অর্থনীতি সচল হয়েছে, কিন্তু বেড়েছে দারিদ্র্য

অর্থনীতি

টিবিএস রিপোর্ট
24 January, 2021, 04:30 pm
Last modified: 24 January, 2021, 04:30 pm
সানেমের গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে মোট জনগোষ্ঠীর ৪২ শতাংশ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করছে। ২০১৮ সালের তুলনায় দারিদ্র্যের হার বেড়েছে দ্বিগুণ।

দারিদ্র্য মোচনে বাংলাদেশের ধারাবাহিক অর্জন থাকলেও কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ২০২০ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। হত দারিদ্র্যের হার বেড়েছে তিনগুণ। সেই সঙ্গে বেড়েছে বৈষম্যও ।  

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। মানুষের আয়, ব্যয়, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার ওপর মহামারীর প্রভাব বিশ্লেষণ করতে এ গবেষণাটি করা হয়। 

২০২০ সালের ২ নভেম্বর- ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত ৫ হাজার ৬০০টি বাড়ির মানুষের ওপর টেলিফোন সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে এ গবেষণা পরিচালনা করা হয়। নমুনা জরিপের মাধ্যমে সানেমের এ গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে মোট জনগোষ্ঠীর ৪২ শতাংশ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করছে। 

২০১৮ সালে সানেম এবং পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) জরিপ অনুযায়ী এ হার ছিল ২১.৬ শতাংশ। শনিবার এক ওয়েবিনারে এ গবেষণা প্রতিবেনটি উপস্থাপন করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যার ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালের দেশের দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪.৩ শতাংশ। 

ওয়েবিনারে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, শহর এবং গ্রামে উভয় ক্ষেত্রে দারিদ্র্যের হার বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৮ সালে গ্রামীণ এলাকায় দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪.৫ শতাংশ, যা ২০২০ সালে বেড়ে ৪৫.৩ শতাংশ হয়েছে। 

২০১৮ সালে শহর এলাকায় দারিদ্র্যের হার ছিল ১৬.৩ শতাংশ, যা বেড়ে হয়েছে ৩৫.৪ শতাংশ। 

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শহর এবং গ্রামীণ এলাকায় অতি দারিদ্র্যের হার তিন গুণ বেড়েছে। গ্রামীণ এলাকায় এ হার এখন ৩৩.২ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ১৯ শতাংশ। জাতীয় পর্যায়ে অতি দারিদ্র্যের হার ৯.৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৮.৫ শতাংশ হয়েছে।    

সানেমের জরিপ অনুযায়ী, দেশে এখন সবচেয়ে দারিদ্র্য প্রবণ এলাকা রংপুর, রাজশাহী এবং ময়মনসিংহ বিভাগ। অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী বাস করে ময়মনসিংহে। এর আগে ২০১৬ সালের বিবিএসের তথ্যানুযায়ী, সর্বোচ্চ হতদারিদ্র্যের সংখ্যা ছিল রংপুর বিভাগে। হতদরিদ্রের সংখ্যা বিবেচনায় বর্তমানে রংপুর বিভাগ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।    

২০১৮ সালের তুলনায় ২০২০ সালে অর্ধেক পরিবারের খাদ্যের ওপর ব্যয় কমেছে । এ ক্ষেত্রে  খাদ্য পণ্যে ব্যয়ে এবং খাদ্য বহির্ভূত ব্যয় দুটোই কমছে। তবে খাদ্য বর্হিভূত ব্যয় বেশি কমেছে। মানুষ খাদ্য বহির্ভূত ব্যয় কমিয়ে খাদ্য কিনতে বেশি অর্থ ব্যয় করছে।    

গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালে যারা হতদরিদ্র ছিল, তাদের ৪৯.২ শতাংশ ২০২০ সালেও হতদারিদ্র্যের সীমায় রয়ে গেছে। আবার ২১০৮ সালে দারিদ্র্য সীমায় থাকা জনগোষ্ঠীর ৪১ শতাংশ হতদারিদ্র্যের সীমায় নেমে গেছে।   

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দারিদ্র্যের সঙ্গে বৈষম্য ও বেড়েছে। ২০১৮ সালে দেশে গিনি কোএফিসিয়েন্ট মান ছিল ০.৩১। যা ২০২০ সালে বেড়ে হয়েছে ০.৩৩, অর্থাৎ বৈষম্য বেড়েছে।     

জরিপ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কোভিডের মধ্যে দেশে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ ধনীর আয় ও ভোগ ব্যয় বেড়েছে । এ সময়ে দেশে সবচেয়ে কম আয়ের ২০ শতাংশ  দরিদ্রের আয় ও ব্যয় কমেছে।    

২০১৮ সালে দেশে ৫ শতাংশ ধনীর ভোগ ব্যয় ছিল ১২.৯ শতাংশ। যা ২০২০ সালে বেড়ে হয় ১৩.৯২ শতাংশ। অন্য দিকে ২০১৮ সালে সবচেয়ে দরিদ্র ২০ শতাংশ মানুষের ব্যয়  ছিল ৯.৬ শতাংশ, যা ২০২০ সালে কমে  হয় ৬.৪৭ শতাংশ।  

গবেষণায় দেখা গেছে কোভিডের মধ্যে মাত্র ২১ শতাংশ পরিবারের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে বা টেলিভিশোনের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত ছিল। দরিদ্র পরিবারগুলোর সন্তানদের মধ্যে ১৫ শতাংশ এবং ধনীদের ২৬ শতাংশ অনলাইনের শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে। 

সেলিম রায়হান বলেন, কোভিডের কারণে ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২০ সালে সেবা খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমেছে। ফলে কাজ হারানো মানুষরা কৃষি খাতে যোগ দিয়েছেন। তবে শিল্প খাতে কর্মসংস্থানের পরিমাণ অপরিবর্তিত আছে।  

দেখা গেছে ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২০ সালে স্ব-নির্ভর কর্মসংস্থানের হার কমেছে। বেড়েছে বেতনভুক্ত নিয়োগপ্রাপ্তের সংখ্যা। এছাড়া দিন মজুদের সংখ্যাও সামান্য কিছু কমেছে।         

২০২০ সালের মার্চ থেকে সারা দেশে কাজ হারিয়েছে ৯.৭ শতাংশ কর্মী। এ সময়ে ৪৮.৭২ শতাংশ পরিবারের ঋণ করে খরচ যোগাতে হয়েছে। মাত্র ৫.৩২ শতাংশ মানুষ সরকারের কাছ থেকে সহায়তা পেয়েছে বলে জরিপে উঠে এসেছে।   

সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সুবিধা পেয়েছে ২৫.৯১ শতাংশ মানুষ। কোভিডের মধ্যে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়লেও পরিবারগুলোর তথ্যানুযায়ী, তারা আগের তুলনায় কম রেমিট্যান্স পেয়েছে।    

সেলিম রায়হান বলেন, আগে ব্যাংক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক (হুন্ডি) মাধ্যমে প্রবাসীদের পরিবারগুলো এ রেমিট্যান্স পেতো। কোভিডের মধ্যে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বেড়েছে। তবে মোট রেমিট্যান্স কমে গেছে।  

জরিপে পাঁচটি সুপারিশও উঠে এসেছে। এর মধ্যে কোভিড পরিস্থিতিতে ব্যবস্থাপনা জোরদার করা, ক্যাশ প্রণোদনা কর্মসূচিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখা, দুর্নীতি কমানো এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।  

বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, কেবল ভোগের ক্ষেত্রে নয়, শিক্ষার ক্ষেত্রেও দারিদ্র্য বেড়েছে। দেশের তিন চতুর্থাংশ শিক্ষার্থী কোভিডের মধ্যে অনলাইন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। শিক্ষার দারিদ্র্য ভোগ দারিদ্র্য থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।    

বৈষম্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ২০২০ এবং ২০১৮ সালে ভোগ ব্যয়ের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। দেখা যাচ্ছে, অনেকেরই ব্যয় ৫ হাজার টাকার মধ্যে আটকে আছে আয়। এটি ভয়ঙ্কর এক ফাঁদ।  

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, "আমাদের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কিন্তু কর্মসংস্থান হচ্ছে না। কোভিডের কারণে আয় কমেছে, এখনও কমছে। আবার দেখা যাচ্ছে, একটা বড় অংশ ঋণ করে ভোগ ব্যয় মেটাচ্ছে,"

"আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যারা ঋণ নিচ্ছে, কোথা থেকে নিচ্ছে। কোনো প্রভাবশলীর কাছ থেকে নিচ্ছে নাকি ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠান থেকে নিচ্ছে। প্রভাবশালীদের কাছ থেকে বেশি সুদে ঋণ নিয়ে তারা আবার দারিদ্র্যের চক্রে আটকে যেতে পারে।"

তিনি আরও বলেন, সরকারি সহায়তা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্তুরা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারছে না। কিন্ত এখন সরকারি ব্যয় বাড়ানো দরকার ছিল। সম্পদ, আয় ও ভোগের বৈষম্য বেড়েই চলছে। আবার ধনীদের একটা অংশ আরও ধনী হচ্ছে, দুর্নীতি বাড়ছে। সংস্কার এবং সরকারি উদ্যোগ ছাড়া এসব বন্ধ করা যাবে না। রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ প্রণোদনার সুযোগ নিয়ে অনেকে আবার পাচার করা টাকাও দেশে পাঠাচ্ছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। 

অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, কোভিডের ক্ষতি কত দ্রুত পুষিয়ে নেওয়া যাবে সেটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য সরকার সরকারি উদ্যোগ থাকতে হবে।  

তিনি বলেন, "দরিদ্র্য পরিবারের অনেকেই ঋণ করে পরিবার চালাচ্ছে। এ ঋণ তারা পরিশোধ করতে পারবে কিনা তা দেখতে হবে। জরিপে বেশিরভাগ মানুষ বলেছে সরকারি সহায়তা পর্যাপ্ত নয়। ফলে এ ক্ষেত্রে সরকারো আরও বড় ধরণের উদ্যোগ নিতে হবে।"

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.