আড়াই বছরেও জামালপুর নকশী পল্লী প্রকল্পের অগ্রগতি নেই

অর্থনীতি

09 September, 2021, 08:35 pm
Last modified: 09 September, 2021, 09:28 pm
কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়া অনেকটাই বিলাসী ধাঁচে প্রণয়ন করা প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপেই হোঁচট খাচ্ছে। ৭২২ কোটি টাকার প্রকল্পে এখন পর্যন্ত নিয়োগ হয়নি কোনো পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক (পিডি)।

অফিস ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা বাবদ নিয়মিত অর্থ ব্যয় হলেও গত আড়াই বছরে জামালপুরের শেখ হাসিনা নকশি পল্লী প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি নেই।

ইতোমধ্যে রাজধানীতে প্রকল্প অফিসের কয়েক মাসের ভাড়াও বকেয়া পড়েছে। 

কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়া অনেকটাই বিলাসী ধাঁচে প্রণয়ন করা প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপেই হোঁচট খাচ্ছে। ৭২২ কোটি টাকার প্রকল্পে এখন পর্যন্ত নিয়োগ হয়নি কোনো পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক (পিডি)।

জামালপুর ও শেরপুর জেলার হস্ত, কারু এবং তাঁত শিল্পের শ্রমিকদের আবাস ও কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে এই প্রকল্পের উদ্যোগ গৃহীত হয়।

আগামী বছরের জুনে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হলে নকশী শিল্পে উদ্যোক্তার সংখ্যা ৩০০ থেকে বেড়ে ৯০০ জনে উন্নীত হওয়ার প্রস্তাবনা রাখা হয়। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তিন লাখ থেকে কর্মসংস্থান ছয় লাখে উন্নীত হবে বলেও আশা করা হয়েছিল।একইসঙ্গে ১০ লাখ পণ্য থেকে নকশী পণ্যের উৎপাদন ৩০ লাখ হবে বলে ধরা হয়। অন্যদিকে, দুই কোটি টাকা থেকে বেড়ে রপ্তানি আয় বছরে ১০ কোটি টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব রাখে কমিটি।

আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি, শ্রমিকদের আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ও দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্যের কথাও বলা হয়েছিল প্রকল্পের দলিলে।

মেয়াদকালের শেষ প্রান্তে এসে এখন পুরো প্রকল্পটিই নতুনভাবে সাজাতে চায় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। 

মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রকল্পটির পরিধি কমানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জমির পরিমাণ ঠিক করতে সম্ভাব্যতা জরিপ এবং আয়, ব্যয় ও লাভের সম্ভাবনা নির্ণয় করতে দেওয়া হয়েছে অর্থনৈতিক ও হিসাব সংক্রান্ত জরিপ পরিচালনার নির্দেশ।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত শেখ হাসিনা নকশিপল্লীর প্রথম পর্যায়ের প্রকল্পের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। 

বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যান মো: শাহ আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় তাঁত বোর্ডের সদস্য (পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন) গাজী মো: রেজাউল করিম জানান, "প্রকল্পের আওতায় জামালপুর সদর ও শেরপুরের মেলান্দহ উপজেলায় ৩০০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রশাসনিক প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।"  

পরবর্তীতে প্রকল্পটি বাস্তবসম্মত সংশোধিত আকারে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত দেয় মন্ত্রণালয়।

শেষ পর্যায়ে এসে সম্ভাব্যতা জরিপ

ন্যূনতম ৫০ কোটি টাকা ব্যয় ধরে কোনো প্রকল্প প্রণয়নের আগেই সম্ভাব্যতা জরিপ পরিচালনার বাধ্যবাধকতা থাকলেও ৭২২ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পের কোনো সম্ভাব্যতা জরিপ হয়নি। এ পল্লী স্থাপন করতে আদৌ ৩০০ একর জমির প্রয়োজন হবে কি না, তা জানতে প্রকল্পের অর্থায়নে সম্ভাব্যতা পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। 

তাছাড়া প্রকল্পের লাভ-ক্ষতির হিসাব তুলে ধরতে অর্থনৈতিক ও হিসাব সংক্রান্ত জরিপ পরিচালনারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এ নির্দেশের পরিপ্রক্ষিতে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) ও ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভলপমেন্টকে (এনএপিডি) প্রস্তাব দেওয়া হলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে সংস্থা এনএপিডি একটি সম্ভাব্যতা জরিপ পরিচালনা করে।

সম্ভাব্যতা জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে প্রকল্পটির প্রস্তাবনা সংশোধন করা হচ্ছে বলে তাঁত বোর্ড সূত্র জানিয়েছে।

প্রকল্পে অর্থ সংকট

প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির সভার কার্যপত্র পর্যালোচনায় জানা গেছে, প্রকল্পটির আওতায় চলতি অর্থবছরের এডিপিতে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। ইতোমধ্যেই বিটিএমসি ভবনে প্রকল্পের জন্য অফিস বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে, এবং ভাড়া বকেয়া পড়েছে। প্রকল্পের পিআইসি ও পিএসসি সভার সম্মানী বাবদ বেশ কিছু অর্থ ব্যয় হয়েছে। প্রকল্পের ডিপিডির তহবিল থেকে এ অর্থ বহন করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।

অতিরিক্ত প্রাক্কলন 

প্রকল্পটি প্রণয়নের সময় প্রয়োজনের চাইতে বেশি জমি ব্যবহারের প্রাক্কলন করা হয়েছিল বলে পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় উঠে এসেছিল।

নকশী শিল্পের প্রায় ৩০০ শ্রমিক থাকলেও প্রকল্পে এক হাজার ১৮৪ পরিবার পুনর্বাসনের সংস্থান রাখার বিষয়ে প্রশ্ন উঠলে ভবিষ্যতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সম্ভাবনা বিবেচনায় অতিরিক্ত শ্রমিকের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে সভায় জানান তাঁত বোর্ডের প্রতিনিধিরা।

প্রায় এক হাজার ২০০ শ্রমিকের পুনর্বাসনেও ৩০০ একর জমির প্রয়োজন নেই বলে সভায় দাবি করে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা তখন জানান, একনেকে অনুমোদন পাওয়া শেখ হাসিনা তাঁত পল্লী প্রকল্পে ১২০ একর জমিতে তাঁতি পরিবার পুনর্বাসনের উদ্যোগ রয়েছে। তাঁত পল্লী প্রকল্পে পাঁচতলা ভবনের সংস্থান থাকায় শ্রমিক থাকতে পারবেন বেশি।

ওই সময় পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশে জমির স্বল্পতা রয়েছে। তাছাড়া প্রস্তাবিত প্রকল্পের জমি কৃষি কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নতুন প্রকল্পে জমির পরিমাণ আরও আলোচনা করে যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়।

বিলাসী ব্যবস্থাপনা

প্রকল্পটির আওতায় থিমপার্ক, লেকপার্ক, খেলার মাঠ, ডকইয়ার্ড, ভাসমান রেস্টুরেন্ট, এ্যাম্ফিথিয়েটার, সিটিং এরিয়া ও রেস্ট হাউজ নির্মাণের প্রস্তাবের সংস্থান রয়েছে।

এ বিষয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রকল্পটি নেওয়া হচ্ছে দরিদ্র নকশী শিল্পীদের পুনর্বাসনে। এমন প্রকল্পের আওতায় এসব স্থাপনা নির্মাণ যৌক্তিক বলে মনে হয় না। এ অবস্থায় পুনর্গঠিত প্রস্তাবে থিমপার্ক নির্মাণের যৌক্তিকতা আলাদাভাবে তুলে ধরার সুপারিশ করা হয়েছে। অন্যান্য বিলাসী স্থাপনায় ব্যয়ের পরিমাণ কমিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়েছে সভায়।

প্রকল্প অনুমোদনে তাড়াহুড়ো 

প্রকল্পটি অনুমোদনে সমীক্ষা না করার পাশাপাশি আরও কিছু ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করা হয়েছিল। সাধারণত এডিপির বইয়ে অনুমোদনের জন্য অপেক্ষমান তালিকা থেকে প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে প্রকল্পটি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের অননুমোদিত প্রকল্পের তালিকায় ছিল না।  

পরিকল্পনা মন্ত্রীর বিশেষ অনুমোদন নিয়ে প্রকল্পটির অনুমোদন প্রক্রিয়া শুরু করে কমিশন। মোট ১০ শর্ত পরিপালনের শর্তসাপেক্ষে প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়।

যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা

তাঁত বোর্ডের সদস্য (পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন) গাজী মোঃ রেজাউল করিম বলেন, "জমি সংক্রান্ত জটিলতায় বাস্তবায়নের মাঝপথে এসে প্রকল্পটি পুনর্গঠন করতে হচ্ছে। এ কারণে বাস্তবায়নও পিছিয়ে যাচ্ছে।"

তাঁত বোর্ডের প্রধান মোঃ আইয়ুব আলী বলেন, "প্রকল্পটি অনুমোদনের পর একজন পিডি নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, যিনি দায়িত্ব পালন করেন মাত্র সাত মাস। বর্তমানে একজন ডিপিডি এ প্রকল্পের দেখভাল করছেন।

"যৌক্তিক পর্যায়ে পুনর্গঠন" করে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সুপারিশের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ৩০০ একর জমি বেশি হয়ে যাচ্ছে দাবি করে সম্ভাব্যতা সুপারিশ করা হয়েছিল। এখন সরকারি সংস্থার সমীক্ষা বলছে জমি লাগবে ৩৫২ একর।

"এখন বলা হচ্ছে প্রকল্প যৌক্তিক করতে হবে। তাহলে কি অযৌক্তিক বরাদ্দে প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়েছিল?" প্রশ্ন রাখেন তিনি। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.