কে-শেপড অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার

অর্থনীতি

টিবিএস রিপোর্ট
16 February, 2021, 05:25 pm
Last modified: 16 February, 2021, 05:40 pm
অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে আরও টেকসই করতে দ্বিতীয় দফায় প্রণোদনা প্যাকেজ প্রণয়নের সুপারিশ করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি বর্তমানে কে-শেপড। কিছু খাতে পুনরায় অর্থনৈতিক উত্তরণ হচ্ছে, সেইসঙ্গে পিছিয়ে পড়ছে অন্য অনেক খাত। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে আরও টেকসই করতে দ্বিতীয় দফায় প্রণোদনা প্যাকেজ প্রণয়নের সুপারিশ করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।

কোভিড-১৯-এর প্রভাব বিবেচনায় রেখে বিভিন্ন সূচকের বিশ্লেষণ করে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, রেমিট্যান্স ও ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের মতো কিছু খাতের পুনরুদ্ধারের গতি বাড়ায় সার্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এখন পর্যন্ত 'তুলনামূলক ভালো'।

দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়ায় ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে এ সময় সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রয়োজন ছিল। এ সংকটের সময় বাজেট উদ্ধৃত্ত সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা প্রকাশ করে। গতকাল সোমবার প্রকাশিত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পর্যালোচনায় এসব তুলে ধরা হয়।

বিভিন্ন খাতের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি ভিন্ন হওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বর্তমান গতি কে-শেপড। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতির টেকসই পুনরুদ্ধারের জন্য দ্বিতীয় দফায় প্রণোদনা প্যাকেজ দেওয়া প্রয়োজন।

কোনো দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে মিশ্র প্রবণতা দেখা গেলে, কোনো খাত এগিয়ে গেলে, কিছু খাত পিছিয়ে পড়লে, তখন সে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের গতি কে-শেপড হয়, জানান সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।

প্রথম প্রণোদনা প্যাকেজ বিতরণের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পরবর্তী পর্যায়ে কর্মসংস্থানের বিবেচনায় ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে সহায়ক ব্যবস্থা প্রণয়ণ করতে হবে। ছোট খাতগুলোর তুলনায় বড় খাতগুলো সহজেই প্রণোদনা প্যাকেজ পেয়েছে, বেশি সুযোগ সুবিধা পেয়েছে। এ কারণেই একই প্যাকেজের মেয়াদ বৃদ্ধি সহায়ক হবে না বলে সতর্ক করেছে সিপিডি।

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নতুন প্রণোদনা প্যাকেজ শুধু ব্যাংকভিত্তিক হওয়া উচিত নয়। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে পিছিয়ে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো যেন এ প্যাকেজের আওতায় পড়ে, তা নিশ্চিত করতে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

বড় ও মাঝারি খাতের উৎপাদন, রেমিট্যান্স প্রবাহ, ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভের মতো খাতের উত্তরণ ইতিবাচক বলে জানায় সিপিডি।

চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় ছিল, উদ্ধৃত্ত বাজেটেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। বিনিয়োগ ভারসাম্য আগের তুলনায় ইতিবাচক ও ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য স্থিতিশীল ছিল।

তবে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথমার্ধে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের বিনিয়োগ কম ছিল। ফলে কর্মসংস্থানের অভাব সৃষ্টি হতে পারে, কমে যেতে পারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি।

অর্থবছরের বাজেটের উদ্ধৃত্ত সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত লক্ষমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতাই নির্দেশ করে, ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নেও ধীরগতি দেখা দিয়েছে।

চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে মহামারি পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় সরকারি ব্যয় কমে ১২ দশমিক ৯ শতাংশে দাঁড়ায়। অর্থাৎ মহামারির ক্ষতি পুষিয়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় এক্সপ্যানশনারি ফিসকাল পলিসি নেওয়া হয়নি।

২০১৯-২০ অর্থবছরে এডিপি ব্যয়ে উন্নয়ন ব্যয় কমেছে ৩৫ দশমিক ১ শতাংশ।

সিপিডির সিনিয়র ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান জানান, সংকটের সময় যে পথে আগানো দরকার ছিল, তা না করে বিতর্কিত নীতিমালায় সরকারি ব্যয় হয়েছে। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন ও গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমও সভায় অংশগ্রহণ করেন।

সিপিডির পর্যালোচনায় বলা হয়, 'অবস্থাদৃষ্ট দেখে মনে হচ্ছে প্রণোদনা প্যাকেজ নির্ধারণ ও বিতরণ প্রক্রিয়ার কারণেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি কে-শেপড।'

বিনিময় ভারসাম্য, বাজেট উদ্ধৃত্ত, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, স্থিতিশীল লেনদেন মূল্য, রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি এসব ক্ষেত্রেই ইতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। একইসঙ্গে এসব খাত দুশ্চিন্তারও কারণ। কারণ আমদানি কমে যাওয়ার কারণেই বিনিময় ভারসাম্যের হার বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দেশীয় উৎপাদন ও রপ্তানির জন্য আশঙ্কাজনক- বলেন অধ্যাপক মোস্তাফিজুর।

রপ্তানি কমে যাওয়া, কম সরকারি খরচ, বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি এখনো লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় পিছিয়ে থাকা- এসবই এখন পর্যন্ত নেতিবাচক বলে জানান তিনি।

'সার্বিক পুনরুদ্ধারের গতি তুলনামূলক ভালো, দ্বিতীয় দফায় প্রণোদনা প্যাকেজ প্রয়োজন এখন,' বলেন তিনি।

তবে সামনের দিনগুলোতে কিছু ক্ষেত্রে ঝুঁকি আছে বলে সতর্ক করেন অধ্যাপক মোস্তাফিজুর। চাহিদা অনুযায়ী শিগগিরই বড়-সড় পরিবর্তনের সম্ভাবনা না থাকায় কর্মসংস্থানের সৃষ্টি ও বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

'পরবর্তী ছয় মাস বা এক বছরে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি অর্জনের সম্ভাবনা খুব কম। এ কারণে গ্রামীণ এলাকায় আয়ের উৎস ও অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারি ব্যয় প্রয়োজন,' বলেন তিনি।

রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৮ শতাংশ, তবে এ হার বেশিদিন বজায় থাকার সম্ভাবনা কম।

সংকটকালীন সময়ে উদ্ধৃত্ত বাজেট

জিডিপিতে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ঘাটতি নিয়ে শেষ হয় বিগত অর্থবছর। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) উদ্ধৃত্ত দেখা যায়। বিনিময় ভারসাম্যের ফলে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সার্বিক উদ্ধৃত্ত দাঁড়ায় ৬ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বেড়েছে, স্থিতিশীল ছিল বিনিময় মূল্য।

আমদানি খরচ কমে যাওয়ায় কমেছে বাণিজ্য ঘাটতি। অন্যদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধির কারণে ডিসেম্বর পর্যন্ত উদ্ধৃত্ত ছিল ৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার।

চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে স্বাস্থ্যসেবা খাতের জন্য প্রাথমিকভাবে নির্ধারিত বাজেটের মাত্র ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ খরচ হয়েছে, যা মহামারির আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায়ও কম।

আটটি মেগা প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ বাজেটের মাত্র ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ খরচ করা হয়েছে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে। এটি মোট এডিপির গড় বাস্তবায়ন হারের চেয়ে অনেক কম, এমনটাই উঠে এসেছে সিপিডির বিশ্লেষণে।

অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কম অগ্রাধিকারের প্রকল্পগুলো স্থগিত রেখে অধিক অগ্রাধিকারের প্রকল্পে অর্থায়নের মাধ্যমে উন্নয়ন ব্যয় ৭৫ শতাংশে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ব্যাংকগুলোতে উদ্ধৃত্ত তারল্য আছে, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আছে, কম সুদের হারে ঋণ নেওয়ার সুযোগ আছে। এ কারণে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত বাজেট ঘাটতি তেমন উদ্বেগজনক নয়।

৫ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হলেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্বাভাবিক ছিল, তা-ই প্রতীয়মান হয়। কৃষিপণ্য উৎপাদন, রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি ও তৈরি পোশাক খাতের উন্নতির মাধ্যমে রপ্তানি আয় পুনরুদ্ধারের কারণে এটি সম্ভব হয়েছে।

চলতি অর্থবছরের ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হলেও তা সকল খাতের পুনরুদ্ধারে সমানভাবে ভূমিকা রাখবে না বলেও উল্লেখ করা হয়।

রপ্তানির ক্ষেত্রে অস্থিরতা সত্ত্বেও শিল্পখাতের উৎপাদন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিগত অর্থবছরের রপ্তানিতে ধস নেমেছে; চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত ছিল। তবে চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে বড় ও মাঝারি শিল্পখাতের উৎপাদন বেড়েছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ। চামড়া শিল্পের ৫৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিগত অর্থবছরে এ হার ছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ।

অতিরিক্ত তারল্যের প্রভাব

দেশীয় চাহিদা স্থিতিশীল থাকায় অনেক ব্যবসায়িক খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কৃষিভিত্তিক খাত ও ব্যবসায় পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে মহামারি পূর্ববর্তী অবস্থায় পৌঁছেছে। তবে ই-কমার্স খাতের জন্য আশীর্বাদ হয়েই এসেছিল মহামারি।

ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের চেয়ে সেবা খাতের পুনরুদ্ধারের গতি তুলনামূলক বেশি ছিল। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ওষুধ ও মেডিক্যাল সরঞ্জামাদির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় ফার্মাসিউটিক্যাল খাতের সার্বিক অবস্থাও সন্তোষজনক ছিল।

বড় এন্টারপ্রাইজগুলোর বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় ম্যানুফাকচারিং ও সেবা সংশ্লিষ্ট খাতের সামনে কিছু চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে।

ব্যাংকিং খাতের অতিরিক্ত তারল্য এক বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণ বেড়ে ২ লাখ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। ফলে ঋণ ও ডিপোজিটের হারও কমে গেছে।

সিপিডির প্রতিবেদনে বলা হয়, মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনা রেখে ডিপোজিটের আসল হার  ছিল নেতিবাচক। অর্থাৎ মহামারির সময় জনসাধারণের সংরক্ষিত অর্থ কমেছে, অথচ এ সময়েই জমানো অর্থ খরচের বেশি প্রয়োজন ছিল মানুষের। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.