‘লং কোভিড’ কিছু মানুষ কেন পুরোপুরি সুস্থ হচ্ছে না 

অফবিট

টিবিএস ডেস্ক
06 October, 2020, 11:20 pm
Last modified: 07 October, 2020, 10:39 am
অতি-সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা উপাত্ত সূত্রে জানা গেছে, কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত প্রতি ৫০ জনের মধ্যে একজনের দেহে আক্রান্ত হওয়ার ৯০ দিন পরও ‘লং কোভিড’- এর উপসর্গ দেখা যায়। 

কোভিড-১৯ অনেকের জন্যেই ছিল সংক্ষিপ্ত এবং মৃদু উপসর্গের ভোগার একটি রোগ। সেরে ওঠারা অবশ্যই নিজেদের ভাগ্যবান বলে মনে করছেন। যদিও, কিছু মানুষের কপালে সেই দ্রুত আরোগ্য জোটেনি। 

তাদের অনেকেই কোভিড-১৯ এর কারণে দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি, তীব্র ব্যথা এবং মাঝে মাঝে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে না পারার মতো কঠিন যন্ত্রণায় ভুগছেন।

রোগটির এ অবস্থাকে বলা হচ্ছে 'লং কোভিড' বা দীর্ঘমেয়াদি কোভিড। যার প্রভাবে আক্রান্তদের জীবন-যাপন হয়ে পড়েছে দূর্বিষহ। অল্প একটু হাঁটা বা পরিশ্রম করেই কারো কারো ক্লান্ত-অবসন্ন হয়ে পড়ার কথা, এখন প্রায়শ'ই শোনা যায়। 

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া অতিমারির মধ্যে জীবন বাঁচানোটাই মূল প্রাধান্য পায়। কিন্তু, এখন কোভিড সংক্রমণের কারণে কিছু ব্যক্তি যে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক স্বাস্থ্যের শিকার হয়েছেন, সেটি ঘিরেও উদ্বেগ বাড়ছে বিশেষজ্ঞ মহলে।  

অনেক মৌলিক প্রশ্নের উত্তর এখনও তারা জানেন না। কিছু ব্যক্তি কেন 'লং কোভিড'- এ ভুগছেন এবং তারা সকলেই এক সময় সেরে উঠবেন কিনা- এসব উত্তর ঢাকা পড়েছে অনিশ্চয়তার চাদরে। 

লং কোভিড আসলে কী?

করোনাভাইরাসের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতার শিকার সকল রোগীর দেহে এক ধরনের উপসর্গ দেখা যায় না। ফলে উপসর্গ তালিকার ভিত্তিতে তাদের আলাদা সংজ্ঞা নির্ধারণের সুযোগ নেই। যেমন; দুই জন 'লং কোভিড' আক্রান্ত ব্যক্তির সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম শারীরিক সমস্যায় ভোগার অভিজ্ঞতা হতে পারে। 

একটি উপসর্গ অবশ্য কমবেশি সকলের মধ্যেই দেখা যায়। তা হচ্ছে; শরীর প্রচণ্ড ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে পড়া। 

এছাড়া, অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে আছে; শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে বা ফেলতে না পারা, দীর্ঘস্থায়ী কাশি, হাড়ের সংযোগ স্থলে ব্যথা, মাংশপেশি টান ধরা, চোখে দেখা বা কানে শোনার ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, গন্ধ বা স্বাদগ্রহণের অনুভূতি হারিয়ে ফেলা ইত্যাদি। এছাড়া, এর মাধ্যমে হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনি এবং অন্ত্রনালীর স্থায়ী ক্ষতি হয়। 

রোগীর মানসিক অবস্থাতেও চাপ সৃষ্টি করে শরীরের রোগটি। ফলে তারা গভীর অবসাদ, উদ্বেগে ভোগেন। পরিষ্কার করে চিন্তা করার ক্ষমতাও অনেকটা হ্রাস পায়। 

সোজা কথায় 'লং কোভিড' সম্পূর্ণরূপে একজনের জীবন ধবংস করে দিতে সক্ষম। 

আক্রান্ত একজন জেড গ্রে- ক্রিস্টি জানান, 'আমি এখন এত অবসন্ন বোধ করি, যা আমি আগে কখনোই অনুভব করিনি।' 

সংক্রমণের পর মারাত্মক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি থেকে সেরে উঠতে দীর্ঘসময় লাগছে- শুধু এমন অবস্থা নয় 'লং কোভিড'। করোনার মাঝারি সংক্রমণে ভোগা অনেক ব্যক্তিও পরবর্তীতে দীর্ঘমেয়াদি এ অসহনীয় শারীরিক সমস্যার কবলে পড়তে পারেন। 

'লং কোভিডের অস্তিত্ব নিয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই' বলছিলেন ইউনিভার্সিটি অব এক্সিটার-এর অধ্যাপক ডেভিড স্ট্রেইন। নিজের দূরারোগ্য ব্যাধি চিকিৎসা কেন্দ্রে তিনি প্রতিদিন এমন রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। 

তথ্যচিত্র: বিবিসি

ঠিক কতজন এতে আক্রান্ত হচ্ছে?

ছাড়া পাওয়ার পরবর্তীকালে ১৪৩ জন রোগীর স্বাস্থ্যের উপর একটি গবেষণা প্রকাশ করে ইতালির রাজধানী রোমের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল। ওই গবেষণায় দেখা যায়, ৮৭ শতাংশ রোগীর মধ্যে কমপক্ষে একটি উপসর্গ দেখা গেছে এবং তাদের অর্ধেকের বেশি ক্লান্তি এবং অবসন্নতায় ভুগছেন।  

গবেষণাটির অবশ্য কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কারণ, গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল- শুধুমাত্র এমন রোগীর উপরই গবেষণাটি করা হয়।  

হাসপাতালে ভর্তি যাদের হতে হয়নি, তেমন সিংহভাগ রোগীর ক্ষেত্রে কী হয়েছে- তা স্পষ্ট নয়। 

যুক্তরাজ্যে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ কোভিড-১৯ উপসর্গ শনাক্ত করার একটি ট্র্যাকার অ্যাপ ব্যবহার করেন। ওই অ্যাপ সূত্রে পাওয়া তথ্য জানা যায়, আক্রান্ত হওয়ার ৩০ দিন পরও ১২ শতাংশের দেহে কোনো না কোনো উপসর্গ ছিল। 

তাছাড়া, অপ্রকাশিত অতি-সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা উপাত্ত সূত্রে জানা গেছে, কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত প্রতি ৫০ জনের মধ্যে একজনের দেহে আক্রান্ত হওয়ার ৯০ দিন পরও 'লং কোভিড'- এর উপসর্গ দেখা যায়। 

লং কোভিড কী করোনার ভয়াবহ সংক্রমণ থেকেই তৈরি হয়?

খুব সম্ভবত এমনটা হচ্ছে না। 

আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন শহরে করা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, করোনা আক্রান্ত হওয়ার ১০ সপ্তাহ পরও অবসন্নতায় ভুগেছেন অর্ধেকের বেশি মানুষ। আর শারীরিকভাবে কাজে ফিরতে পারেননি তাদের এক-তৃতীয়াংশ। 

চিকিৎসকরাও গুরুতর সংক্রমণের সঙ্গে ক্লান্তির মতো উপসর্গের কোনো সম্পর্ক দেখাতে পারেননি। 

অবশ্য, প্রচণ্ড হাঁপিয়ে ওঠার ঘটনা 'লং কোভিড'-এর একটি উপসর্গ মাত্র। 

এব্যাপারে যুক্তরাজ্যের লিসেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং সংক্রমণ পরবর্তী কোভিড রোগীদের সেরে ওঠার একটি বিশেষ প্রকল্পের প্রধান গবেষক- ক্রিস ব্রাইটলিং বলেন, করোনাভাইরাসের সংস্পর্শে যাদের মধ্যে নিউমোনিয়া দেখা দেয়, সম্ভবত তারাই পরবর্তীতে লং কোভিডে ভুগছেন। কারণ, এতে তাদের ফুসফুস মারাত্মক ক্ষতির শিকায় হয়। 
 

লাংস স্ক্যানের চিত্রে করোনাভাইরাস সৃষ্ট নিউমোনিয়া আক্রান্ত স্থানগুলো দেখা যাচ্ছে। ছবি: বিবিসি

ভাইরাস কীভাবে লং কোভিড সৃষ্টি করে?

এনিয়ে প্রচুর ধারণা আছে, তবে নির্দিষ্ট কোনও উত্তর নেই।

শরীরের বেশিরভাগ অংশ সংক্রমণ মুক্ত হওয়ার পরও, শরীরের বিচ্ছিন্ন কিছু স্থানে আশ্রয় নিতে পারে ভাইরাস। হয়তো সেখান থেকেই সে দেহে লং কোভিড তৈরি করে চলে। 

এব্যাপারে লন্ডনের কিংস কলেজের অধ্যাপক টিম স্পেকটর বলেন, ''আক্রান্ত ব্যক্তির যদি দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া থাকে, তাহলে বুঝতে হবে ভাইরাস তার পাকস্থলীতে রয়ে গেছে। আপাতত এমন অনুমানের ভিত্তিতে আমরা লং কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াই করছি।''  

করোনভাইরাস সরাসরি দেহের বিভিন্ন ধরনের কোষগুলিকে সংক্রামিত করতে পারে এবং দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় প্রতিক্রিয়া শুরু করতে পারে, যা পুরো শরীর জুড়ে ক্ষতিও করে।

এব্যাপারে একটি তাত্ত্বিক ধারণা হচ্ছে, অনেক সময় কোভিড সংক্রমণের পরে অনেকের দেহে স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে না, যা পরবর্তীতে শারীরিক অবস্থার দীর্ঘমেয়াদি অবনতির কারণ হয়।  
এ অবস্থায় সংক্রমণ মানবদেহের নানা প্রত্যঙ্গের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত করে। ফুসফুসের ক্ষেত্রে যা এখন প্রমাণিত। ফুসফুস দুর্বল হয়ে পড়ার ফলে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা ইতোপূর্বে করোনা গোত্রের অন্য দুই জীবাণু- সার্স এবং মার্স- এর প্রাদুর্ভাবের সময় লক্ষ্য করা গেছে। 

  • সূত্র: বিবিসি

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.