয়ান রাজপরিবারের কয়েকজন সদস্যও ছিলেন।
বিনিয়োগকারীদের যেসব চেক দিয়েছিল, সেগুলো একের পর এক বাউন্স করতে থাকলে মানিট্রন ভেঙে পড়ে। এরপরই গ্রেপ্তার হন ভ্যান রোসেম।
১৯৯১ সালে প্রতারণার দায়ে রোসেমকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কারাবাস এড়ানোর জন্য তিনিত রাজনীতিতে ঢোকেন। তার এ কৌশল কাজেও লেগে যায়। কয়েক বছর বেলজিয়ামের সংসদে দায়িত্বও পালন করেন তিনি।
উল্লেখ্য, ১৯৮০-র দশকের শেষ দিকে ফর্মুলা ১ রেসিং টিম অনিক্স গ্র্যান্ড প্রিক্স-এর অন্যতম মালিক ছিলেন ভ্যান রোসেম।
কারিতাস স্ক্যাম—১৯৯৪
আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ: ১০০-৫০০ কোটি ডলার
অ্যাকাউন্টেন্ট ইয়োয়ান স্টয়কা এই স্কিমের হোতা। এ স্কিম ছাড়া হয় দারিদ্র্যপীড়িত রোমানিয়ানদের টার্গেট করে। স্টয়কা আমানতকারীদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, ৩ মাসের মধ্যে তাদের ৮০০ শতাংশ বেশি টাকা ফেরত দেওয়া হবে। ৩০ লাখ রোমানিয়ান এই স্কিমের ফাঁদে পা দেন। লোকের মনে বিশ্বাস তৈরির জন্য কারিতাস নিয়মিত স্থানীয় পত্রিকায় বিজয়ীদের তালিকা প্রকাশ করত।
কিন্তু ১৯৯৩ সালের অক্টোবরে কারিতাস বিজয়ীদের টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এর কদিন পরই মানুষ জানতে পারে, প্রতিষ্ঠানটি ৪৫ কোটি ডলার দেনায় আছে।
১৯৯৪ সালে স্টয়কাকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রতারণার অপরাধে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাকে। কিন্তু ২ বার আপিলের পর তার শাস্তির মেয়াদ কমিয়ে মাত্র দেড় বছর করা হয়।
পিটারস গ্রুপ ওয়ার্ল্ডওয়াইড স্ক্যাম—২০০৩
আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ: ৩৬০ কোটি ডলার
এই স্ক্যামের হোতা টম পিটারস। ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত মিনেসোটাভিত্তিক পিটারস গ্রুপ ওয়ার্ল্ডওয়াইড (পিডব্লিউআই) নিজেদের ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বিক্রেতা হিসেবে পরিচয় দিত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পিডব্লিউআই ভুয়া ক্রয়াদেশ ও স্টেটমেন্ট দেখিয়ে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ মূলধন জোগাড় করেছিল। কিছু টাকা প্রথম দিকের অল্প সংখ্যক বিনিয়োগকারীদের দেওয়া হয়, বাকি টাকা যায় পিটারস ও তার সহযোগীদের পকেটে।
পিডব্লিউআইয়ের পঞ্জি স্কিম তহবিলের টাকা দিয়ে পোলারয়েডের মতো কোম্পানি কিনে নিতে ব্যবহার করা হতো। এসব ব্যবসায়িক লেনদেনের প্রচারণা চালানো হতো পিটারসের নিজস্ব ম্যাগাজিনের মাধ্যমে।
২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে পিডব্লিউআইয়ের এক কর্মী এই পঞ্জি স্কিমে সহায়তা করার কথা স্বীকার করেন। পিডব্লিউআইয়ের ক্রয়াদেশগুলো যে ভুয়া, সে কথা স্বীকার করে দেওয়া পিটারসের একটা বক্তব্যের রেকর্ডিংও প্রমাণ হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেন তিনি।
২০১০ সালের এপ্রিলে পিটারসকে মেইল ও তারবার্তা জালিয়াতি এবং অর্থপাচারের অপরাধে ৫০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
ম্যাডফ স্কিম—২০০৮
আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ: ৬ হাজার ৫০০ কোটি ডলার
পঞ্জি স্কিম নিয়ে আলোচনা হবে, আর বার্নি ম্যাডফের নাম আসবে না, তা অসম্ভব। ম্যাডফ ছিলেন ওয়াল স্ট্রিটের পোড় খাওয়া স্টকব্রোকার এবং এনএএসডিএকিউ-এর চেয়ারম্যান। ১৯৯১ সালে তার হাত ধরে সংঘটিত হয় পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পঞ্জি স্কিম।
এনএএসডিএকিউ নামের এই ভুয়া প্রতিষ্ঠান চালু হয় ১৯৬০ সালে। ম্যাডফ বিনিয়োগকারীদের প্রতিশ্রুতি দিতেন, এনএএসডিএকিউতে বিনিয়োগ করলে, বাজারের অবস্থা যেমনই থাকুক না কেন, দুই অঙ্কের রিটার্ন দেওয়া হবে।
বহুদিন ধরে ম্যাডফ তার পঞ্জি স্কিম চালিয়ে গেছেন কারও মনে কোনো সন্দেহের উদ্রেক না করে। তিনি অল্প সময়ে অবিশ্বাস্য রিটার্নের প্রতিশ্রুতি দিতেন না বলে তাকে কেউ সন্দেহ করেনি। তিনি শুধু বছরে এফডিআরের চেয়ে সামান্য বেশি রিটার্ন দেখাচ্ছিলেন।
কিন্তু ম্যাডফের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল বাজারের ভালো-মন্দ সব অবস্থাতেই মুনাফা দিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি। ২০০৮ সালে ধসের সময় এসে জানা গেল, আদতে ম্যাডফ গ্রাহকের একটা টাকাও কোনো শেয়ারে বিনিয়োগ করেননি। সব টাকা তিনি ব্যাংকে রেখে দিতেন। চার্লস পঞ্জির মতো তিনিও শুধু নতুন গ্রাহকদের টাকায় পুরনো গ্রাহকদের রিটার্ন দিতেন।
মজার ব্যাপার হলো, ম্যাডফ যার-তার কাছ থেকে বিনিয়োগ নিতেন না। বিনিয়োগ নেওয়ার জন্য ম্যাডফের পরিচিত কারও সুপারিশ লাগত। ঝামেলা এড়াতেই তিনি গ্রাহকসংখ্যা সীমিত রাখতেন। কম ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বড় তহবিল নিয়ে এগোনোই ছিল তার পরিকল্পনা। ম্যাডফের গ্রাহক বেশি ছিল ধনী ইহুদি সমাজে।
ধরা পড়ার সময় ম্যাডফের স্কিমে মানুষের মূলধন জমা ছিল প্রায় ১৭-১৮ বিলিয়ন ডলার।
ম্যাডফকে ১১টি ফেডারেল অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। বিচারে তাকে ১৫০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০০৮ সালের শেষদিকে এই কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার সময় তার গ্রাহকসংখ্যা ছিল প্রায় ৪ হাজার ৮০০ জন।
- টাইম ডটকম ও ভিজুয়াল ক্যাপিটালিস্ট ডটকম অবলম্বনে